বসন্তের বৃষ্টিতে শুকনো গরমের অস্বস্তি হয়তো কিছুটা কাটল। কিন্তু এতে মারণ রোগ থেকে বিপদ বাড়ল বই কমলো না।
গরম বেড়ে চলায় সোয়াইন ফ্লু-র বিদায় আসন্ন বলে ধরে নিয়ে স্বস্তিতে ছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। কিন্তু মঙ্গলবার রাত এবং বুধবার ভোরে দফায় দফায় বৃষ্টি ফের তাপমাত্রা কিছুটা কমিয়ে দেওয়ায় এখনই এই মারণ রোগের ভাইরাসের দৌরাত্ম্য কমবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন বিশেষজ্ঞেরা। ফলে আরও বেশ কয়েকটা দিন এই রোগের প্রকোপ থেকে মুক্তি নেই রাজ্যবাসীর।
বিশেষজ্ঞদের মতে, গরম হচ্ছে জীবাণু বা ভাইরাসের যম। তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তাই সোয়াইন ফ্লু পিছু হটবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু বৃষ্টি নামায় গরম হঠাৎ কমে গিয়েছে। পরজীবী-বিশেষজ্ঞ অমিতাভ নন্দী বলেন, “আবহাওয়ার আচমকাই যে-ভাবে বদলে গেল, তাতে আরও কিছু দিন ভোগান্তি রয়েছে। সকলকেই সাবধানে থাকতে হবে। এক বার সংক্রমণ ঘটলে শিশু ও বয়স্কদের ক্ষেত্রে জটিলতার ভয়টা বেশি। তাই তাঁদের বেশি সাবধানে থাকতে হবে।”
জ্বর-সর্দি-কাশি রয়েছে, এমন লোকজন আজ, বৃহস্পতিবার যাতে মোটেই দোল না-খেলেন, সেই ব্যাপারেও সতর্ক করে দিয়েছেন চিকিৎসকেরা। তাঁরা জানাচ্ছেন, যদি ওঁদের কারও মধ্যে সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস থাকে, রং-আবির খেলার ফাঁকে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়বে। দোলের দিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কলেরা অ্যান্ড এন্টেরিক ডিজিজেজ (নাইসেড)-এ সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। ফলে বুধবার অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেক বেশি নমুনা জমা পড়েছে সেখানে। গভীর রাত পর্যন্ত পরীক্ষা চলে। কাল, শুক্রবারেও অন্যান্য দিনের তুলনায় অনেকটাই তাড়াতাড়ি তাঁদের কাজ শুরু হবে বলে জানিয়েছেন নাইসেড-কর্তৃপক্ষ।
রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব মলয় দে জানান, এ দিন ৬৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ২১ জনের শরীরে সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাসের অস্তিত্ব মিলেছে। ওই রোগে আক্রান্ত ৬১ জন রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
বিশেষজ্ঞেরা হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন, যাওয়ার সময় মরণকামড় দিয়ে যেতে পারে সোয়াইন ফ্লু। সেই জন্যই শিশু ও বয়স্কদের নিরাপদে রাখার ব্যাপারে বেশি সচেতন থাকা জরুরি। এন৯৫ মাস্ক এখনও বাজারে সুলভ নয়। কিন্তু পড়ুয়াদের মাস্ক পরে ক্লাসে আসা বাধ্যতামূলক করেছে বিভিন্ন স্কুল। কোনও পড়ুয়ার সামান্য জ্বর হলে বা অল্প সর্দিকাশি থাকলে তাদের যাতে স্কুলে পাঠানো না-হয়, অভিভাবকদের সেই অনুরোধ করেছেন বিভিন্ন স্কুলের কর্তৃপক্ষ। তবে অমিতাভবাবুর বক্তব্য, মাস্ক পরে খুব বেশি সুবিধা না-ও হতে পারে। কারণ, তাতে না-হয় নাক-মুখ ঢাকা গেল। হাত তো খোলাই রইল। “খোলা হাতে যদি ভাইরাস থাকে এবং সেই হাত যদি চোখে লাগে, তা থেকেও শরীরে ঢুকতে পারে রোগ। এ ক্ষেত্রে সামান্য জ্বর হলে কিংবা ঠান্ডা লাগলে বাড়ি থেকে না-বেরোনোই ভাল,” বলছেন পরজীবী-বিশেষজ্ঞ।
নাইসেডের পাশাপাশি বুধবার থেকে পিয়ারলেস হাসপাতালকে সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার অনমুতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। পরিকাঠামো মজুত করে স্বাস্থ্য দফতরে আবেদনপত্র জমা দিয়ে বসে আছে তিনটি হাসপাতাল। কেন তাদেরও ওই রোগ পরীক্ষার অনমুতি দিয়ে মানুষের ভোগান্তি কমানোর চেষ্টা করছে না রাজ্য?
স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা জানান, বেসরকারি হাসপাতালগুলি এমনিতেই সোয়াইন ফ্লু-র রোগীদের কাছ থেকে চিকিৎসা বাবদ নানা খাতে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছে। রোগ নির্ণয়ের ঢালাও ছাড়পত্র দিলে এই প্রবণতা আরও বাড়বে। তাঁর কথায়, “আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতালে সোয়াইন ফ্লু রোগীদের রক্তপরীক্ষা, মূত্রপরীক্ষার জন্যও বেশি টাকা আদায় করা হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সাধারণ ভাবে ওই সব হাসপাতালে কেবিনের যা খরচ, সোয়াইন ফ্লুয়ে আক্রান্ত কেউ ভর্তি হলে তার দ্বিগুণ নেওয়া হচ্ছে। রোগ পরীক্ষার ক্ষেত্রেও যে এমন হবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই।”
প্রশ্ন হল, সরকারি তরফে নজরদারি ব্যবস্থায় গলদ রয়েছে বলেই তো কিছু হাসপাতাল এমন যথেচ্ছাচার করতে পারছে। সেই নজরদারি ব্যবস্থাকে ঢেলে না-সেজে মানুষের ভোগান্তি বাড়ানোর যুক্তি কী? উত্তর দিতে পারেননি স্বাস্থ্য দফতরের কর্তা।
এ দিনও বিধানচন্দ্র রায় শিশু হাসপাতাল, আইডি হাসপাতালে ভিড় জমিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। নমুনা পরীক্ষা করতে করতে নাভিশ্বাস ওঠার জোগাড় নাইসেড-কর্তৃপক্ষের। এর জন্য আত্মসমালোচনাটাই জরুরি বলে মনে করছেন স্বাস্থ্যকর্তাদের একাংশ। তাঁদের মতে, গত বছর পুজোর সময় যখন সোয়াইন ফ্লু রোগীর হদিস পাওয়া গিয়েছিল, তখনই সাবধান হওয়া উচিত ছিল। তা না-করে অনেকেই নিশ্চিন্ত ছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, যা হওয়ার কয়েক বছর আগে হয়ে গিয়েছে। এখন হলে বিক্ষিপ্ত ভাবে হবে। তাতে ভয়ের কিছু নেই। বাস্তবে কিন্তু বিক্ষিপ্ত ভাবে নয়, বড় আকারেই থাবা বসিয়েছে এই রোগ। ভাইরাস-বিশেষজ্ঞদের মতে, সম্ভবত ভাইরাস তার চরিত্র পরিবর্তন করে নতুন কোনও চরিত্র পেয়েছে। আর সেই পরিবর্তিত চরিত্র নিয়েই প্রবল পরাক্রমে ফিরেছে ওই রোগ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy