শঙ্করপুর মৎস্যখটিতে চলছে শুকনো মাছ বাছাইয়ের কাজ। সোহম গুহ-র তোলা ছবি।
বিপুল চাহিদা সত্বেও কদর কমছে এলাকার শুঁটকি মাছের। কারণ খুঁজে বের করে ওই ব্যবসার সঙ্গে যুক্তদের দিশা দেখাতে সম্প্রতি কর্মশালা হল কাঁথির মৎস্য দফতরের মীনভবনে।
হঠাৎ কেন সঙ্কট তৈরি হল?
দু’দিনের আলোচনায় মূল সঙ্কটকে চিহ্নিত করা হল এই ভাবে ‘শুঁটকি মাছ উৎপাদনে এ রাজ্যে ব্যাপক হারে রাসায়নিক সার এমনকী বিষাক্ত কীটনাশক ব্যবহৃত হচ্ছে।’ চিকিৎসক থেকে বিশেষজ্ঞদের অভিমত, যা খেলে সাধারণ মানুষের গ্যাসট্রাইটিস, গ্যাসট্রিক আলসার, স্নায়ুর রোগ-সহ নানা সমস্যা হতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে বিশ্বে শুঁটকি মাছের বাজার থাকলেও রাজ্যের রাসায়নিক ও কীটনাশক মিশ্রিত শুঁটকিমাছ ব্রাত্য হয়ে পড়ছে। উদ্বিগ্ন রাজ্য মৎস্য দফতর ও কেন্দ্রীয় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রকও। সেই প্রেক্ষিতেই এই কর্মশালা বলে মৎস্য দফতর সূত্রে খবর। শুঁটকি মাছ উৎপাদনে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে বিশ্ববাজারে তা বিপণন কেমন ভাবে করা যায়, তা নিয়ে কাঁথিতে কেন্দ্রের বাণিজ্য মন্ত্রকের অধীনস্থ সামুদ্রিক পণ্য রফতানি সংস্থার ‘নেটফিশ’ ও রাজ্য মৎস্য দফতরের উদ্যোগে ওই কর্মশালা হয়। সেখানে পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়াও দুই ২৪ পরগনা ও প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশার শুটকি উৎপাদক ও রফতানিকারী সংস্থার ৭৫ জন প্রতিনিধি এবং নেটফিশ ও রাজ্য মৎস্য দফতরের কর্তারা ছিলেন।
কর্মশালার শুরুতে নেটফিশের রাজ্য সঞ্চালক অতনু রায় পরিসংখ্যান তুলে বলেন, “এপ্রিল ’১৪ থেকে ডিসেম্বর ’১৪ পর্যন্ত রাজ্যের ৪,৫১০.০৯ মেট্রিক টন শুঁটকি মাছ বিদেশে রফতানি হয়েছে। যার মূল্য প্রায় ৮৬৪৮.৬৬ লক্ষ টাকা। এই টাকার পরিমাণ অবশ্য বিগত বছরগুলির তুলনায় কম।” তাঁর মতে, “এর প্রধান কারণ শুঁটকিমাছ উৎপাদকরা কাঁচামাছ শুকনো করার সময় দ্রুত শুকানো করতে ও মাছের পচন ঠেকাতে ব্যবসায়িক স্বার্থে বিভিন্ন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করছেন। ফলে মাছের গুণগত মানের ঘাটতি হওয়া ছাড়াও তা বিষ হয়ে উঠছে!”
এ রাজ্যের জুনপুট, দিঘা, শঙ্করপুর, জলধা, বগুরান, জালপাই, শৌলা, শঙ্করপুর, দাদনপাত্রবাড়, কাকদ্বীপ ও ডায়মন্ড হারবারে রাজ্যের সিংহভাগ শুঁটকি মাছ উৎপাদিত হয়। অভিযোগ, এখানকার শুঁটকিমাছ উৎপাদক মৎস্যজীবীরা তাড়াতাড়ি মাছ শুকনো করার জন্য এবং মাছের পচন ঠেকাতে কাঁচা মাছে মেটাসিড, ফর্মালিন, বিএইচসি ৫০, সাইপার মাইথিন, এন্ডোসালফার, ক্লোরোপাইরিফস এমনকি গ্যামাস্কিন পর্যন্ত ব্যবহার করছেন! তা কার্যত মেনেও নিয়েছেন বহু মৎস্যজীবী।
তাঁদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, রাসায়নিক কিংবা কীটনাশকের ব্যবহারে সাশ্রয় হয়। মাছের ভাল দামও মেলে। কেমন? রিবন ফিস বা পাটিয়ার শুঁটকি কিলোগ্রাম প্রতি দাম ৭৫ টাকা, লোটে ১৪০-১৫০, ভোলা ১৫০ টাকা। এক কিলোগ্রাম কাঁচা ভোলা মাছ শুকালে ৩০০ গ্রাম পাওয়া যায়। সাধারণ ভাবে মাছ শুকাতে মাস খানেক সময় লাগে। তবে চড়া রোদ থাকা আবশ্যিক। কিন্তু, রাসয়নিক দিলে তিন সপ্তাহের মধ্যে মাছ শুকনো হয়ে যায়। বরং পোকা ধরে না, উজ্জ্বল্য থাকে। এক মৎস্যজীবীর কথায়, “এলাকার অনেক অসাধু ব্যবসায়ীই এমনটা করেন।”
কাঁথি মহকুমার জুনপুট, দাদনপাত্রবাড়, জলধা, বগুড়ান জলপাই, শৌলা-সহ মহকুমার উপকুলের বিয়াল্লিশটি খটির অধিকাংশতেই শুঁটকি মাছ তৈরিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মেনেছেন কাঁথি কেন্দ্রীয় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি তথা কাঁথি মহকুমা খটি মৎস্যজীবী উন্নয়ন সমিতির সম্পাদক লক্ষ্মীনারায়ণ জানা। তাঁর কথায়, “দ্রুত মাছ শুকোতে ও পচন ঠেকিয়ে মাছের উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দাম বাড়াতে উপকূলের গরীব মৎস্যজীবীরা কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর পাল্লায় পড়ে নানা বিষাক্ত কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন। এই প্রবণতা বিপজ্জনক।”
কর্মশালায় উপস্থিত মৎস্য দফতরের উপ মৎস্য অধিকর্তা (পশ্চিমাঞ্চল) উৎপলকান্তি সরও শুঁটকি মাছে কীটনাশকের ব্যবহারের কথা মানছেন। তিনি বলেন, “এই পরিস্থিতিতে শুঁটকি মাছ উৎপাদন নিয়ে চিন্তাভাবনা করা দরকার। তা ছাড়া রফতানির সময়ে আধুনিক প্যাকেজিংয়ের ব্যবস্থাও জরুরি। না হলে রাজ্যের মৎস্যজীবীরা সঙ্কটে পড়বেন।” তাঁর কথায়, এমনিতেই বতর্মানে সমুদ্রে মাছের আকাল চলছে। মৎস্যজীবীরাও সমুদ্র থেকে আগের মত সামুদ্রিক মাছ সংগ্রহ করতে পারছেন না। বিকল্প হিসেবে উপকূল ভাগের মৎস্যজীবীরা এখন শুঁটকি মাছের দিকে ঝুঁকছেন।
সমাধান কী ভাবে সম্ভব?
শিবিরে উপস্থিত বিশেষজ্ঞেরা জানালেন, সবার আগে কীটনাশক, রাসায়নিকের ব্যবহার পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। বাড়াতে হবে মাছ শুকোনোর যন্ত্র (ফিস ড্রায়ার)-এর ব্যবহার। যে খটিতে বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, সেখানে সৌর বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হবে। মাছ শুকনো করতে মাচার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। এখন অবশ্য কোথাও কোথাও পুরোটাই রোদে শুকনো করা হয়। কোথাও মাচা বেধে, কোথাও বালুয়ায়িতে বিছিয়ে দেওয়া হয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy