Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অ-প্রস্তুত মেয়ো তড়িঘড়ি খুলতে খাবলা মেডিক্যালে

সিমেন্ট আর বালির পুরু আস্তরণ চতুর্দিকে। পাখির বিষ্ঠা আর ধুলোয় মেঝেতে পা ফেলা দায়। ঘরে ঘরে ডাঁই হয়ে রয়েছে ধুলোভর্তি চেয়ার, ভাঙা ক্লিনিক্যাল টেবিল, হুইলচেয়ার, স্ট্রেচার। সিঁড়ি রাবণের স্বর্গসোপানের মতোই অসমাপ্ত। লিফট বসেনি। রোগীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি র্যাম্পও।

ধুলোর মধ্যে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায় পড়ে রয়েছে মেয়ো হাসপাতালের সরঞ্জাম। (ডান দিকে) বাইরে ঝাঁ-চকচকে বোর্ড।—নিজস্ব চিত্র।

ধুলোর মধ্যে চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলায় পড়ে রয়েছে মেয়ো হাসপাতালের সরঞ্জাম। (ডান দিকে) বাইরে ঝাঁ-চকচকে বোর্ড।—নিজস্ব চিত্র।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:২৯
Share: Save:

সিমেন্ট আর বালির পুরু আস্তরণ চতুর্দিকে। পাখির বিষ্ঠা আর ধুলোয় মেঝেতে পা ফেলা দায়। ঘরে ঘরে ডাঁই হয়ে রয়েছে ধুলোভর্তি চেয়ার, ভাঙা ক্লিনিক্যাল টেবিল, হুইলচেয়ার, স্ট্রেচার। সিঁড়ি রাবণের স্বর্গসোপানের মতোই অসমাপ্ত। লিফট বসেনি। রোগীকে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়নি র্যাম্পও।

এই আখাম্বা অ-প্রস্তুত ভবন ‘পরিত্যক্ত’ই পড়ে ছিল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত। কিন্তু আজ, শুক্রবার সেই নড়বড়ে পরিকাঠামো নিয়েই খুলে যাচ্ছে মেয়ো হাসপাতাল! রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের বদান্যতায়। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস হিসেবে তার এই আবির্ভাব! সকাল ৯টা থেকে বেলা ২টো পর্যন্ত মেডিসিন, সার্জারি, আই, ইএনটি, অর্থোপেডিক্স আর পেডিয়াট্রিক্স-এর বহির্বিভাগ চালানো হবে সেখানে।

হাসপাতাল তো খুলছে। কিন্তু এই চূড়ান্ত অপরিচ্ছন্নতার মধ্যে রোগী দেখা হবে কী করে? স্বাস্থ্য পরিষেবার বাকি পরিকাঠামোই বা কোথায়?

মুচকি হেসে এক স্বাস্থ্যকর্তা বললেন, “উদ্বোধনের সময় বাইরের হলঘর একটু সাফসুতরো করে, টেবিলে সাদা কাপড়টাপড় পেতেটেতে ম্যানেজ করে দেওয়া হবে! বাকি ঘরগুলো তালাবন্ধ রাখলেই হল। কারও অত নজরে পড়বে না। তার পরে রোগীরা কতটা ভুগলেন, তা নিয়ে কার আর মাথাব্যথা আছে!”

অর্থাৎ ঠিক তেমনই তঞ্চকতা, মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া বা এমসিআইয়ের পরিদর্শকদের চোখে ধুলো দিতে অন্যান্য মেডিক্যাল কলেজ-হাসপাতালের চেয়ার-টেবিল থেকে শুরু করে শিক্ষক পর্যন্ত ধার করে এনে যে-ভাবে কুমিরছানা দেখানো হয়ে থাকে! এই ব্যাপারে স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা কী বলছেন?

খুব একটা আত্মবিশ্বাস ধরা পড়ছে না স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলায়। বললেন, “পরিকাঠামো তো এখনও অতটা নেই। স্বাস্থ্য ভবনের লোকজন শুক্রবার ওখানে যাক। পরিস্থিতি খতিয়ে দেখুক। ওরা কী প্রস্তাব দেয় দেখি।”

কিন্তু শুক্রবারেই তো বহির্বিভাগ চালু হওয়ার কথা! তা হলে?

“দেখা যাক না, কী হয়,” অনিশ্চিত জবাব সুশান্তবাবুর।

মেয়ো ক্যাম্পাসে পরিকাঠামোর ঘাটতির সীমা-পরিসীমা নেই বলে অভিযোগ। বহির্বিভাগে আসা কোনও রোগীর এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা রক্ত পরীক্ষা করতে হলে তার ব্যবস্থা নেই। তাঁকে ছুটতে হবে মেডিক্যালে। দু’টো ক্যাম্পাসের মধ্যে দূরত্ব অনেকটাই এবং ‘ওয়ানওয়ে’ বা একমুখী রাস্তার ঝামেলা রয়েছে। আর আছে পোস্তার মারাত্মক যানজট। কোনও অ্যাম্বুল্যান্স না-থাকায় বহির্বিভাগের কোনও রোগী গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াও দুষ্কর হবে। এখনও ‘কম্পিউটারাইজড’ টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা হয়নি বলে রোগীদের দাঁড়াতে হবে দীর্ঘ লাইনে। ই-প্রেসক্রিপশনের ব্যবস্থাও হয়নি। মেডিক্যাল থেকে মাত্র এক জন ফার্মাসিস্টকে পাঠানো হচ্ছে। তিনি কী ভাবে অত বহির্বিভাগের রোগীকে ওষুধ দেবেন, কেউ জানেন না।

জানেন না, কারণ মেয়ো হাসপাতালের বহির্বিভাগ চালানোর জন্য আলাদা ভাবে কোনও চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, এমনকী সাফাইকর্মীও নিয়োগ করা হয়নি। উল্টে নির্দেশ জারি করে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের চিকিৎসক-নার্সদের বলা হয়েছে, যে-ভাবে হোক মেয়োর বহির্বিভাগ সামলাতে হবে তাঁদেরই। কোনও টেকনিশিয়ান দেওয়া হয়নি। তাই এক্স-রে, আল্ট্রাসনোগ্রাফি বা রক্তপরীক্ষার মতো জরুরি পরীক্ষানিরীক্ষার বালাই থাকছে না। ব্লাড ব্যাঙ্ক নেই। তাই কোনও রোগীকে রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন দেখা দিলে তা দেওয়া যাবে না। অ্যাম্বুল্যান্স নেই। অর্থাৎ প্রয়োজনে রোগীকে অন্য হাসপাতালেও নিয়ে যাওয়া যাবে না।

এমন নড়বড়ে পরিকাঠামো নিয়ে বহির্বিভাগ চালু করতে গিয়ে চিকিৎসক ও নার্সদের প্রবল আপত্তির মুখে পড়তে হয়েছে স্বাস্থ্যকর্তাদের। হাসপাতালের অন্দরেই ক্ষোভ এমন প্রবল যে, মেয়ো হাসপাতালের প্রশাসকের ভূমিকা নেওয়ার জন্য কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কোনও কর্তাকেই রাজি করাতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর।

এমন আধাখেঁচড়া অবস্থায় তড়িঘড়ি মেয়োর বহির্বিভাগ চালু করা হচ্ছেই বা কেন?

চিকিৎসকদের অভিযোগ, প্রস্তুতি চূড়ান্ত না-হওয়া সত্ত্বেও তৃণমূলের এক চিকিৎসক-বিধায়কের চাপে মেয়ো ক্যাম্পাস চালু করতে বাধ্য হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। এ ভাবে জোড়াতালি দিয়ে ক্যাম্পাস চালু করার প্রতিবাদে গত ২৮ ডিসেম্বর মেডিক্যাল কলেজ কাউন্সিলের বৈঠকে সরব হন কয়েক জন কর্তা এবং প্রবীণ চিকিৎসক। তাঁরা জানান, ওই ক্যাম্পাসের জন্য আলাদা চিকিৎসক ও কর্মীর ব্যবস্থা না-করে পুরো চাপটা মেডিক্যালের ঘাড়ে ফেলা ঠিক নয়। অভিযোগ, শাসক দলের ওই চিকিৎসক-বিধায়ক ধমক দিয়ে তাঁদের চুপ করিয়ে দেন এবং হুকুম দেন, যে-ভাবে হোক ওই বহির্বিভাগ চালু করে দিতেই হবে।

এ ব্যাপারে প্রশ্ন করা হলে মেডিক্যালের অধ্যক্ষ তপনকুমার লাহিড়ী বলেন, “আমি কিছু বলতে পারব না। তবে পরিকাঠামোর খামতি তাড়াতাড়ি দূর করা হবে।” আর শাসক দলের ওই চিকিৎসক-বিধায়ককে বারবার ফোন, এসএমএস করা হলেও তিনি জবাব দেননি।

প্রবীণ শিক্ষক-চিকিৎসকদের বক্তব্য, সর্বাঙ্গীণ প্রস্তুতি ছাড়াই হাসপাতাল চালু করে দিলে একই সঙ্গে বিপাকে পড়বে মেডিক্যাল ও মেয়ো। চিকিৎসক-কর্মী বা সরঞ্জাম ধার দেওয়ায় টানাটানি পড়ে যাবে মেডিক্যালে। আবার যৎসামান্য কর্মী-চিকিৎসক এবং সাজসরঞ্জামের ব্যাপক ঘাটতি নিয়ে কাজ চালাতে হিমশিম খাবে মেয়ো। তুলনায় মেডিক্যাল কলেজেরই সমস্যা বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছেন সেখানকার বহু শিক্ষক-চিকিৎসক। তাঁদের অভিযোগ, এমনিতেই ডাক্তারের অভাবে হাসপাতালের নাভিশ্বাস উঠছে। তার মধ্যেই এ বার থেকে বিভাগীয় শিক্ষক চিকিৎসকদের এক জনকে মেডিক্যালের বহির্বিভাগ সামলাতে হবে। এক জনকে দেখাশোনা করতে হবে ইন্ডোরের। আর এক জনকে সামলাতে হবে লেডি ডাফরিনের বহির্বিভাগ। আবার অন্য এক জনকে মেয়োর বহির্বিভাগ দেখতে হবে।

ওই শিক্ষক-চিকিৎসকদের প্রশ্ন, এর পরে আর মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র পড়াবেন কারা? মেডিক্যাল তো কানা হয়ে যাবে! এমন চললে তো মেডিক্যাল কাউন্সিল যে-১০০ আসন বাতিল করেছে, তা-ও আর কোনও ভাবেই ফেরত আনা যাবে না!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Mayo Hospital parijat bandyopadhyay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE