রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য বিমা যোজনা (আরএসবিওয়াই) প্রকল্পের আওতাধীন তাঁরা। তবু সেই রোগীদের অনেককে বাইরের একাধিক দোকান থেকে ওষুধ কিনতে কিছু চিকিত্সক বাধ্য করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
আরএসবিওয়াইয়ের কার্ড থাকলে দারিদ্রসীমার নীচে থাকা একই পরিবারের ৫ জন সদস্য এক বছরে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত চিকিত্সা নিখরচায় পেতে পারেন। সরকারি হাসপাতালে ভর্তি কোনও রোগীর এই কার্ড থাকলে ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান বা হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ নির্দিষ্ট দোকান থেকে তাঁর ওষুধ নিখরচায় পাওয়ার কথা। কিন্তু কমিশনের লোভে আরজিকর মেডিক্যাল কলেজে বেশ কিছু চিকিত্সক অনেক রোগীকে হাসপাতালের বাইরের কয়েকটি দোকান থেকে নগদ টাকা দিয়ে জোর করে ওষুধ কেনাচ্ছেন বলে গত এক মাসে তিনটি অভিযোগ জমা পড়েছে হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তাদের কাছে।
তিনটিতেই অভিযোগকারী রোগীপক্ষ দাবি করেছে, চিকিত্সকেরা তাঁদের জানিয়েছেন, হাসপাতালের বাইরে ওই নির্দিষ্ট কয়েকটি দোকান থেকে ওষুধ না কিনলে তাঁরা রোগীর চিকিত্সা ভাল করে করবেন না। আরও বলেছেন, ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকান থেকে কেনা ওষুধ খেলে রোগী কোনওদিন সুস্থ হবেন না।
সম্প্রতি মধ্যমগ্রাম সারদাপল্লির বাসিন্দা কৃষ্ণা দে নামে এক রোগীর বাড়ির লোক এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে শুধু অভিযোগ দায়ের করেই থেমে যাননি। তাঁরা চিকিত্সকদের ওই কাজের প্রতিবাদে রোগিণীকে জোর করে বন্ড দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। অভিযোগ জমা দেন স্বাস্থ্য ভবনেও। এর পরেই আরএসবিওয়াইয়ের রোগীদের নিয়ম ভেঙে বাইরে থেকে ওষুধ কেনানোর অভিযোগে মঙ্গলবার, ৩ ফেব্রুয়ারি তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন আরজিকরের সুপার প্রবীর মুখোপাধ্যায়। মেডিসিন বিভাগের প্রধান অপূর্ব মুখোপাধ্যায় তদন্ত করছেন। সুপার প্রবীরবাবুর কথায়, “গত এক বছরে আরএসবিওয়াইয়ের রোগীদের চিকিত্সা বাবদ হাসপাতালের প্রায় দেড় কোটি টাকা আয় হয়েছে। এখন যদি হাসপাতালের দুর্নাম ছড়ায়, তা হলে কার্ডধারী রোগীরা আরজিকরকে এড়িয়ে যাবে। হাসপাতালের আয়ও অনেক কমে যাবে।”
মঙ্গলবার কলেজ কাউন্সিলের বৈঠকেও বিষয়টি তোলেন হাসপাতালের অচিকিত্সক প্রশাসনিক কর্তারা। হাসপাতাল সূত্রে খবর, বিভিন্ন বিভাগীয় চিকিত্সকদের উপস্থিতিতেই তাঁরা জানান, মেডিসিন ও অর্থোপেডিক্স থেকে সবচেয়ে বেশি এ রকম অভিযোগ আসছে। বার বার বিভাগের চিকিত্সকদের জানিয়েও কোনও ফল হচ্ছে না। হাসপাতালের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুপার তথা আরএসবিওয়াইয়ের নোডাল অফিসার অরুণ চক্রবর্তী জানিয়েছেন, আরএসবিওয়াই-এর কার্ডধারী রোগীদের সুবিধা দিতে আরজিকর-এ হলুদ রঙের প্রেসক্রিপশন চালু হয়েছে। তা ন্যায্যমূল্যের ওষুধের দোকানে নিয়ে গেলেই দোকানের লোক বুঝবেন যে এঁর কার্ড রয়েছে। এবং তাঁর থেকে টাকা নেবেন না। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, অনেক চিকিত্সক আরএসবিওয়াইয়ের রোগীদের এই হলুদ প্রেসক্রিপশন দিতে চাইছেন না। বদলে একটুকরো কাগজে কয়েকটা ওষুধের নাম লিখে দিচ্ছেন। আর মুখে-মুখেআরজিকরের উল্টোদিকের ও শ্যামবাজারের কয়েকটি ওষুধের দোকানের নাম বলে দিচ্ছেন। রোগীর বাড়ির লোককে সেখান থেকে ওষুধ কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে।
যেমন কৃষ্ণা দে-র ছেলে রতন অভিযোগ করেছেন, মস্তিষ্কের যক্ষ্মায় আক্রান্ত তাঁর মা-কে গত ১৯ জানুয়ারি আরজিকরের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি করেন। ২১ তারিখ আরএসবিওয়াইয়ের কার্ডও হাসপাতালে দাখিল করেন। তা সত্ত্বেও মেডিসিনের একাধিক চিকিত্সক পাঁচ দফায় শ্যামবাজারের দু’টি দোকান থেকে তাঁকে ১৬০০ টাকার ওষুধ কিনিয়েছেন। আর খরচ করতে না পেরে ওষুধ কেনার বিল-সহ লিখিত অভিযোগ জমা দিয়ে রতনবাবু বন্ড দিয়ে মা-কে হাসপাতাল থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। সপ্তাহখানেক আগে একই রকম অভিযোগ জমা করেছেন বিরাটি-র বাসিন্দা অনুপ সাহা-র ছেলে সীমান্ত সাহা। তাঁরও বক্তব্য ছিল, অর্থোপেডিক্স বিভাগের চিকিত্সকেরা বাইরে থেকে ওষুধ কিনিয়েছেন। প্রতিবাদ করলে ‘বাবাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান, কোনও চিকিত্সা করা হবে না’ বলে হুমকিও দেন।
মেডিসিন বিভাগের প্রধান অপূর্ব মুখোপাধ্যায় ও অর্থোপেডিক্সের প্রধান দিলীপ পাল দু’জনেই জানান, সমস্যাটা মূলত ইন্টার্ন, আরএমওদের মতো জুনিয়র ডাক্তারদের নিয়ে। তাঁরাই বাইরে থেকে ওষুধ কেনাচ্ছেন বলে অভিযোগ। দুপুর ২টোর পরে হাসপাতাল পুরোপুরি তাঁদের হাতে চলে যায়। তাঁরা কে, কোথায় কী করছেন বিভাগীয় প্রধানেরা বুঝতেও পারেন না। কিন্তু এত অভিযোগ পাওয়ার পরেও দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি না দিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে জানান তাঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy