সাফাইকর্মীর কাজ করতেন বি টি রোড পালপাড়া ফাঁড়ি এলাকার বস্তির বাসিন্দা গোপাল হরি। অবসর নিয়েছেন। বয়স সত্তর পেরিয়েছে। কিছু দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারি হাসপাতালে সব শয্যা ‘ফ্রি’ ঘোষণা করায় খুশি হয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, চিকিৎসার জন্য এ বার হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে আর কোনও টাকা খরচ করতে হবে না।
১ অক্টোবর রাতে সেই গোপাল হরিকেই আশঙ্কাজনক অবস্থায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজে মেল মেডিক্যাল ওয়ার্ডের ৬ নম্বর শয্যায় চিকিৎসক এস এস কুণ্ডু-র ইউনিটে ভর্তি করা হয়। বাড়ির লোকের অভিযোগ, হাসপাতালে দামি ইঞ্জেকশন ও যাবতীয় ওষুধ হাসপাতালের কাগজে লিখে মৌখিক ভাবে বাইরের দোকান থেকে কিনিয়েছেন ডাক্তারবাবুরা। মৌখিক ভাবে চিকিৎসকেরা কী নির্দেশ দিচ্ছেন, তা ধরার কোনও ব্যবস্থা তো স্বাস্থ্য দফতরের নেই!
৩ অক্টোবর বাড়ি ফেরেন গোপাল হরি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা মতো বিপিএল তালিকাভুক্ত ওই মানুষটির তিন দিনের চিকিৎসায় এক পয়সাও খরচ হওয়ার কথা নয়। কিন্তু গোপালবাবুর ওই তিন দিনে ওষুধ ও ইঞ্জেকশন বাবদ ১৭৫০ টাকা ছাড়াও হাসপাতালে আসা-যাওয়ার গাড়িভাড়া ও তাঁর খাওয়া খরচ লেগেছে। তিনি হাসপাতালে ফ্রি ডায়েটও পাননি, কারণ ভর্তির সময়ে তাঁর ফর্মে ডায়েটের জায়গাটি সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক খালি রেখে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ।
গোপালবাবুর মতো অভিজ্ঞতা কলকাতার আরও মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে অসংখ্য রোগীর হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। শয্যা ‘ফ্রি’ হলে নিয়ম মতো সেই শয্যায় ভর্তি রোগীদের সব পরিষেবা ও ওষুধপত্র নিখরচায় পাওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে এই নিয়ম নিয়েই রোগীদের মধ্যে বিস্তর বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েও বহু ক্ষেত্রে গ্যাঁটের কড়ি খরচ করতে হচ্ছে সেই রোগীদেরই।
যেমন, কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, হাসপাতালে প্যান্টোপ্রাজল, ওমিপ্রাজলের মতো অতিব্যবহৃত গ্যাস-অম্বলের ওষুধ নেই। নেই বমির ইঞ্জেকশন এবং সেফট্রিয়াক্সোন-পাইপারসিলিন-ট্যাজোব্যাক্টাম-এর মতো প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক। এই সবই অনলাইনে একটি সংস্থাকে সরবরাহের বরাত দেওয়া হয়েছিল। বরাতের ৪৫ দিনের মধ্যে তা সরবরাহ করার কথা, কিন্তু তা করা হয়নি।
অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজেই অর্থোপেডিক ইমপ্ল্যান্ট, অ্যাঞ্জিওগ্রাফিক ক্যাথিটার, প্রস্থেটিক হার্ট ভাল্ভ, পেসমেকার নিখরচায় মিলছে না। হাসপাতাল কর্তাদের ব্যাখ্যা, ‘‘এগুলি এক-একজন রোগীর এক-এক ধরনের এবং এক-এক দামের প্রয়োজন হয়। যতক্ষণ না স্বাস্থ্য দফতর কোনও মাপকাঠি ঠিক করে আমাদের জানাচ্ছে, আমরা কিনতে পারছি না। ফলে আপাতত রোগীদের দিয়েই কেনানো হচ্ছে।’’ নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে এগুলির পাশাপাশি অ্যালবুমিন, কেমোথেরাপির দামি ওষুধ অমিল। তার উপরে বিকেলের দিকে ৬ হাজার টাকার প্যাকেজে রেডিওথেরাপি-ও দিব্যি চালু রয়েছে। পে ক্লিনিক ও প্যাকেজ চিকিৎসা নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজে প্যান্টোপ্রাজলের আকাল। সিরিঞ্জ, ভায়েল, রাইলস টিউব, ইউরো সাকশন, টেস্টটিউব, স্লাইডের মতো অসংখ্য চিকিৎসা সামগ্রীর ভাঁড়ার শূন্য। সব কিনছেন রোগীরা। কামারহাটি-র বিএন বসু হাসপাতালে গ্লাভ্স, ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ, অম্বল-বমির ওষুধ কিছুই আপাতত না থাকায় বাইরে থেকে কিনছেন রোগীরা।
আবার রাজ্যের সুপার স্পেশ্যালিটি এসএসকেএম হাসপাতালে পিপেরাসিলিন, ট্যাজোব্যাকটাম, মেরোপেনাম ইঞ্জেকশন, জেন্টামাইসিন-এর মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ অ্যান্টিবায়োটিক এখন পাওয়া যাচ্ছে না বলে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। একাধিক বিভাগীয় প্রধান জানান, নিঃশব্দে নতুন একটা পদ্ধতি চালু হয়েছে হাসপাতালে। কোনও ওষুধ হয়তো রোগীকে লেখা হল অথচ তা হাসপাতালে নেই, তখন হাসপাতালের টিকিটে ওই ওষুধের পাশে ‘নট অ্যাভেলেবল’ লিখে পেশেন্ট পার্টিকে বলা হচ্ছে, ‘‘এই ওষুধ রোগীকে বাঁচাতে প্রয়োজন, কিন্তু আমাদের কাছে নেই। আপনারা লিখিত সম্মতি দিয়ে যদি জানান যে নিজেদের ইচ্ছায় বাইরের দোকান থেকে কিনে আনতে চাইছেন তা হলে আনতে পারেন।’’ ওই বিভাগীয় প্রধানদের কথায়, ‘‘কোনও রোগীর বাড়ির লোক এই অবস্থায় রোগীর প্রাণ বাঁচাতে সম্মতি দেবেন না? স্বাস্থ্য দফতর কৌশলে দায় এড়াচ্ছে।’’
নিখরচায় চিকিৎসা দেওয়ার প্রতিশ্রুতির ফানুস কি তবে অচিরেই ফুটো হবে? স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় এ ব্যাপারে উক্তি, ‘‘ঘোষণা মাত্রই সব হয়ে যাবে না। বাচ্চার দাঁত সুড়সুড় করলেই তো দাঁত বেরোয় না! সময় লাগে। তবে কিছু চিকিৎসক এবং হাসপাতাল দুষ্টুমিও করছে। তাদের সতর্ক করা হচ্ছে। শুভবুদ্ধির উদয় না হলে কোনও প্রচেষ্টাই সফল হয় না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy