Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

প্রচারে উদাসীনতার ফাঁকেই থাবা আতঙ্কের

ওয়াই-ফাই নগর হিসেবে কলকাতাকে তুলে ধরতে ঢক্কানিনাদের সীমা নেই। সেটা জানান দেওয়ার জন্য বিশাল বিশাল হোর্ডিংও পড়েছে মহানগর জুড়ে। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু কী ভাবে ছড়ায়, কী ভাবেই বা এই রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে, সেই ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর কিংবা কলকাতা পুরসভার তরফে প্রচারের বালাই নেই। নেই কোনও হোর্ডিংও। মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই রোগটি নিয়ে দ্রুত আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে আমজনতার মধ্যে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:১৮
Share: Save:

ওয়াই-ফাই নগর হিসেবে কলকাতাকে তুলে ধরতে ঢক্কানিনাদের সীমা নেই। সেটা জানান দেওয়ার জন্য বিশাল বিশাল হোর্ডিংও পড়েছে মহানগর জুড়ে। কিন্তু সোয়াইন ফ্লু কী ভাবে ছড়ায়, কী ভাবেই বা এই রোগ থেকে মানুষ মুক্তি পাবে, সেই ব্যাপারে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর কিংবা কলকাতা পুরসভার তরফে প্রচারের বালাই নেই। নেই কোনও হোর্ডিংও। মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাই রোগটি নিয়ে দ্রুত আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে আমজনতার মধ্যে।

সরকারি প্রচার না-থাকায় সোয়াইন ফ্লু সম্পর্কে মানুষের সচেতনতায় ঘাটতি তো থাকছেই। তার উপরে স্বাস্থ্য দফতর এবং কলকাতা পুরসভা রোগটিকে তেমন গুরুত্ব না-দেওয়ায় মানুষের আতঙ্ক আর অসহায়তার সুযোগ নিচ্ছেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। বিশেষ করে শহরের বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালের সামনে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে মাস্ক। কারণ, একমাত্র মাস্ক পরেই এই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে প্রচার চালাচ্ছেন বিক্রেতারা। কী করা উচিত আর কী নয়, সেই বিষয়েও নিজের নিজের ইচ্ছেমতো প্রচার চালাচ্ছেন তাঁরা। চিকিৎসকদের একটা বড় অংশের ক্ষোভ, সরকারি নির্লিপ্তিই বিষয়টিকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। সোয়াইন ফ্লু-র মোকাবিলা গোটা দেশের কাছেই একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এ রাজ্যে সরকারের তরফে এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরির ন্যূনতম উদ্যোগও দেখা যায়নি। অথচ বাংলার গলাতেও ক্রমশ আঁটো হয়ে বসছে এই মারণ রোগের ফাঁস। ইতিমধ্যে প্রাণহানিও ঘটেছে একাধিক। তা হলে প্রচারে সরকারের অনীহা কেন?

প্রচারে সচেতনতা বাড়ে, এই সাদা কথার পাল্টা হিসেবে সরকারের বক্তব্য, প্রচারে আতঙ্কও বাড়ে। তাই তাঁরা এখনই কোনও রকম প্রচারের কথা ভাবছেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে। তাঁর ব্যাখ্যা, “প্রচার হলে মানুষ আরও বেশি ঘাবড়ে যাবেন। তাঁরা ভাববেন, পরিস্থিতি বোধ হয় সত্যিই খুব সঙ্গিন। তাই সরকারকেও প্রচারে নামতে হচ্ছে। এই আতঙ্কটা আমরা চাই না। কারণ পরিস্থিতি মোটেই সঙ্গিন নয়।”


সবিস্তার জানতে ক্লিক করুন।

যাঁরা সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজকর্ম করেন, তাঁদের অনেকেই অবশ্য স্বাস্থ্যসচিবের এই বক্তব্য মানতে রাজি নন। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলছেন, কোনও রোগ সম্পর্কে মানুষকে আগাম জানানো মানে আতঙ্ক ছড়ানো নয়। বরং তাতে বিভিন্ন লোকের কথায় বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাটা কমে। তা ছাড়া প্রচারের অর্থ যদি আতঙ্ক ছড়ানো হয়, তা হলে সারা বছর পুরসভা ম্যালেরিয়া বা ডেঙ্গি নিয়ে সচেতনতার প্রচার কেন চালায়, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বিশেষজ্ঞেরা। বিতর্কের জল আর বেশি ঘোলা না-করে তাঁদের অনেকেই বলে দিচ্ছেন, সোয়াইন ফ্লু নিয়ে রাজ্য সরকারের আগেই মানুষকে সচেতন করা উচিত ছিল।

যথাযথ প্রচারে সরকার মানুষকে সচেতন না-করায় বিভ্রান্তি বাড়ছে। মানুষের আতঙ্ক আর সাবধানতার তাগিদের সুযোগ নিয়ে ফায়দা লুটছে কিছু ব্যবসায়ী। বাগুইআটির সমীর মণ্ডল রবিবার সাতসকালে মুখে কালো মাস্ক পরে বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁর ছেলে হাসপাতালে ভর্তি। মাস্ক পরেছেন কেন? সমীরবাবুর জবাব, “কখন, কোথা থেকে কী ভাবে রোগ ছড়াবে, তা তো জানি না। তাই নিজে থেকেই সাবধান হচ্ছি।” হাসপাতাল-চত্বরে হাজির অধিকাংশ মানুষের মুখেই এ দিন মাস্ক ছিল। আশপাশের দোকান থেকে সেগুলি বিভিন্ন দামে কিনেছেন তাঁরা। বিক্রেতারাও সুযোগ বুঝে কারও কাছ থেকে ৩০, কারও ৪০, অনেকের কাছ থেকে ৫০ টাকা দাম নিয়েছেন। বিসি রায় এবং আইডি হাসপাতালের আশপাশে এই ধরনের মাস্ক বেশি বিক্রি হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ওই সব মাস্ক চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যবহার্য নির্দিষ্ট মান অনুযায়ী তৈরি নয়। চিকিৎসকেরাও বলছেন, এক খণ্ড কালো কাপড়ে দু’টো ফিতে লাগিয়ে মাস্ক হিসেবে বিক্রি করছেন বহু বিক্রেতা। যা সব দিক থেকেই নিম্ন মানের। এবং কোনও কাজেরই নয়।

আইডি হাসপাতালের সামনের ছবিটাও একই রকম। সেখানে সোয়াইন ফ্লু-র উপসর্গ নিয়ে আসা রোগীর ভিড় উপচে পড়ছে। বেশির ভাগেরই মুখে নিম্ন মানের মাস্ক কিংবা কাপড়ের খণ্ড বাঁধা। সামান্য গা গরম হলেই ভয় পেয়ে হাসপাতালে চলে আসছেন অনেকে। হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানান, সরকারের প্রোটোকল অনুযায়ী সোয়াইন ফ্লু-র নির্দিষ্ট উপসর্গ দেখে তবেই হাসপাতালে ভর্তি করে থুতুর নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে মানুষকে অযথা আতঙ্কিত না-হওয়ারই পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।

প্রশ্ন হল, অযথা আতঙ্ক যাতে না-ছড়ায়, সেই ব্যাপারে রাজ্য সরকারের উদ্যোগ চোখে পড়ছে না কেন? সোয়াইন ফ্লু কী ভাবে ছড়ায়, কী ভাবে সাবধান থাকা উচিত, সেই বিষয়ে স্বাস্থ্য দফতর বা পুরসভার তরফে কোনও পোস্টার, ব্যানারের ব্যবস্থাই তো করা হয়নি। মাইকে বা গণমাধ্যমে প্রচারের ব্যবস্থাও নেই। এই রোগ সারা দেশে যে-ভাবে ছড়াচ্ছে, যে-ভাবে প্রতিদিনই কোনও না কোনও জায়গা থেকে মৃত্যুর খবর আসছে, সেখানে রাজ্যের তরফে কোনও প্রচার নেই কেন?

“যে-সব দিকে সরকারের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন, সে-দিকে আমরা উদ্যোগী। চিকিৎসার বিষয়ে কোনও ত্রুটি থাকছে না। প্রচারের সময় এখনও আসেনি,” বলছেন স্বাস্থ্যসচিব। আর মাস্ক? মলয়বাবুর জবাব, “মানুষকে বুঝতে হবে যে, ওই সব সাধারণ মাস্কে কোনও লাভ হয় না। ‘এন-৯৫’ মাস্ক ছাড়া আর সবই এ ক্ষেত্রে অকেজো। এবং ‘এন-৯৫’ মাস্ক হাসপাতাল ছাড়া অন্যত্র পরে ঘোরা সম্ভব নয়।”

এ দিন সকালে বিসি রায় হাসপাতালে মুর্শিদাবাদের ভগবানগোলার বাসিন্দা তরন্নুম নামে আড়াই বছরের একটি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। শিশুটি কয়েক দিন ধরেই সঙ্কটজনক অবস্থায় ছিল বলে হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষ জানান। তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। এই নিয়ে রাজ্যে সোয়াইন ফ্লুয়ে চার জনের মৃত্যু হল। বিসি রায় হাসপাতালে ভর্তি অন্য একটি শিশুর অবস্থাও আশঙ্কাজনক বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। আইডি হাসপাতালে কয়েক দিন আগে ১২ শয্যার আইসোলেশন ওয়ার্ড খোলা হয়েছে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে শীঘ্রই ওই ওয়ার্ডে শয্যা-সংখ্যা বাড়ানো হবে বলে স্বাস্থ্যকর্তারা জানান।

এই প্রথম রবিবারেও সোয়াইন ফ্লু-র পরীক্ষা হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, এ দিন আরও চার জনের রিপোর্ট এসেছে। সব মিলিয়ে আক্রন্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৬৭। “২৩ জনের থুতুর নমুনা পরীক্ষা করে চার জনের পজিটিভ এসেছে। স্ক্রিনিং ঠিকমতো না-করেই নমুনা পাঠানো হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালের চেয়ে বেসরকারি হাসপাতালে এটা বেশি হচ্ছে। মানুষ আতঙ্কিত হচ্ছেন বলে হাসপাতালগুলিও বাছবিচার না-করে নমুনা পাঠাবে, এটা ঠিক নয়,” বলছেন স্বাস্থ্যসচিব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swine flu awareness west bengal health department
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE