Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আরজিকরের ওষুধ কেন একুশের স্বাস্থ্য শিবিরে

সরকারি হাসপাতালে হামেশাই রোগীর আত্মীয়দের প্রেসক্রিপশন হাতে ছোটাছুটি করতে হয় বাইরের ওষুধের দোকানে। কারণ ফার্মাসিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকে না। অথচ আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের ইন্ডোর ফার্মাসি থেকে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের জন্য তৈরি তৃণমূলের চিকিৎসা শিবিরে পাঁচ হাজার ওষুধ পাঠানো হয়েছিল। সেই ওষুধ কোনও কাজে লাগল কি না, কেউ জানে না।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৪ জুলাই ২০১৫ ০৪:০০
Share: Save:

সরকারি হাসপাতালে হামেশাই রোগীর আত্মীয়দের প্রেসক্রিপশন হাতে ছোটাছুটি করতে হয় বাইরের ওষুধের দোকানে। কারণ ফার্মাসিতে প্রয়োজনীয় ওষুধ থাকে না। অথচ আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের ইন্ডোর ফার্মাসি থেকে ২১ জুলাইয়ের সমাবেশের জন্য তৈরি তৃণমূলের চিকিৎসা শিবিরে পাঁচ হাজার ওষুধ পাঠানো হয়েছিল। সেই ওষুধ কোনও কাজে লাগল কি না, কেউ জানে না। তবে হাসপাতাল সূত্রের খবর, ২১ ধরনের রোগের চিকিৎসার জন্য পাঠানো ওই পাঁচ হাজার ওষুধের মধ্যে কোনও ওষুধই এখনও ফিরে আসেনি আরজিকর-এর ফার্মাসিতে। তার মধ্যে ছিল লিউকোপ্লাস্ট, গজ-ব্যান্ডেজও।

সরকারি হাসপাতালে যেখানে সব সময়েই ওষুধ বাড়ন্ত, সেখানে একটি রাজনৈতিক দলের সমাবেশের জন্য প্যারাসিটামল, ব্যথার ওষুধ, পেট খারাপ-পেট ব্যথার ওষুধ, বমি ও অ্যালার্জির এত ওষুধ পাঠানো হল কার নির্দেশে? কেন হাসপাতালের রোগীদের জন্য বরাদ্দ ওষুধ বাইরে যাবে? আরজিকর থেকে তৃণমূলের শিবিরে ওষুধ গিয়েছে, এটা জানাজানি হতেই স্বাস্থ্যভবন প্রাথমিক ভাবে খোঁজ নেওয়া শুরু করেছে। তাতে জানা গিয়েছে, কোনও সরকারি নির্দেশ ছাড়াই ওই ওষুধ তৃণমূলের স্বাস্থ্য শিবিরে পাঠিয়ে দেন আরজিকর কর্তৃপক্ষ। সরকারি নির্দেশ থাকলেও হাসপাতালের ওই ওষুধ পাঠানো যুক্তিযুক্ত ছিল কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন চিকিৎসকদের একাংশ।

স্বাস্থ্য ভবন সূত্রের খবর, ২১ জুলাই কলকাতা স্টেশনের বাইরে তৃণমূলের সভায় যোগ দিতে আসা মানুষদের জন্য স্বাস্থ্য শিবির বসিয়েছিল শাসক দল প্রভাবিত সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন (পিডিএ)। সেখানেই আরজিকরের ইন্ডোর ফার্মাসি থেকে ওষুধ গিয়েছিল। বিষয়টি ফার্মাসির দায়িত্বে থাকা অফিসার, হাসপাতাল সুপার এবং স্বাস্থ্য ভবনের একাধিক শীর্ষকর্তা জানতেন। আর এই ঘটনা যথাযথ হয়েছে কি না, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে স্বাস্থ্য ভবনে। সেখানে দুই শীর্ষ-কর্তার দু’রকম বয়ানে সরকারের বিড়ম্বনা আরও বেড়েছে।

স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী বলছেন, ‘‘একমাত্র বন্যা, ভূমিকম্প, মহামারী, জঙ্গি হামলা বা বড় কোনও বিপর্যয়ের সময়ে এটা করা যায়। এ ছাড়া হাসপাতালের ওষুধ কোনও ভাবেই বাইরে নিয়ে যাওয়া যায় না।’’

তা হলে আরজিকর থেকে তৃণমূলের শিবিরে ওষুধ গেল কেন?

স্বাস্থ্য অধিকর্তার জবাব, ‘‘জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল, স্টেট জেনারেল হাসপাতালগুলির দেখভালের দায়িত্ব আমার। সেগুলি থেকে কোনও দিন এই ভাবে ওষুধ পাঠানো হয়নি, হবেও না। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলির দেখভালের দায়িত্ব স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তার। আরজিকর কী করে এটা করল, সেটা তিনিই বলতে পারবেন।’’

স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় কী বলছেন? তাঁর যুক্তি, ‘‘এটা আর নতুন কী? আরজিকর থেকে আগেও অনেক বার এ রকম পাঠানো হয়েছে। সরকার তো সাগর মেলার মতো বিভিন্ন মেলার স্বাস্থ্যশিবিরেও ওষুধ পাঠায়। সেবার জন্যই তো যাচ্ছে।’’

কিন্তু ওই সব মেলার আয়োজক তো রাজ্য সরকার। রাজনৈতিক দলের স্বাস্থ্য শিবিরে কি এ ভাবে ওষুধ পাঠানো যায়? জবাব দেননি সুশান্তবাবু। আরজিকর মেডিক্যাল কলেজের সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘ভিআইপি কেউ এলে আমরা মেডিক্যাল টিম ও ওষুধ পাঠাই। সেই ভাবে মেডিক্যাল ক্যাম্পের জন্যও পাঠিয়েছি। ২১ জুলাই শহরে অনেক লোক এসেছিলেন। ওষুধের প্রয়োজন হতেই পারে।’’

পিডিএ-এর সচিব শান্তনু সেন বলেন, ‘‘আমাকে আরজিকরের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওঁরা শিবিরের জন্য ওই হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে সেই ওষুধ নিয়ম মেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কি না, বলতে পারব না।’’ ২১ জুলাইয়ের ওই স্বাস্থ্য শিবিরে কত জনের চিকিৎসা হয়েছে, তারও কোনও হিসেব কিন্তু আরজিকর-কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। কত ওষুধ, গজ-ব্যান্ডেজ ব্যবহৃত হয়েছে হিসেব নেই তার-ও। হাসপাতাল সূত্রের খবর, পিডিএ-এর এক জন নেত্রী, যিনি আবার আরজিকরের মহিলা চিকিৎসক, তিনিই ওষুধের তালিকা সুপারকে দেন। অডিটরের কাছে সুপার হিসেব দেবেন কী ভাবে? সুপারের জবাব, ‘‘সেই কৈফিয়ৎ আপনাকে দিতে বাধ্য নই। আগেও এই রকম হয়েছে। সে সব আমি বুঝে নেব।’’

আরজিকর হাসপাতালের ফার্মাসির ইনচার্জ প্রশান্ত মান্না বলেছেন, ‘‘আমাকে সুপার ডেকে একটি স্লিপে ‘টেক নেসেসারি অ্যাকশন’ লিখে ওষুধ দিতে বললেন। আমি দিয়ে দিলাম। খাতায় ‘মেডিসিন ইন্ডেনটেড ফর হেল্থ ক্যাম্প’ লিখে রেখেছি। অডিট ধরলে বলব, শিবিরে পাঠিয়েছিলাম। বা সুপারের সঙ্গে কথা বলতে বলব।’’ কিন্তু যে সব ওষুধ শিবিরে ব্যবহার হল না, তা কি ফেরত এসেছে? প্রশান্তবাবুর জবাব, ‘‘দু’দিন হাসপাতালে যাইনি। বলতে পারব না।’’ এ ব্যাপারে শান্তনু সেনের দাবি, ‘‘যে চিকিৎসকরা ওষুধ নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন অব্যবহৃত ওষুধ ফেরত দিয়েছেন হাসপাতালে।’’ স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে বারবার ফোন বা এসএমএস করেও জবাব মেলেনি।

পিঠ বাঁচাতে তৃণমূলপন্থী চিকিৎসকদের কেউ কেউ আবার দাবি করেছেন, বামফ্রন্ট আমলেও শাসক দলের বিভিন্ন সমাবেশের সময় এ ভাবে স্বাস্থ্য শিবির খোলা হত। তখনও সরকারি হাসপাতাল থেকেই ওষুধ আনা হত। বামফ্রন্ট আমলে ওই সব স্বাস্থ্য শিবিরের আয়োজক সরকারি চিকিৎসকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিসেস ডক্টর্স’-এর সভাপতি গৌতম মুখোপাধ্যায় দাবি করেন, ‘‘বাম জমানায় কোনওদিন আমাদের সংগঠনের কোনও স্বাস্থ্যশিবিরে সরকারি হাসপাতালের ফার্মাসি থেকে ওষুধ নিইনি।’’ তিনি জানান, তাঁরা সবসময় দিলখুশা স্ট্রিটের ‘পিপলস রিলিফ কমিটি’ থেকে ওষুধ নিতেন। এখনও তাই হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE