Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

হৃদ্‌রোগে ‘ড্রোন’ দাওয়াই বাঙালির

বছরখানেক আগে ধরা পড়ে রোগটা। যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন কমছে বুকের ধুকপুকুনি। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে জানান, উত্তর কলকাতার ওই বাসিন্দার হৃৎপিণ্ডের ভিতরে থাকা এক ধরনের কোষ (কার্ডিও মায়োসাইট) ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ায় এই অবস্থা। এই রোগ সারানোর কোনও অস্ত্রোপচার নেই। চিকিত্‌সকদের ভরসা তাই ওষুধেই। রোগের নাম কার্ডিও মায়োপ্যাথি।

কুন্তক চট্টোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৫ ০২:৫০
Share: Save:

বছরখানেক আগে ধরা পড়ে রোগটা। যত দিন যাচ্ছে, ততই যেন কমছে বুকের ধুকপুকুনি। চিকিৎসকেরা পরীক্ষা করে জানান, উত্তর কলকাতার ওই বাসিন্দার হৃৎপিণ্ডের ভিতরে থাকা এক ধরনের কোষ (কার্ডিও মায়োসাইট) ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে পড়ায় এই অবস্থা। এই রোগ সারানোর কোনও অস্ত্রোপচার নেই। চিকিত্‌সকদের ভরসা তাই ওষুধেই। রোগের নাম কার্ডিও মায়োপ্যাথি।

কিন্তু ওষুধ খেলেও যে ফল মিলবে, তা কিন্তু নয়। রোগটা কিছুটা ঠেকিয়ে রাখা যায়। তবে হৃদ্‌রোগের চিকিৎসকদের অনেকেই বলছেন, সেই ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় অকেজো হয়ে পড়তে পারে কিডনি, লিভার। তাই রোগটা নিয়ে হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞদের দুশ্চিন্তার শেষ নেই! তবে আশার আলো দেখিয়েছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিজ্ঞান বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্থা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেস’-এর একটি যৌথ গবেষণা। তাতে ‘ড্রোন’ প্রযুক্তির ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানীরা। ওই উড়ুক্কু যানে করে ওষুধ পৌঁছে যাবে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে। সারিয়ে তুলবে অসুখ। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটবে না অন্য কোনও অঙ্গে।

কী ভাবে? ওই যৌথ গবেষণার প্রধান কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর সাগরতীর্থ সরকারের দাবি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই এর চিকিত্‌সা সম্ভব। এই চিকিত্‌সা পদ্ধতিতে জিনতত্ত্ব এবং ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন গবেষকেরা। কার্ডিয়াক মায়োপ্যাথির চিকিৎসায় যে সব ওষুধ ব্যবহার করা হয়, তারা রক্তের সঙ্গে মিশেই পৌঁছে যায় অন্য অঙ্গে। সেই অঙ্গে বিরূপ প্রভাব ফেলে ওষুধ। জিনতত্ত্ব এবং ন্যানোপ্রযুক্তির সাহায্যে কার্ডিও মায়োপ্যাথির ওষুধ সরাসরি হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে দেওয়ার উপায় তাঁরা উদ্ভাবন করেছেন বলে গবেষকদের দাবি। তাতে ওষুধটি আর রক্তে মিশবে না। তাই অন্য অঙ্গের কাজকর্ম প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলে দাবি করেছেন তাঁরা। সাগরতীর্থবাবুদের এই গবেষণাপত্রটি ‘জার্নাল অব কন্ট্রোলড রিলিজ’ নামে গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।

ওই গবেষক দলের সদস্যরা বলছেন, ‘ড্রোন’ বা দূর নিয়ন্ত্রিত উড়ুক্কু যান ব্যবহার করে যে ভাবে সেনারা শত্রুঘাঁটিতে বোমা ফেলেন, এ ক্ষেত্রেও অনেকটা একই কায়দায় ওষুধ পৌঁছবে হৃৎপিণ্ডের ভিতরে।

সাগরতীর্থবাবু বলেন, একটি আনুবীক্ষণিক মাপের ষড়ভূজ বাহন তৈরি করা হয়েছে। যা অনেকটা ড্রোনের মতোই তার তিনটি পায়ে কার্ডিও মায়োপ্যাথির একটি ওষুধ এবং তিনটি পায়ে দেহের মধ্যে পি-৫৩ জিনের (এই জিনের জন্য কোষ বিভাজন নিয়ন্ত্রিত থাকে। তার ফলে টিউমার তৈরি হয় না) কাজ বন্ধ করার রাসায়নিক দেওয়া রয়েছে। ওই বাহনের সামনে রয়েছে একটি বিশেষ রাসায়নিক। যেটি বাহনটিকে সরাসরি হৃৎপিণ্ডে পৌঁছে দেবে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের দাবি, এর ফলে দেহের অন্য জায়গায় ওই ওষুধ বা জিনটি বন্ধ হওয়ার কোনও প্রতিক্রিয়া পড়বে না। প্রাথমিক ভাবে সাগরতীর্থবাবুরা ইঁদুরের উপরে এই পরীক্ষা করেছেন।

কিন্তু মানুষের উপরে এই প্রক্রিয়া সফল হবে কি? সাগরতীর্থবাবুর ব্যাখ্যা, প্রাথমিক ভাবে ইঁদুরের উপরে পরীক্ষা হয়েছে। পরবর্তী কালে মানবদেহেও এই পরীক্ষা করা হবে। সাধারণত যে কোনও রোগের কোনও নতুন ওষুধ, নতুন প্রযুক্তি এবং জিনতত্ত্বের পরীক্ষা সাদা ইঁদুরের উপরেই হয়। কারণ শারীরবৃত্তীয় ভাবে মানুষের সঙ্গে সাদা ইঁদুর একই গোত্রীয়। শারীরবিজ্ঞানীরা বলছেন, ইঁদুরের উপরেই এ ধরনের পরীক্ষা চালানোটা দস্তুর। চিকিৎসকদের একাংশ বলছেন, সাগরতীর্থবাবুরা যে ভাবে এই চিকিৎসা পদ্ধতি বাতলেছেন, তাতে পরীক্ষা সফল না হলেও ক্ষতির আশঙ্কা কম। কারণ, কার্ভিডিলল গোত্রের ওষুধ এমনিতেই কার্ডিও মায়োপ্যাথিতে কাজ করে। তার উপরে হৃৎপিণ্ডে যে টিউমার হয় না, সেটাও প্রমাণিত। তার ফলে পি-৫৩ জিন বন্ধ করে দিলে হৃৎপিণ্ডে টিউমার হবে না। ফলে ক্ষতির তেমন সম্ভাবনা নেই। সাগরতীর্থবাবুরা চান, এ দেশেই কোনও শিল্পসংস্থার সাহায্য নিয়ে তাঁদের প্রযুক্তির হিউম্যান ট্রায়াল সম্পন্ন করতে।

কার্ডিও মায়োপ্যাথির নতুন এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে কী বলছেন চিকিৎসকেরা?

কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিত্‌ বসু বলছেন, এটা এক ধরনের স্টেম সেল চিকিত্‌সা। হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে কোষগুলি বিকল হয়ে পড়লে এই চিকিত্‌সায় তা সারিয়ে তোলা সম্ভব হবে। এ নিয়ে দেশ-বিদেশে নানা গবেষণা চলছে। যদি সত্যিই এই গবেষণা সফল হয়, তা হলে চিকিত্‌সাক্ষেত্রে যুগান্তকারী সাফল্য আসবে বলেই মনে করেন তিনি। শহরের আর এক কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সুশান মুখোপাধ্যায় বলছেন, এই ধরনের গবেষণা ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে সত্যিই প্রয়োজনীয়। কার্ডিও মায়োপ্যাথির ক্ষেত্রে এই ধরনের চিকিৎসাও অত্যন্ত উপযোগী।

হৃদ্‌রোগ বিশেষজ্ঞ বিশ্বকেশ মজুমদার বলছেন, কার্ডিও মায়োপ্যাথি দু’ধরনের। হাইপারট্রফিক ও ইস্কিমিক ডায়ালেটেড। হাইপারট্রফিকের
ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে। কিন্তু ইস্কিমিক ডায়ালেটেড কার্ডিও মায়োপ্যাথির ক্ষেত্রে এই চিকিৎসা কার্যকরী হবে না বলেই তিনি মনে করেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE