মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায়
শহরের সরকারি হাসপাতালগুলি মশার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ উঠছিল বার বার। স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য সে কথায় বিশেষ কান দেননি। আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে এ বার কলকাতার একটি মেডিক্যাল কলেজের প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীর মৃত্যু হল ডেঙ্গিতে। মালিনী বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮) নামে আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ওই ছাত্রী হাসপাতালের মেয়েদের হস্টেলের আবাসিক ছিলেন।
গত ২৩ নভেম্বর থেকে আর জি করেই ভর্তি ছিলেন মালিনী। অবস্থার অবনতি হওয়ায় মঙ্গলবার তাঁকে বাইপাসের এক হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। বুধবার গভীর রাতে সেখানেই মারা যান মালিনী। ওই ছাত্রীর রক্তে আগে থেকেই কিছু সমস্যা ছিল। অস্থিমজ্জার অসুখও ছিল তাঁর। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেঙ্গি হেমারেজিক শক এবং সেপ্টিসেমিয়া বলে উল্লেখ থাকলেও এ ক্ষেত্রে সেই কারণগুলিকেই বড় করে দেখাতে চেয়েছে পুরসভা। মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, ‘‘মেয়েটির শরীরে রক্ত সংক্রান্ত কিছু সমস্যা ছিল। রক্ত পরীক্ষায় নানা সমস্যার সঙ্গে ডেঙ্গি এনএস১-ও পজিটিভ পাওয়া গিয়েছে।’’ মৃত্যু যে ডেঙ্গিতেই হয়েছে, তার প্রমাণ পুরসভা এখনও পায়নি বলে জানিয়েছেন তিনি।
আর জি কর হস্টেলের আবাসিকেরা জানাচ্ছেন, বর্ষার মরসুম শুরু হতে না হতেই প্রত্যেক বার হস্টেলে ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গির উপদ্রব শুরু হয়। এ বারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বেশ কয়েক জন আবাসিক ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। প্রথম দিকে কিছু দিন কর্তৃপক্ষ মশা মারার তেল ছড়ানোর বন্দোবস্ত করলেও পরে ফের পরিস্থিতি পুরনো অবস্থায় ফিরে যায়। আবাসিকদের অভিযোগ, বারবার বলা সত্ত্বেও সামগ্রিক পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কর্তৃপক্ষ কোনও ব্যবস্থাই নেননি। এক আবাসিক বলেন, ‘‘অনেক দিন ধরেই হস্টেলগুলি বিভিন্ন রোগের আঁতুড়ঘর হয়ে রয়েছে। এখানে যত্রতত্র আবর্জনা জমে থাকে। নর্দমাগুলি দীর্ঘদিন সংস্কার হয় না। নিয়মিত সাফাই হয় না শৌচাগারগুলিও। এ সব থেকেই বিভিন্ন রোগ ছড়ায়। বারবার অভিযোগ করেও লাভ হয়নি।’’
হস্টেল সূত্রে খবর, বর্ষা চলে যাওয়ার পরে ডেঙ্গির উপদ্রব কিছুটা কমলেও অক্টোবরের শুরু থেকেই ফের এই রোগে আক্রান্ত হন কয়েক জন ছাত্রী। বেশ কয়েক জন বাড়ি ফিরে যেতেও বাধ্য হন। অভিযোগ, তার পরেও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষের। ডেঙ্গি রুখতে কোনও রকম সাবধানতা নেওয়া হয়নি বলেই অভিযোগ করছেন পড়ুয়ারা।
আরজিকর কর্তৃপক্ষ অবশ্য বিষয়টি নিয়ে কিছু বলতে চাননি। সুপার
প্রবীর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনও কথা বলা বারণ। স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশ আছে।’’
সুপার না বললেও আর জি করে ডেঙ্গির প্রাদুর্ভাব সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল কলকাতা পুরসভা। সাংসদ-চিকিৎসক কাকলি ঘোষদস্তিদার এ বিষয়ে পুরসভাকে সতর্কও করেছিলেন। পুরসভার মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ নিজেই এ দিন সে কথা জানিয়ে বলেন, ‘‘কাকলিদি বলার পরে পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরও ওই মেডিক্যাল কলেজে মশা মারার অভিযান চালায়। ডেঙ্গি রোধে যা করণীয়, গত সাত দিন ধরে তা-ও করা হচ্ছে।’’ তবে ডেঙ্গির জেরেই মালিনীর মৃত্যু হয়েছে, সে কথা মানতে চাননি তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘ডেঙ্গির কারণে হেমারেজিক শক বা হেমারেজিক ফিভারে মৃত্যু হলে তবেই তা ডেঙ্গিতে মৃত্যু বলে ধরে নেওয়া হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইনও সে রকমই। এ ক্ষেত্রে তা হয়নি বলেই জেনেছি।’’
তা হলে কি সরকারি হাসপাতালের রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টেও ভরসা নেই পুরসভার? মেয়র বলেন, ‘‘আর জি করের রক্ত পরীক্ষায় ডেঙ্গির জীবাণু মিলেছে। তাই ডেঙ্গি হয়নি, এমনটা বলতে চাই না। তবে ওই কারণেই যে মৃত্যু, তা বলার সময় আসেনি। পুরো রিপোর্ট হাতে আসার পরে বলতে পারব।’’
গত ২২ নভেম্বর প্রবল জ্বরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন মালিনী। পরদিনই তাঁকে আরজিকরে ভর্তি করা হয়। সিসিইউ (ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট)-তে চিকিৎসা চলছিল তাঁর। মালিনীর চিকিৎসার জন্য বেসরকারি হাসপাতালে বিপুল খরচের কথা ভেবে তহবিল সংগ্রহের ব্যবস্থাও করেন আর জি করের পড়ুয়ারা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার আর প্রয়োজন রইল না। এ দিন দিনভরই শোকের ছায়া ছিল আর জি করে। মিশুকে, হাসিখুশি এই পড়ুয়ার আকস্মিক মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না শিক্ষক থেকে পড়ুয়ারা কেউই।
চিকিৎসকেরা জানান, দুর্গাপুরের বাসিন্দা মালিনীর রক্তাল্পতা এবং অস্থিমজ্জার অসুখ ছিল। তাঁর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও খুবই কমে গিয়েছিল ওই অসুখের কারণেই। এর সঙ্গে ডেঙ্গি হওয়ায় পরিস্থিতি অনেক জটিল হয়ে পড়ে। আর জি করেরই এক পড়ুয়া জানান, একটা সময়ের পরে মালিনীর রক্তে প্লেটলেটের পরিমাণ হু হু করে কমে আসছিল। কিছুতেই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছিল না। এর পরেই দ্রুত তাঁর একাধিক অঙ্গ বিকল হতে শুরু করে।
এমনিতে বর্ষা চলে যাওয়ার পরে ডেঙ্গির প্রকোপ কমতে থাকে। এ বার তা না হওয়ায় উদ্বিগ্ন চিকিৎসকমহল। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, আবহাওয়াই এর জন্য দায়ী। এমন আবহাওয়ায় জীবাণুরা তো সক্রিয় থাকেই, তা ছাড়া মশার উপদ্রবও বাড়ে। কড়া শীত না পড়া পর্যন্ত এই সমস্যা কমবে না বলেই জানাচ্ছেন তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy