Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জঞ্জাল থেকে তুলে জোড়া হল আঙুল

আঙুল নড়ছে। নতুন নখও গজিয়েছে। দু’মাস আগে এই আঙুলই কিন্তু পড়ে ছিল ডাস্টবিনে।


কাটা আঙুল জোড়া লাগানোর পর। (ইনসেটে) চিকিৎসক পবন মণ্ডল।

কাটা আঙুল জোড়া লাগানোর পর। (ইনসেটে) চিকিৎসক পবন মণ্ডল।

প্রশান্ত পাল
পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ০৫ নভেম্বর ২০১৫ ০৩:২৪
Share: Save:

ডাস্টবিন থেকে তুলে কাটা আঙুল রোগীর হাতে জুড়ে দিয়েছিলেন ডাক্তারবাবু। বিরল অস্ত্রোপচারে বিরলতর সাফল্য। দিল্লি, মুম্বই, কলকাতার ঝাঁ-চকচকে হাসপাতাল নয়। পুরুলিয়ার দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালে এই তাক লাগানো ঘটনা যিনি ঘটিয়েছেন, তিনি শল্য চিকিৎসক পবন মণ্ডল। আঙুলের মালিক দরিদ্র ব্যবসায়ী মুক্তারাম দত্ত। আঙুল ফেরত পেয়ে চিকিৎসককে কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা খুঁজে পাচ্ছেন না।

বছর পঁয়তাল্লিশের মুক্তারামবাবু থাকেন পুরুলিয়া শহরের রামবাঁধ পাড়া এলাকায়। গত ২৬ অগস্ট বিকেলে সাইকেলে চেপে স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাচ্ছিলেন। একটি মোটরবাইক তাঁকে ধাক্কা মারে। সেই আঘাতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় ডান হাতের অনামিকার নখ থেকে কিছুটা অংশ। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় সদর হাসপাতালে। ক্ষতস্থান সেলাই করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া হয়। ইতিমধ্যে মুক্তারামবাবুর এক বন্ধু কাটা আঙুলটি রাস্তার ধার থেকে কুড়িয়ে পেয়ে নিয়ে যান হাসপাতালে। ততক্ষণে পেরিয়ে গিয়েছে তিন ঘণ্টারও বেশি। মুক্তারামবাবু বলেন, ‘‘আমার যে আঙুল কাটা গিয়েছে, তা বুঝতে পারি অপারেশন থিয়েটারে জ্ঞান ফেরার পরে। এক বন্ধু কাটা আঙুলটি নিয়ে এলে চিকিৎসক ও নার্সরা বলেছিলেন, এখানে জোড়া দেওয়া সম্ভব নয়। তখন
কাগজে মুড়ে আঙুলটা ফেলে দিয়েছিলাম ডাস্টবিনে।’’

খবরটা শুনে কিছুক্ষণ পরেই মুক্তারামবাবুকে হাসপাতালে ডেকে পাঠান চিকিৎসক পবনবাবু। আঙুলটা দেখতে চান। ডাস্টবিনে খুঁজে আঙুল পাওয়া গেল। পবনবাবুও প্রথমে বলেছিলেন, ওই হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করে আঙুল জোড়া দেওয়া যাবে না। তাঁর নিজেরই কথায়, ‘‘বলেছিলাম, বাইরে কোনও বড় হাসপাতালে যান! কিন্তু রোগী জানালেন, ‘তাঁর আর্থিক সঙ্গতি নেই, যা করার আপনিই করুন।’’ পবনবাবু নিজের কাছেই একটা চ্যালেঞ্জ রাখলেন। দু’মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরে জোড়া দেওয়া আঙুল ক্রমশ সুস্থ হচ্ছে। পবনবাবুও খুশি, সে দিন চ্যালেঞ্জটা নিয়েছিলেন বলে।

মুক্তারামবাবুর মতো সৌভাগ্য কিন্তু হয়নি এ বছর জুলাইয়ে বালুরঘাট হাসপাতালে জন্ম নেওয়া শিশুকন্যার। নার্সের গাফিলতিতে কাটা গিয়েছিল ওই শিশুর বুড়ো আঙুল। অভিযোগ, নার্স নিজের গাফিলতি ঢাকতে সেই আঙুল ফেলে দিয়েছিলেন ডাস্টবিনে। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরে শিশুটিকে নিয়ে যাওয়া হয় এসএসকেএম হাসপাতালে। কাটা আঙুল ঠিক মতো সংরক্ষণও করা হয়নি। ফলে রাজ্যের একমাত্র সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে আপ্রাণ প্রচেষ্টাতেও শিশুটির আঙুল আর জোড়া লাগেনি।

মুক্তারামবাবুর ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টার মধ্যেই কাটা আঙুল ডাস্টবিন থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ায় সুবিধা হয়েছে, এমনই মত চিকিৎসকদের। কিন্তু সীমিত সাধ্যে সেই কাজ সহজ ছিল না। পবনবাবু জানান, যখন আঙুল নিয়ে আসা হয়েছিল, তত ক্ষণে আঙুল সাদা হতে শুরু করেছে। অর্থাৎ রক্ত সংবহন প্রায় বন্ধ। কাটা আঙুলে ধুলো-বালিও লেগে ছিল। স্যালাইনে অনেকক্ষণ ভিজিয়ে রাখা হয় সেই কাটা অংশ। তার পর পবনবাবুর কথায়, ‘‘অনামিকার ক্ষতস্থানের ব্যান্ডেজ খুলে সেলাই কেটে টুকরো আঙুল সমান ভাবে কেটে জোড়া লাগাই।’’

অস্ত্রোপচারের পরে মুক্তারামবাবুকে দু’বেলা নিয়মিত পরীক্ষা করতেন পবনবাবু। তিনি বলেন, ‘‘সংক্রমণের আশঙ্কা ছিলই। তাই অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে টানা বারো দিন নজরে রেখেছিলাম। ক্ষতস্থান শুকিয়ে আসতে আঙুলের ভাঙা হাড় জোড়া লাগানোর উদ্দেশ্যে দু’দিকে ‘কে-ওয়্যার’ নামে এক ধরনের সরু তার ঢোকানো হয়।’’ তার পর ধীরে ধীরে আঙুলে সাড় ফিরল। আঙুল আবার নড়তে শিখল। গোলাপি নখও গজালো নতুন করে। পবনবাবু জানাচ্ছেন, এখন মুক্তারামবাবু
প্রায় স্বাভাবিক।

আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি বিভাগের প্রধান রূপনারায়ণ ভট্টাচার্য বললেন, পবনবাবু যে পথে এগিয়েছেন, চিকিৎসার পরিভাষায় তাকেকম্পোজিট গ্রাফটিং বলা হয়। ‘‘খুবই দক্ষতার সঙ্গে কেটে টুকরো হয়ে যাওয়া আঙুলটি জোড়া লাগিয়েছেন পবনবাবু।’’ কলকাতার খিদিরপুর একটি বড় হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জেন অনুপম গোলাসে-এরও বক্তব্য, ‘‘কোনও জেলা হাসপাতালে এই ধরনের সফল অস্ত্রোপচার খুবই ইতিবাচক লক্ষণ।’’ তাঁর কথায়, জেলা হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামোর অভাব রয়েছে ঠিকই। যদি চিকিৎসকদের ঠিক মতো সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়, তা হলে কাটা হাতও জোড়া লাগানো সম্ভব! কয়েক বছর যেমনটি করে দেখিয়েছিলেন গোলাসে নিজে! পুরুলিয়ার হাসপাতাল সূত্রে অবশ্য জানা গিয়েছে, পবনবাবু এর আগেও এই হাসপাতালে অনেক কঠিন অস্ত্রোপচার করেছেন। আঙুল ফেরত পাওয়ার পরে মুক্তারামবাবুও কী ভাবে ডাক্তারবাবুকে ধন্যবাদ জানাবেন, ভেবে পাচ্ছেন না। বিগলতি গলায় শুধু বললেন, ‘‘হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরেও পবনবাবু নিয়মিত আমার খবর নিতেন। এমনকী, বাড়িতে গিয়েও আমার ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করে দিয়েছেন।’’

পবনবাবুর কৃতিত্বের কথা পঞ্চমুখে স্বীকার করছেন স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারাও। পুরুলিয়ার জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘‘জেলা হাসপাতালের ইতিহাসে বিরল নজির। সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে পবন মণ্ডল দারুণ সাফল্য পেয়েছেন।’’ রাজ্য স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের মন্তব্য, ‘‘পুরুলিয়ার মতো একটি হাসপাতালে সীমিত পরিকাঠামোর মধ্যে ওই শল্য চিকিৎসক অত্যন্ত দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর এই কাজ অন্যদের অনুপ্রাণিত করবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE