Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
সিউড়ি সদর হাসপাতাল

ব্লাডব্যাঙ্কের বোর্ডে দালালদের নম্বর, জানেন না স্বাস্থ্য-কর্তাই

দাদা রক্ত লাগবে, পাব? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জবাব এল, ‘হ্যাঁ’। গ্রুপ বলতেই পাল্টা প্রশ্ন আসে, ‘ক’টা লাগবে?’। দুই ইউনিট রক্ত চাইতেই ফোনের অন্য প্রান্তের ব্যক্তি হাসপাতালেরই মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসতে নির্দেশ দেন। সঙ্গে আশ্বাস, ‘নিশ্চিন্তে চলে আসুন। যত ইউনিট রক্ত লাগবে, নিয়ে যান’! জেলায় হাসপাতালে হাসপাতালে যখন রক্তের এখন তখন খোদ জেলা সদর হাসপাতালেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে এমনই দালাল চক্র। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে তার এমনই প্রমাণ মিলল।

হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের বোর্ডে এ ভাবেই লেখা রয়েছে বিভিন্ন ফোন নম্বরে। —নিজস্ব চিত্র।

হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের বোর্ডে এ ভাবেই লেখা রয়েছে বিভিন্ন ফোন নম্বরে। —নিজস্ব চিত্র।

দয়াল সেনগুপ্ত
সিউড়ি শেষ আপডেট: ১২ জুন ২০১৫ ০২:১৭
Share: Save:

দাদা রক্ত লাগবে, পাব? ফোনের অপর প্রান্ত থেকে জবাব এল, ‘হ্যাঁ’। গ্রুপ বলতেই পাল্টা প্রশ্ন আসে, ‘ক’টা লাগবে?’। দুই ইউনিট রক্ত চাইতেই ফোনের অন্য প্রান্তের ব্যক্তি হাসপাতালেরই মধ্যে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় চলে আসতে নির্দেশ দেন। সঙ্গে আশ্বাস, ‘নিশ্চিন্তে চলে আসুন। যত ইউনিট রক্ত লাগবে, নিয়ে যান’!

জেলায় হাসপাতালে হাসপাতালে যখন রক্তের এখন তখন খোদ জেলা সদর হাসপাতালেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে এমনই দালাল চক্র। বৃহস্পতিবার হাসপাতালে তার এমনই প্রমাণ মিলল।

ঘটনা হল, সিউড়ি সদর হাসপাতালে গিয়ে যদি কারও রক্তের প্রয়োজন হয়। কেউ যদি দেখেন ব্লাড ব্যাঙ্কের তালিকায় সেই গ্রুপের রক্তের স্টক শূন্য দেখাচ্ছে। চিন্তা করবেন না! সরকারি ব্ল্যাকবোর্ডে সাদা কালি দিয়ে লেখা স্টক বোর্ডটা একটু মন দিয়ে দেখুন, তা হলেই কাজ হবে। দেখবেন, ব্লাড গ্রুপের উপরে কে বা কারা ধারালো কোনও কিছু দিয়ে কিছু ফোন নম্বর লিখে রেখে গিয়েছে। যে কোনও একটি নম্বরে ফোন করলেই মুশকিল আসান! অবশ্য সমাজসেবা করার জন্য নম্বরগুলি লেখা নেই। নম্বর লেখা হয়েছে, সমস্যায় পড়ে যাওয়া রোগীর আত্মীয়স্বজনের কাছে রক্ত জুগিয়ে বিনিময়ে মোটা টাকা হাতানোর উদ্দেশ্যেই।

যদিও রক্ত নিয়ে সিউড়ি হাসপাতালে দালাল চক্র কাজ করছে, এমন অভিজ্ঞতা কর্তৃপক্ষের আছে। এ নিয়ে একাধিক অভিযোগও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে হয়েছে। কিন্তু, কোনও দিন কেউ ধরা পড়েছে এমন খবর নেই। তাই বলে একেবারে সংরক্ষিত এলাকায় থাকা সরকারি বোর্ডে নিজেদের যোগাযোগ নম্বার খোদাই করে রক্তের ব্যবসা? বিষয়টি জানতে পরে চমকে উঠেছেন জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হিমাদ্রি আরি। তিনি বলছেন, ‘‘অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কী ভাবে এমনটা হল গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।’’

হাসপাতাল সুপার শোভন দে পিতৃ বিয়োগের কারণে বর্তমানে ছুটিতে আছেন। তবে, হাসপাতাল সূত্রেই জানা গিয়েছে, ঘনিষ্ঠ মহলে সুপার নিজেও বহুবার রক্ত নিয়ে হাসপাতালে সক্রিয় দালাল চক্রের কাজে উদ্বেগও প্রকাশ করেছেন। হাসপাতালের চিকিৎসকদেরই একাংশ বলছেন, ‘‘রক্তের এই বেআইনি কারবারে টার্গেট করা হচ্ছে ঝাড়খণ্ড এবং জেলার আদিবাসী, সহজ সরল মানুষ জনকে। ভীষণ প্রয়োজনে রক্ত সরবরাহ করে তাঁদের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে চলেছে।’’ কিন্তু, শিকড়ের সন্ধান মেলেনি। আরও একটি বিষয়ও হাসপাতালের নজরে এসেছে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন রক্তদান শিবিরে রক্তদাতাদের কার্ড নিয়েও ব্যবস্যা চলছে। অভিযোগ, রক্তদাতাদের বদলে হাত ঘুরে রক্তের কার্ড পৌঁছে যাচ্ছে দালাল চক্রের হাতে। এমনকী, রোগী সেজে পর পর সিরিয়াল নম্বর লেখা কার্ড দেখিয়ে ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে রক্ত তুলে নেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। কিন্তু, বিস্ময়কর ভাবে দালাদ চক্রের টিকিও কেউ ছুঁতে পারেননি।

রক্তের চক্র

“দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি আছে।
বোর্ডে নম্বর লেখার বিষয়টি সবে নজরে এসেছে।
শীঘ্রই বোর্ডে লেখা নম্বরগুলি ঢেকে দেওয়া হবে। কে বা কারা
এর পিছনে, তারও তদন্ত করা হচ্ছে।” —সুশান্ত মাকড়। ভারপ্রাপ্ত সুপার।

“অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয়। কী ভাবে এমনটা হল গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”
—হিমাদ্রি আরি। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক।

এ দিকে, রোগীদের অভিযোগ, গোটা চক্রের সঙ্গে ব্লাড ব্যাঙ্কের কর্মী, এমনকী চিকৎসকদেরও কেউ কেউ জড়িত। কেঁচো খুঁড়ে কেউটে বের করার সাহস যদিও কেউ করেননি। তবে, ভারপ্রাপ্ত সুপার সুশান্ত মাকড় দাবি করেছেন, ‘‘দালাল চক্রের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই জারি আছে। বোর্ডে নম্বর লেখার বিষয়টি সবে নজরে এসেছে। শীঘ্রই বোর্ডে লেখা নম্বরগুলি ঢেকে দেওয়া হবে। কে বা কারা এর পিছনে, তারও তদন্ত করা হচ্ছে।’’

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, গ্রীষ্মকালে এমনিতেই রক্তের সঙ্কট থাকে। আর সেই সময়েই বেশি সক্রিয় হয় রক্তের এই কারবারিরা। তবে, সিউড়ি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাঙ্কের দালাল চক্র নিয়েই যে শুধু সমস্যা, তা নয়। পরিকাঠামোগত দিক নিয়ে প্রশ্ন তুলে জেলা স্বাস্থ্য দতরের কাছে জবাব চেয়েছে রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের তরফে এই দিকটি দেখভালের দায়িত্বে থাকা ‘স্ন্যাক্স’। তড়িঘড়ি কিছু পদক্ষেপ করেছে জেলা স্বাস্থ্য দফতর। সিএমওএইচ বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন, ‘‘পরিচ্ছন্নতা, রক্ত সঞ্চয়ের জন্য রাখা রেফ্রিজারেটার খারাপ থাকা, ব্লাড ব্যাঙ্কের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্র না থাকার মতো সাতটি বিষয় নিয়ে আপত্তি ছিল। ইতিমধ্যেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE