সদ্যোজাতের মৃত্যুর হার কমাতে কয়েক কোটি টাকা খরচ করে হাসপাতালগুলিতে এসএনসিইউ- এসএনএসইউ গড়ে তোলা হয়েছে। তাতেও শিশু মৃত্যুর হারে বিশেষ হেরফের হয়নি। অধিকাংশ শিশুর মৃত্যুর ক্ষেত্রেই চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ ওঠে। এ বার পাঁচ বছর পর্যন্ত প্রতিটি শিশুর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখতে গঠন করা হল বিশেষ কমিটি। জুলাই মাস থেকেই ‘চাইল্ড ডেথ রিভিউ’ নামে এই কমিটি পশ্চিম মেদিনীপুরে কাজ শুরু করবে। শিশু মৃত্যুর ক্ষেত্রে ঘটনার অভিযোগ দায়ের হোক বা না হোক, প্রতিটি ক্ষেত্রেই এই কমিটি শিশুর মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করবে। জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক গিরীশচন্দ্র বেরা বলেন, “সদ্যোজাতদের মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনা করে দেখার জন্য জেলায় একটি কমিটি হবে। আগামী জুলাই মাস থেকে এই কমিটি কাজ শুরু করবে।” তাঁর দাবি, “জেলায় শিশু মৃত্যুর হার কমেছে। তবে চেষ্টা করেও অনেক সময় কম ওজনের শিশুকে বাঁচানো যায় না।”
‘চাইল্ড ডেথ রিভিউ’ কমিটি গড়ার প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে মঙ্গলবারই মেদিনীপুরে এক বৈঠক হয়েছে। ওই বৈঠকে গিরীশচন্দ্রবাবুর পাশাপাশি উপস্থিত ছিলেন মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ তমালকান্তি ঘোষ, জেলার দুই উপ- মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সৌম্যশঙ্কর ষড়ঙ্গী, রবীন্দ্রনাথ প্রধান প্রমুখ। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, শিশু মৃত্যুর পর্যালোচনায় এই কমিটি গড়ার জন্য কেন্দ্রের পক্ষ থেকেই রাজ্যে নির্দেশ পাঠানো হয়। রাজ্য থেকে জেলায় জেলায় সেই নির্দেশ এসে পৌঁছয়।
এই কমিটি কী ভাবে কাজ করবে?
একাধিক স্তরে কাজ করবে এই কমিটি। শুরুতে মৃত শিশুর প্রাথমিক কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হবে। এ জন্য ব্লকে ব্লকে নোটিফিকেশন কার্ডও পাঠানো হবে। এই প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের কাজ করবেন এএনএম কিংবা স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা। কার্ডে ঠিক কী কী তথ্যের উল্লেখ রাখতে হবে? শিশুর নাম, তার বাবা- মায়ের নাম, শিশুটির জন্ম কোন হাসপাতালে হয়েছিল, বাড়ির সম্পূর্ণ ঠিকানা, ফোন নম্বর প্রভৃতি। মৃত্যুর দু’সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। প্রাথমিক ভাবে শিশুর মৃত্যুর কারণ পর্যালোচনাও করতে হবে। এক মাসের মধ্যে ব্লকে রিপোর্ট জমা পড়বে। পরে ব্লক থেকে ওই রিপোর্ট জেলায় পৌঁছবে। জেলা থেকে রাজ্যে। কমিটি গড়ার পর স্বাস্থ্য কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। জেলার এক স্বাস্থ্য- কর্তার কথায়, “এই পর্যালোচনার ফলে কোথাও সামান্য ভুল হয়ে থাকলে তা ধরা পড়বে। ফলে, পরবর্তী সময় একই ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কমে যাবে।”
প্রয়োজনীয় চিকিত্সক- কর্মী এবং অনান্য পরিকাঠামোর অভাবে শিশু ইউনিটগুলো ধুঁকছে। পশ্চিম মেদিনীপুরে ইতিমধ্যে ৩টি ‘এসএনসিইউ’ (সিক নিওনেটাল কেয়ার ইউনিট) ও ২২টি ‘এসএনএসইউ’ (সিক নিওনেটাল স্টেবিলাইজেশন ইউনিট) গড়ে তোলা হয়েছে। এসএনসিইউ রয়েছে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল, ঝাড়গ্রাম জেলা হাসপাতাল এবং ঘাটাল মহকুমা হাসপাতালে। এসএনএসইউ রয়েছে গ্রামীণ হাসপাতাল এবং ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে।
জেলার স্বাস্থ্য- কর্তাদের ধারণা ছিল, এই ইউনিটগুলো চালু হলে শিশু মৃত্যুর ঘটনা কমবে। ২৪ ঘণ্টাই সঙ্কটজনক শিশুদের বিশেষ পর্যবেক্ষণে রাখা যাবে। যদিও তারপরেও জেলায় শিশু মৃত্যুর হারের বিশেষ হেরফের হয়নি। মা ও নবজাতকদের স্বাস্থ্য রক্ষায় বিশেষ টাস্ক ফোর্স গঠন হয়েছে। একের পর এক ইউনিট গড়ে তোলা হয়েছে। গত তিন বছরের পরিসংখ্যান বলছে, পশ্চিম মেদিনীপুরে বছরে গড়ে ১,৬৯৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়। ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে জেলায় মোট ১ হাজার সাতশো ৯৩ জন শিশুর মৃত্যু হয়। ২০১৪-১৫ সালে মৃত শিশুর সংখ্যা ১ হাজার ছ’শো সাত। সংখ্যা সামান্য কমলে পরিস্থিতির বিশেষ উন্নতি হয়নি।
বাস্তব বলছে, ২০১২-১৩ অর্থবর্ষে মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৭৩৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়। ২০১৩-১৪ ও ২০১৪-১৫ অর্থবর্ষে যথাক্রমে ৭৭৫ জন ও ৫৯৬ জন শিশুর মৃত্যু হয়। মেডিক্যালে প্রসূতি মৃত্যুর হার ২০১৩-১৪ অর্থবর্ষে যেখানে ছিল ১৯। বিগত অর্থবর্ষে (২০১৪-১৫) তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২-এ। যদিও তা মানতে নারাজ স্বাস্থ্য কর্তারা।
জেলার এক স্বাস্থ্য- কর্তার দাবি, “এই পরিসংখ্যান তেমন অস্বাভাবিক নয়। মেদিনীপুর মেডিক্যালে গড়ে ২টি শিশুর মৃত্যু হয়ই। দিন কয়েক আগে ৪৫০ গ্রাম ওজনের এক টি শিশু জন্মায়। এত কম ওজনের শিশুকে বাঁচিয়ে রাখা সত্যি অসম্ভব।” পাশাপাশি, ফুসফুসে সংক্রমণ- শ্বাসকষ্টজনিত কারণেও শিশুর মৃত্যু হয় বলে দাবি তাঁর। ওই স্বাস্থ্য- কর্তার কথায়, “আমরা তো সঙ্কটজনক শিশুকে ফিরিয়ে দিতে পারি না। বাঁচানোর সব রকম চেষ্টাই করা হয়। কখনও কখনও চেষ্টা বিফলে যায়।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy