Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
মেডিক্যালের ওয়ার্মার

চাপ-বিতর্কেই নাকাল শিশুমৃত্যুর তদন্ত

রাজ্যের অন্যতম প্রধান মেডিক্যাল কলেজে শিশু বিভাগের ওয়ার্মারে পুড়ে দুই নবজাতকের মৃত্যু। ঘটনার তদন্ত-রিপোর্ট পেশের এক সপ্তাহের মধ্যে ফের দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি গঠন। আর সেই কমিটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টার জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাথায় আসীন কিছু ব্যক্তির দিকে অভিযোগের আঙুল, যার নেপথ্যে আবার ‘প্রভাবশালী’দের অন্তর্দ্বন্দ্বেরও ছায়া!

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৪:১০
Share: Save:

সবটাই নজিরবিহীন!

রাজ্যের অন্যতম প্রধান মেডিক্যাল কলেজে শিশু বিভাগের ওয়ার্মারে পুড়ে দুই নবজাতকের মৃত্যু। ঘটনার তদন্ত-রিপোর্ট পেশের এক সপ্তাহের মধ্যে ফের দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি গঠন। আর সেই কমিটিকে প্রভাবিত করার চেষ্টার জন্য সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার মাথায় আসীন কিছু ব্যক্তির দিকে অভিযোগের আঙুল, যার নেপথ্যে আবার ‘প্রভাবশালী’দের অন্তর্দ্বন্দ্বেরও ছায়া!

সব মিলিয়ে ওয়ার্মার-কাণ্ডের জেরে স্বাস্থ্য-প্রশাসনে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, সাম্প্রতিক কেন, সুদূর অতীত খুঁড়েও তার জুড়ি খুঁজে পাচ্ছেন না কর্তাদের অনেকে। ওঁদের এ-ও আশঙ্কা, দুই তদন্ত কমিটিকে ঘিরে পরতে পরতে দানা বাঁধা বিতর্কের ফাঁসে তদন্তের আসল উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে পারে। মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ দফতরের শীর্ষ মহলের কানে ব্যাপারটা গিয়েছে। তাঁরা আশ্বাস দিয়েছেন, অতি দ্রুত দ্বিতীয় কমিটির রিপোর্ট পেশ করে দোষীদের শাস্তি দেওয়া হবে।

কিন্তু দ্বিতীয় কমিটি গঠনের দরকার আদৌ হল কেন?

জুনিয়র ডাক্তার থেকে শুরু করে অধ্যক্ষ— হাসপাতালের সর্বস্তর আপাতত সেই প্রশ্নে আলোড়িত। খোঁজ করতে নেমে জানা যাচ্ছে, প্রসূতি ও শিশুমৃত্যু রোধে মুখ্যমন্ত্রী গঠিত টাস্ক ফোর্সের যিনি চেয়ারম্যান, সেই ত্রিদিব বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম কমিটিটি তৈরি করেছিলেন, খুবই তাড়াহুড়োয়। কমিটির রিপোর্টে দেখা যায়, কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তার ও নার্সকে সাসপেন্ড এবং কিছু সিনিয়রকে বদলি করেই কমিটি দায়িত্ব সেরেছে।

স্বাস্থ্যভবনের খবর, এ নিয়ে হইচই শুরু হতেই কমিটির দুই সদস্য স্বাস্থ্যভবনকে জানান, ত্রিদিববাবু তাঁদের নানা ভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেছেন। মেডিক্যালের সিক নিউবর্ন কেয়ার ইউনিট (এসএনসিইউ)-এর প্রধান তাপস সাবুইয়ের বিরুদ্ধে যাতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া না হয়, সে জন্য কমিটির সব সদস্যকে তিনি চাপ দিয়েছেন বলে অভিযোগ আসে। ‘‘নালিশ খতিয়ে দেখে আমাদের মনে হয়েছিল, তাতে কিছু সারবত্তা আছে। স্বাস্থ্য-সচিব মলয় দে তখনই দ্বিতীয় তদন্ত কমিটি গড়ার সিদ্ধান্ত নেন।’’— বলছেন দফতরের এক শীর্ষ আধিকারিক।

কিন্তু নতুন কমিটির উপরেও চাপ সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। এ বার সাঁড়াশি চাপ! কী রকম?

এক দিকে বিতর্কের কেন্দ্রে সেই ত্রিদিববাবুই। অভিযোগ, তাপস সাবুইকে আড়াল করতে তিনি ফের কিছু জুনিয়র ডাক্তারকে বলির পাঁঠা করতে চাইছেন। কমিটির এক সদস্যের কথায়, ‘‘ত্রিদিববাবু শুধু বলছেন, যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। ভবিষ্যতে সবাইকে আরও সতর্ক থাকতে হবে। আবার জলঘোলা হলে বাকিরা উৎসাহ হারাবেন। তাই নতুন ভাবে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার দরকার নেই।’’ এমনকী, ব্যাপারটা ‘ম্যানেজ’ করলে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাঁর নামে ভাল সুপারিশ করার টোপও ত্রিদিববাবু তাঁকে দিয়েছেন বলে ওই সদস্যের দাবি।

বিতর্কের দাঁড়িপাল্লায় এক দিকে যদি ত্রিদিববাবু, তো অন্য দিকে শাসকদলের চিকিৎসক-নেতা নির্মল মাজি। যিনি নাকি তাপস সাবুইকে শাস্তিদানের ঘোরতর পক্ষপাতী এবং সে কথা সোচ্চারে ঘোষণা করতেও পিছপা নন। তদন্ত কমিটি-সূত্রে জানা যাচ্ছে, মেডিক্যাল কলেজে ও স্বাস্থ্যভবনে বসে নির্মল চিৎকার করে বলেছেন, ‘তাপসকে বঙ্গোপসাগর পার না-করা পর্যন্ত আমার শান্তি নেই।’ এমনও বলেছেন, ‘আমার নির্দেশ ছাড়া হাসপাতালে একটা পাতাও নড়ে না। তদন্তের রিপোর্টও আমার কথায় হবে।’ তাঁর নির্দেশ না-মেনে রিপোর্ট বানালে সকলকে ‘দেখে নেওয়া’র শাসানিও নির্মলবাবু দিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ।

ত্রিদিববাবু বা নির্মলবাবু— কেউই অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। ‘‘আমি কেন এ সব করতে যাব? কমিটির সদস্যদের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা। তাঁরা যা সিদ্ধান্ত নেবেন, ঠিকই নেবেন।’’— মন্তব্য ত্রিদিববাবুর। তা হলে ওঁর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেন? ত্রিদিববাবুর দাবি, ‘‘কিছু কর্তাব্যক্তি ও ডাক্তারবাবু আমাকে পছন্দ করেন না। তাঁরাই গুজব রটিয়ে আমার ভাবমূর্তিতে কালি ছেটাতে চাইছেন। জুনিয়রদের খেপাচ্ছেন। আমি কখনওই কোনও রাজনীতির মধ্যে থাকতে চাই না।’’ ঘনিষ্ঠমহলে ত্রিদিববাবু জানিয়েছেন, কারও প্রতি যাতে অবিচার না হয়, দফতরের এক শীর্ষ কর্তাকে তিনি শুধু সেটুকু দেখতে অনুরোধ করেছিলেন। এর মধ্যে প্রভাব খাটানোর কোনও প্রশ্ন নেই বলে তাঁর দাবি।

নির্মল কী বলেন?

তৃণমূলের বিধায়ক-চিকিৎসক কোনও প্রশ্ন শুনতেই চাননি। গোড়াতেই বলে দিয়েছেন, ‘‘আনন্দবাজার শুধু কুৎসা প্রচার করে। অনেক মিথ্যাচার করে। যা বলি, তার উল্টো লেখে। কিচ্ছু বলব না। যা পারেন, করে নিন।’’ তাঁর কোনও ক্ষতি করার ক্ষমতা যে কারও নেই, নির্মলবাবু সেটাও জানিয়ে রাখতে ভোলেননি। আর তাপস সাবুই মুখই খুলতে চাননি।

গত ২০ নভেম্বর রাতে মেডিক্যালের ইডেন বিল্ডিংয়ের তিনতলায় এসএনসিইউয়ে দু’টি শিশু মারা যায়। অভিযোগ, ওয়ার্মারে নজরদারি না-থাকায় তারা পুড়ে গিয়েছিল। ২৩ নভেম্বর পরিজনেরা লিখিত নালিশ করেন মেডিক্যালের সুপার শিখা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ির কাছে। ওই দিনই অধ্যক্ষের নেতৃত্বে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি কাজে নামে। কমিটির রিপোর্ট স্বাস্থ্যভবনে ত্রিদিববাবুর কাছে জমা পড়ে, যার ভিত্তিতে কয়েক জন জুনিয়র ডাক্তার ও নার্সকে সাসপেন্ড ও কিছু সিনিয়রকে বদলির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল স্বাস্থ্য দফতর।

এতে জুনিয়র ডাক্তারদের একটা বড় অংশের মধ্যে স্বাস্থ্য-কর্তাদের প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়েছে। লিখিত প্রতিবাদ, বিক্ষোভ সমাবেশ— কিছু বাদ নেই। প্রতিবাদীদের অনেকে সোমবার জানিয়েছেন, দ্বিতীয় কমিটির রিপোর্ট ‘নিরপেক্ষ’ না-হলে বড় আন্দোলন হবে। ‘‘সব দায় আমাদের ঘাড়ে কেন? পর্যাপ্ত ডাক্তার-নার্সের সংস্থান না-করে রাজ্য জুড়ে একের পর এক এসএনসিইউ খোলার সিদ্ধান্ত কি আমরা নিয়েছি?’’— প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা। ওঁদের দাবি, ‘‘আমরা দিন-রাত এক করে কাজ করছি। তা-ও সামলাতে পারছি না। যাঁরা বাহবা পাওয়ার লোভে একের পর এক এসএনসিইউ খুলছেন, জবাবদিহিটা তাঁরা করুন।’’

নিরপেক্ষ তদন্ত মানে কী? কোনও জুনিয়রের গায়ে আঁচড় না পড়া?

মেডিক্যালের শিশু বিভাগের এক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ট্রেনি (পিজিটি)-র ব্যাখ্যা, ‘‘একেবারেই তা নয়। আমরা চাই, রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে তদন্ত হোক। প্রভাব খাটানোর খেলা বন্ধ হোক।’’ কারা প্রভাব খাটাচ্ছেন জানতে চাইলে জবাব, ‘‘প্রিন্সিপ্যালকে জিজ্ঞাসা করুন।’’

মেডিক্যালের প্রিন্সিপ্যাল তপনবাবু যদিও জানিয়ে দেন, এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করবেন না। কিন্তু তিনিই নাকি দফতরের এক শীর্ষ কর্তার কাছে ‘তদন্তে চাপসৃষ্টি’র কথা জানিয়ে এসেছিলেন! শুনে অধ্যক্ষের সংক্ষিপ্ত প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি কাউকে কিছু বলিনি। আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চলছে।’’

এ দিকে মেডিক্যালের সিনিয়র ডাক্তারদের একাংশের অভিযোগ, নির্মলবাবু-ত্রিদিববাবু, দু’তরফেই আপাতত চেষ্টা চলছে জুনিয়র ডাক্তারদের নিজের পক্ষে নিয়ে আসার। ত্রিদিববাবু ইতিমধ্যে কয়েক জন সিনিয়রকে দায়িত্ব দিয়েছেন জুনিয়রদের ‘মাথা ঠান্ডা করানো’র। নির্মলবাবু অবশ্য বুঝিয়ে বলার ধার-কাছ দিয়ে যাচ্ছেন না। ‘‘মেডিক্যাল চত্বরে দাঁড়িয়ে উনি হুঙ্কার দিয়েছেন, কথা না-শুনলে ঠান্ডা করে দেব।’’— বলছেন এক চিকিৎসক।

পুরো ঘটনাপ্রবাহে স্বাস্থ্য প্রশাসন দস্তুরমতো সঙ্কটে। অন্য এক মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষের আক্ষেপ, ‘‘আমরা পড়েছি মহা ফাঁপরে। দু’জনের (ত্রিদিব-নির্মল) কেউ মেডিক্যাল শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত নন। তা-ও ওঁরা প্রতিনিয়ত শিক্ষক-চিকিৎসকদের উপরে নানান ফরমান জারি করে যাচ্ছেন। ডাক্তারবাবুদের ডেকে ডেকে শোনাচ্ছেন, তাঁরা নাকি ফাঁকিবাজ! মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নালিশ ঠোকার ভয় দেখাতেও কসুর করছেন না! সবাইকে সিঁটিয়ে থাকতে হচ্ছে।’’

এই পরিস্থিতিতে পরিষেবা চালানো কিংবা গুরুতর অভিযোগের সুষ্ঠু তদন্ত কতটা সম্ভব, সেই সংশয় প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে প্রসঙ্গে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘তদন্ত কোনও ভাবেই প্রভাবিত হবে না। নিরপেক্ষ তদন্ত সেরে দিন কয়েকের মধ্যে ওয়ার্মার-কাণ্ডের রিপোর্ট পেশ হবে।’’

আশ্বাস কাজে পরিণত হয় কিনা, আপাতত সেটাই দেখার প্রতীক্ষা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE