সাহিত্যিকের কথায়, অন্ধকার জমাট বেঁধে তৈরি হয় ভয়। আর মনস্তাত্ত্বিকরা বলেন, ভয় জমতে জমতে তৈরি হয় উদ্বেগ। আর বহু দিনের উদ্বেগই জন্ম দেয় ব্যাধির। পারিভাষিক নাম, পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (পিটিএসডি)। অর্থাত্, বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক ক্ষত। গবেষণায় বদলে গেল এই মানসিক ব্যাধির ঠিকুজিও। এত দিন পর্যন্ত মনে করা হতো, ৪৯০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে প্রথম এই রোগের হদিস মেলে। কিন্তু ব্রিটেনের অ্যাঞ্জিলা রাসকিন ইউনিভার্সিটির গবেষকরা সম্প্রতি জানিয়েছেন, এ রোগের শিকড় ৩ হাজার বছরেরও পুরনো। তাঁদের দাবি, মেসোপটেমিয়া সভ্যতার সমসাময়িক ইরাকি সেনারাই প্রথম এই রোগের শিকার। তবে এর মূলে যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যুদ্ধভীতি, তা নিয়ে সংশয় নেই কোনও মহলেই।
৪৯০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে গ্রিস এবং পারস্যের মধ্যে যে যুদ্ধ হয়, ইতিহাসে তা ‘ম্যারাথনের যুদ্ধ’ নামেই পরিচিত। ম্যারাথনের মাঠে সে বার পার্সিদের হারালেও, মনস্তাত্ত্বিকদের দাবি, এর পরেই পিটিএসডি-র শিকার হন আথেন্সের যোদ্ধা এপিজেলুস। কেউ তাঁকে স্পর্শও করেনি, তবু নাকি দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছিলেন সেই বীর যোদ্ধা। গ্রিক ইতিহাসবিদ হেরাডোটাসের সূত্র ধরেই এত দিন পর্যন্ত মনে করা হতো, গ্রিক যোদ্ধাদের মধ্যেই প্রথম এই রোগের অস্তিত্ব মেলে। সম্প্রতি সেই দাবি নস্যাত্ করে এক দল ব্রিটিশ গবেষক দাবি করলেন, একের পর এক শত্রুদেশের সঙ্গে যুদ্ধের কারণে ১৩০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দে আসিরিয়া রাজত্বে ইরাকের যোদ্ধারাই প্রথম এই রোগের শিকার হন। যুদ্ধ-পরবর্তী একটা দীর্ঘ সময় জুড়ে দেশের যোদ্ধা এবং সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে মানসিক অস্থিরতা লক্ষ করা গিয়েছিল বলে ইতিহাসে উল্লেখও মেলে। তবু একটা দীর্ঘ সময় এই রোগের লক্ষণ নিয়ে সে ভাবে কোনও গবেষণা হয়নি। এমনকী এমনটাও মনে করা হতো, যুদ্ধে নিহত শত্রুর প্রেতাত্মারাই নাকি যাবতীয় বিপত্তি ঘটাচ্ছে। কিন্তু আধুনিক গবেষকরা এরই মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন পিটিএসডি-র লক্ষণ।
মনস্তত্ত্ববিদদের মতে, এই রোগ মূলত বিপর্যয়-পরবর্তী মানসিক ক্ষত। প্রাকৃতিক কিংবা মানুষের দ্বারা ঘটানোর বিপর্যয়ের পর মানুষের মনে যে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত তৈরি হয়, তা-ই পিটিএসডি। ব্রিটিশ গবেষকদের দাবি, সে সময় বছরে অন্তত তিন বার করে যুদ্ধে যেতে হত ইরাকি যোদ্ধাদের। সেখান থেকেই তৈরি হয় যুদ্ধভীতি। ধারাবাহিক রক্ত-অস্ত্র-মৃত্যু-লাশ আর সভ্যতা ধ্বংসের ছবি যোদ্ধাদের মনে গভীর ছাপ ফেলে। যুদ্ধের ময়দানে হয়তো সাহসী যোদ্ধা, কিন্তু ভেতরে মৃত্যুভয় কুরে কুরে খাচ্ছে— গবেষকদের দাবি, এ ভাবেই গোটা একটা পুরুষ প্রজন্ম এই রোগের শিকার হয় প্রাচীন ইরাকে।
আধুনিক চিকিত্সাবিজ্ঞানে যে শারীরিক ক্ষত খুব সহজেই সারিয়ে তোলা যায়, আজ থেকে ৩ হাজার বছর আগে তা সম্ভব ছিল না। গবেষকদের দাবি, সে সময় ইরাকি যোদ্ধাদের মধ্যে মৃত্যুভয়-জনিত পিটিএসডি ছড়িয়ে পড়ার এটাও একটা বড় কারণ।
‘নাথিং নিউ আন্ডার দ্য সান: পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ নামে সম্প্রতি প্রকাশিত এই গবেষণাধর্মী প্রতিবেদনে যুদ্ধ ও মানবসভ্যতার ইতিহাস ঘিরে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে। গবেষকদের দাবি, যুদ্ধের আগুন আজ বিশ্ব জুড়ে। কিন্তু ইতিহাস বলছে, অতীতেও যুদ্ধের শুধু কুফলই ভোগ করেছে মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy