মাত্র পাঁচ বছর বয়সে পিতৃহীন হয়েছিল ছেলেটি। বাবার কাপড়ের ব্যবসা ছিল। সেও খুব বড় কিছু নয়। চূড়ান্ত আর্থিক অনটনের মধ্যে বড় হয়েছিলেন মতিলাল শীল। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন বুদ্ধিমান এবং করিৎকর্মা। ১৮১৫ নাগাদ তিনি ফোর্ট উইলিয়ামে কাজে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ সৈন্যদের প্রয়োজনীয় জিনিস সরবরাহ করার বরাত পান। এরপর নিজ ক্ষমতা আর বুদ্ধিবলে আস্তে আস্তে উন্নতি করতে থাকেন। নীল, চিনি, কাপড়, চাল এই সব চেনার এবং পরখ করার ক্ষমতার জন্য তৎকালীন বেশ কিছু এজেন্সি তাঁকে ‘বেনিয়ান’ হিসাবে নিয়োগ করেন। ইতিহাসবিদদের মতে এমন কোনও ব্যবসা সেই সময় খুঁজে পাওয়া মুশকিল ছিল যাতে মতিলাল শীল বিনিয়োগ করেননি। তবে তাঁর শ্রেষ্ঠ কীর্তি বোধহয় সমাজ সংস্কার। তখনবিধবা বিবাহ এবং সতীদাহ নিয়ে উত্তাল ছিল বাংলা। রাধাকান্ত দেব এবং রামমোহন রায়ের দলের মধ্যে যখন চূড়ান্ত আদর্শগত বিরোধ চলছে। সেই সময় নিজে ধর্মসভার সদস্য হওয়া সত্ত্বেও বিধবা বিবাহের উপযোগিতা নিয়ে সরব হয়েছিলেন তিনি। কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের উন্নতিকল্পে মতিলাল শীল ১২ হাজার টাকা দান করেন। তাঁর নামে হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডের নাম হয় মতিলাল শীল ওয়ার্ড। হাওড়া, কলকাতা, বাগনান, মেদিনীপু্র, বাংলাদেশ, ভাগলপুর— এমন বেশ কিছু জায়গায় জমিদারি কেনার পর মতিলাল শীল দুর্গাপুজো শুরু করার সিদ্ধান্ত নেন।
পুজো শুরুর বিষয়টি নিয়ে একটি গল্প প্রচলিত আছে। সেই সময় শোভাবাজার রাজবাড়িতে ধূমধাম করে পুজো হয়। কিন্তু সেই পুজোয় শুধুমাত্র সাহেব সুবো আর সমাজের উচ্চবর্গীয় মানুষের প্রাধান্য। সাধারণ মানুষের বিশেষ জায়গা নেই সেখানে। মতিলাল শীল তাঁর এক প্রজার মুখে এই ঘটনার কথা শুনে ঠিক করলেন তিনি নিজে দুর্গাপুজো শুরু করবেন আর এমনভাবে পুজো করবেন যাতে সব মানুষ সেই পুজোয় অংশ নিতে পারেন। মেডিক্যাল কলেজের কাছে কলুটোলা অঞ্চলে তার নিজের বাড়িতে কিছুদিনের মধ্যেই পুজো শুরু করলেন তিনি। সত্যি সত্যিই সে এক দেখার মতো পুজো হল। সেই পুজো ১৯৬ বছরে পা দিচ্ছে এবার।
এখন বাড়ির পুজোর দায়িত্বে রয়েছেন মল্লিকরা। মতিলাল শীলের মূল বসতবাড়ির পড়েছিল তাঁর ছোটছেলে কানাইলাল শীলের ভাগে। তার পুত্র গোপাললালের কোনও সন্তান না থাকায় ভাগ্নেরা এই বাড়ি পান। তাঁরাই বর্তমানে পালা করে পুজো করেন। উল্টোরথের দিন কাঠামো পুজো হয়। আশ্বিনের শুক্লা প্রতিপদ তিথিতে পুজো শুরু হয়। পাঁচজন ব্রাহ্মণ আসেন এদিন। একজন চণ্ডীপাঠ করেন। ষষ্ঠী থেকে শুরু হয় দেবীর আরাধনা। সপ্তমীর দিন সকালে মতিলাল শীল ঘাটে কলাবৌ স্নানের পর বাড়ির কুলদেবতা লক্ষ্মী নারায়ণ মূর্তিকে ঠাকুরদালানে নিয়ে আসা হয়। পুজো চলাকালীন তিনি নীচেই থাকেন। ঠাকুরের শয়ন হয় না। অষ্টমীর দিন সকালে বাড়ির মেয়েরা ঠাকুরের সামনে ধুনো পোড়ান। সন্ধিপুজোয় ঠাকুরের সামনে দেওয়া হয় একমন চালের নৈবেদ্য। কোনও পাত্রে নয়, মাটিতে কলাপাতা পেতে তার ওপর নৈবেদ্য দিয়ে চারিদিকে মালসা সাজিয়ে দেওয়া হয়। বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। এই বাড়িতে বলি হয় না। তবে আখ, ছাঁচিকুমরো, বাতাবি লেবু বলির জন্য সাজিয়ে পুজোর সময়ে ঠাকুরদালানে দিয়ে দেওয়া হয়। শীল বাড়িতে অন্নভোগ হয় না, লুচি ভোগ হয়। পঞ্চমীর দিন থেকে ভিয়েন বসিয়ে দরবেশ, লেডিকেনি, মালপোয়া, গজা, নারকেল নাড়ু আর নোনতার মধ্যে কচুরি, সিঙ্গারা, নিমকি দেওয়া হয়। পুজোর প্রতিদিন ২৮ কিলো করে নৈবেদ্য ভোগ হয়। ২৮টি পাত্রে একমন করে চাল কলা মিষ্টি-সহ নৈবেদ্য সাজিয়ে দেওয়া হয়।
আগে এই বাড়িতে ষষ্ঠীর দিন কীর্তন হত। সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী এই তিনদিন যাত্রা হত। নিমাই সন্ন্যাস খুবই জনপ্রিয় যাত্রাপালা ছিল সেই সময়। প্রায় প্রত্যেক পুজোতেই নিমাই সন্ন্যাস হত। এছাড়াও ঠাকুরদালানের উল্টোদিকে দোতলায় ছিল বিরাট নাচঘর। পুজোর সময় বাইনাচও হত নিয়মিত। রাইচাঁদ বড়াল ছিলেন এই পরিবারের বিশেষ বন্ধু। সেই সময়ের বহু নামী গায়িকা, নর্তকী তাঁর চেনাজানার সুবাদে এই বাড়িতে অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন।এখন অবশ্য নাচঘরের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শীল বাড়ির মেয়েরা পুজোর যাবতীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতেন বরাবরই। বাড়ির প্রবীণ সদস্য অমর মল্লিক স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, অন্যান্য বনেদি বাড়ির তুলনায় অনেকটাই উদার আবহাওয়া ছিল কলুটোলা লেনের এই বাড়িতে। ঠাকুর দালানের সামনের উঠোনে অনুষ্ঠান হত। মেয়েরা দালানের ভিতরে সরে গিয়ে বা দোতলায় বসে অনুষ্ঠান দেখতেন। পর্দার অত কড়াকড়ি ছিল না। শীল বাড়ির মেয়েরা নানারকম কায়দার আর ডিজাইনের গয়না পরতেন। এর মধ্য নথ আর মল প্রধান। শীল বাড়ির বউ হলে আজও এই দু’টি পরতেই হয়। আগে নবমীর দিন দেখার মতো ব্রাহ্মণ বিদায় হত এই বাড়িতে। সেই দিন দেড়শো দু’শো জন ব্রাহ্মণকে নানা দানসামগ্রী, সুপুড়ি আর টাকা দিয়ে ব্রাহ্মণ বিদায় করা হত। এখন দশ-বারো জন মাত্র ব্রাহ্মণ আসেন ব্রাক্ষণ বিদায়ের জন্য। এই বাড়িতে সিঁদুর খেলায় ঘটা হয় না। ঠাকুরের পায়ে সিঁদুর ছুইয়ে সেই সিঁদুর মাথায় দেন এয়োরা। তবে ঠাকুর বরণ দুই বার হয় এই বাড়িতে। প্রথম দফায় যাঁদের এই বছর পালা ছিল তাঁরা এবং অন্যান্যরা ঠাকুর বরণ করেন। দ্বিতীয় দফায় আগামী বছর যাঁদের পালা থাকবে তাঁরা পান, সুপাড়ি দিয়ে ঠাকুরকে আগাম আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখেন।
আরও পড়ুন: পুজোয় কিনুন এই স্মার্ট স্কুটি, দাম মাত্র...
আগে ৪০ জন বাহক কাঁধে করে ঠাকুর নিয়ে গঙ্গায় যেতেন বিসর্জনের জন্য। ’৪৬-এর দাঙ্গা সেই নিয়ম পাল্টে দিয়েছে। দাঙ্গার বছর বাড়ির মূল দরজা বন্ধ রেখে বাইরে সশস্ত্র পুলিশ বসিয়ে পুজো সম্পন্ন করা হয়েছিল বটে কিন্তু ঠাকুর আর কাঁধে করে পাঠানো যায়নি গঙ্গায়। জোড়া নৌকোও এখন আর আসে না বিসর্জনের জন্য। মতিলাল শীল ঘাটে একচালার মাতৃমূর্তি, সাদা সিংহ যখন তলিয়ে যায় ব্রিজের ওপরে দাঁড়িয়ে ঠাকুর বিসর্জন দেখার কথা মনে পড়ে প্রবীণদের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy