Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

প্রবাসে ইলিশের বশে

জলের রুপোলি এই শস্যটির মায়াটান বঙ্গের বাইরে দেশের রাজধানীতে আজও একই রকম মোহময়। লিখছেন অগ্নি রায়জলের রুপোলি এই শস্যটির মায়াটান বঙ্গের বাইরে দেশের রাজধানীতে আজও একই রকম মোহময়। লিখছেন অগ্নি রায়

শেষ আপডেট: ১৯ অগস্ট ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

সিন্ধুপ্রদেশ বিজয় করে দিল্লি ফিরছেন মহম্মদ বিন তুঘলক। নদীপথে। হঠাৎই খামখেয়ালি সুলতানের ইচ্ছা হল মাছ খাওয়ার। তুঘলকী ইচ্ছা বলে কথা! বিরাট বিরাট জাল পড়ল জলে। উঠতে থাকল মাছ। অ্যায়সান খেতে লাগলেন বাদশা যে কালক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়লেন তিনি। পথিমধ্যে মৃত্যু।

ঐতিহাসিক প্রসিদ্ধি না পেলেও লোকমুখে কালবাহিত হয়েছে এই কিস্যা। কিন্তু জানা যায়নি, কী ছিল সেই মাছ, যার গভীর সম্মোহনে জীবনকেও একরকম বাজি রেখেছিলেন তুঘলক। সঠিক জানা না গেলেও মোক্ষম আন্দাজ কিন্তু করেছিলেন একমেবাদ্বিতীয়ম সৈয়দ মুজতবা আলি! লিখেছিলেন, অন্য কিছু নয়। নির্ঘাত ইলিশেই মজেছিল সুলতানের মন। সুরসিক সাহিত্যিকের মতে, ইলিশের টান এমনই যে বাহ্যজ্ঞান থাকে না। আর সেখানে হরিপদ কেরানি থেকে বাদশা— সকলেই একই রকম বিবশ!

জলের রুপোলী এই শস্যটির মায়াটান বঙ্গের বাইরে দেশের রাজধানীতে আজও একই রকম মোহময়। আর তাই, কালোজিরে আর সর্ষের মতোই ইলিশের সঙ্গে অবলীলায় মিশে গিয়েছে প্রবাসী নস্টালজিয়া, বঙ্গ কৌলিন্য, সামাজিক শিকড়, সাংস্কৃতিক চিহ্ন, বিভিন্ন মিথ, দরাদরি, ক্রমশ নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার হতাশা। তাকে ঘিরে দিল্লির বঙ্গজীবনের থার্মোমিটারের পারা উথালপাথাল করে প্রতি বর্ষায়।

‘‘দিল্লির ইলিশ-সংস্কৃতিকে বুঝতে হলে এখানকার বঙ্গযাপনের ইতিহাসকেও কিন্তু বুঝতে হবে আপনাকে। কারণ শেষ বিচারে এই দু’টো তো আলাদা কিছু নয়!’’ জানাচ্ছেন দিলীপ ফৌজদার। চাকরি সূত্রে তাঁর দিল্লি-যাপনের বয়স চার দশক ছুঁতে চলেছে। রাষ্ট্রপূঞ্জ এবং ডেনমার্ক সরকারের সঙ্গে দীর্ঘ দিন জলবিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার পর এখন তাঁর অবসরের অনেকটা সময়ই নিয়ে নেয় মাছের বাজার। দিলীপবাবুর কথায়, ‘‘প্রবাসে ইলিশ বাঙালিত্বের একটি লক্ষণ। একটা মর্যাদাবোধও যেন জড়িয়ে রয়েছে ইলিশের সঙ্গে। যাকে আত্মাভিমানও বলা চলে। সেই গোড়া থেকেই।’’

গোড়া থেকেই? সে তো আজকের কথা নয়। তখন সবেমাত্র সরোজিনী নগর, করোলবাগ তার জীবন শুরু করেছে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগন্তুক সিন্ধ্রি পঞ্জাবিদের বাঁচবার তাগিদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তখন বসন্তের রোদে সস্তার তরকারি আর ছিটকাপড় বিক্রি করে আজকের ধনী দিল্লিবাসীদের পূর্ব প্রজন্মের নির্বাহ শুরু। স্বাধীনতার বয়স তখনও চার পার হয়নি। শাহি দিল্লির শুখাবাতাসে স্বপ্নের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে গোয়ালন্দ ঘাটে স্টিমারের ভোঁ-এর শব্দ। ইলিশের ঘ্রাণ। দেশ ছেড়ে আসার টাটকা হেমারেজ। এক দিকে সাহেবি দিল্লি (লুটিয়ান), অন্য দিকে মুসলমানী পুরনো দিল্লির মাঝে ছড়িয়ে গিয়েছিল বাঙালি। সে সময়ে গোলমার্কেটে বসানো হয়েছিল মাছের বাজার। দিলীপবাবু স্মৃতিতে ডুব দিয়ে জানাচ্ছেন, ‘‘তখন কিন্তু কলকাতা থেকে গঙ্গার মাছ আনার ব্যবস্থা ছিল না। বিমানে উড়িয়ে আনার তো প্রশ্নই নেই। রেলেও বরফবন্দি করে আনার সুব্যবস্থা ছিল না।’’ কিন্তু তখনও বাঙালির পাতে ইলিশ পড়ত। কী ভাবে? ‘‘ইলাহাবাদের ইলিশ এখানকার বাজারে তখন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতো। ডিম পাড়ার সময় ইলিশ বেশি নোনতার পরিবর্তে কম নোনতা জল খোঁজে। আর সেই খোঁজেই তাদের ঝাঁক বেঁধে ইলাহাবাদের গঙ্গা পর্যন্ত আসা। ইলাহাবাদের গঙ্গা থেকে অনেক সময়েই ফিরে যেতে পারত না সেই ঝাঁক। ধরা পড়ে যেত।’’ সেই ইলিশে স্বাদ থাকলেও গন্ধ ছিল না বিলকুল— সেটা দিলীপবাবুর মতো আরও অনেক পক্ককেশ প্রবীণেরই মতো।

নস্টালজিয়া ছেড়ে পারাপার করা যাক বেশ কিছু দশক। আজকের যোজনান্তর উড়ালপুল, আট লেনে বিন্যস্ত হাইওয়ে, স্টেট অফ দ্য আর্ট পার্কিং প্লাজা খচিত দিল্লির ‘মীন’ বাজারে এসে যদি দাঁড়াই? পিৎজা, সুসি আর শাওরমা-য় অভ্যস্ত, বাংলা ভুলে যাওয়া নতুন প্রজন্মের মুখোপাধ্যায়-দাশগুপ্ত-দত্ত-সেনদের ভিড়ে যদি মিশে যাওয়া যায়? ‘‘ইলিশ আছে এবং থাকবে’, জানাচ্ছেন অনুমিত্রা ঘোষদস্তিদার। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাবিজ্ঞানের পাঠ শেষ করার পাশাপাশি হাত পাকিয়েছিলেন রন্ধনবিজ্ঞানেও। আর তারই জেরে সিরিফোর্ট অডিটোরিয়ামের কাছে খুলেছেন ‘বিগ বঙ্গ থিওরি’। নতুন প্রজন্মের পছন্দসই (যেখানে অবাঙালিদের ভিড়ই বেশি) বাংলা খাবারের থিম রেস্তোরাঁ। জ্যাজ আর ব্লুজের সাউন্ড এফেক্টের মধ্যে চেটেপুটে চলছে ইলিশচর্চা। ‘‘মজার ব্যাপার হল, পঞ্জাবি, জাঠ, রাজস্থানীরাও ইলিশে আসক্ত হচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা প্রথমে বুঝতে পারেন না, কাঁটা ম্যানেজ করবেন কী করে! আমরা যেটা করি, পরিবেশনের আগে বোন স্ট্রাকচারটা বুঝিয়ে দিই।’’ আর এই ‘হাড়ের কাঠামো’ বোঝানোর ঠেলায় যে গাদা-র পিস বিক্রি কমে যাচ্ছে সেটাও জানাচ্ছেন অনুমিত্রা। বলছেন, ‘‘পেটিই বেশি খাওয়ানো হয় অবাঙালিদের। কারণ, গাদার বোন স্ট্রাকচার বোঝানো বেশ কঠিন! অল্পবয়সী বাঙালিদেরও একই দশা।’’

তবে গাদাই হোক বা পেটি, প্রবাসী বাঙালির নতুন প্রজন্ম যে ইলিশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়নি তার অন্যতম কারণ হল, ছোট থেকে প্রবহমান পারিবারিক ইলিশাড্ডা! ইলিশ সংস্কৃতি! ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের সম্পাদকের পদে দীর্ঘ দিন ধরে দিল্লিতে রয়ে গিয়েছেন অরুণ চক্রবর্তী। এখন চাকরির দিন শেষ। এই খাদ্যরসিক মানুষটির কথায়, ‘‘পশ্চিমবাংলার বাইরে বাঙালি কৌলিন্যের সর্বশেষ চিহ্ন ধরা রয়েছে এই ইলিশমাছে। ইলিশ তো শুধু খাওয়ার নয়, গর্ব করার এবং গল্প করার বিষয়ও বটে। তা সে যে আড্ডাই হোক না কেন। বাজারে যা দাম তাতে হয়তো আমি মাছটা কিনতে পারছি না। কিন্তু দেখে এসে প্রতিবেশী বন্ধুদের সঙ্গে ইলিশের দাম নিয়ে কথা বলাটাও কিন্তু খুবই সুস্বাদু!’’ তাঁর টিপ্পনি, প্রবাসী জামাই ইলিশ মাছের ভাপা খেতে ভালবাসে, এটা শাশুড়ির কাছে অনেক বেশি গর্বের বিষয়! সে ভাল বাংলা পড়তে- লিখতে পারে কি না তার থেকেও অনেক বেশি! আর শুধু কৌলিন্যই নয়, কিছুটা আবেগের বিষয়ও কি নয়? কাজের সূত্রে অরুণবাবুর ছেলে থাকেন মুম্বইতে, আর মেয়ে নিউ জার্সিতে। ‘‘এই তো সে দিন বাজার থেকে ৮০০ টাকা কেজি দরে ইলিশ নিয়ে এলাম। আজ পর্যন্ত যত বার ইলিশ এনেছি আমার স্ত্রীর ছেলেমেয়েদের জন্য মন খারাপ হয়েছে। এই যে ঘটনাটা, এটা কিন্তু অন্য কোনও মাছ বা মাংসের ক্ষেত্রে হবে না।’’

আবেগই বলুন বা কৌলিন্য অথবা নিছক রসনার তাড়না— বেঙ্গালুরু, মুম্বই বা হায়দরাবাদের থেকে ‘ইলিশায়নে’ কিন্তু এগিয়ে রয়েছে দিল্লি— এমনটাই জানাচ্ছেন ‘ওহ ক্যালকাটা’র প্রধান শেফ সুবীর দেব। ‘‘মরসুমের সময় প্রতি সপ্তাহে ১০০ কেজি ইলিশ লেগে যায় আমাদের।’’ জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু হয় ইলিশ উৎসব। পাতে পড়ার আগেই তা যেন উড়ে যায়। সাড়ে সাতশো টাকা দিয়ে এক পিস খেতেও পিছপা নন দিল্লিবাসী।’’ তবে কাঁটাহীন ইলিশের চাহিদা অনেকটাই বেশি বাঙালি এবং অবাঙালি উভয় শ্রেণির কাছেই। এ বারে ওই রেস্তোরাঁয় যে উৎসব শুরু হতে চলেছে তাতে থাকছে বেশ কিছু নতুন এবং পরীক্ষামূলক আইটেম। ‘‘মোচা ইলিশ, রাঁধুনি রোস্ট, আম তেল ইলিশ। এর পাশাপাশি ভাপা বা সর্ষে ইলিশ তো থাকছেই,’’ জানাচ্ছেন সুবীরবাবু। মোচা ইলিশ? ‘‘গর্ভ মোচা ছাড়িয়ে নারকোল, আদা লঙ্কা মাখিয়ে ঘিয়ে ভেজে বেকড ইলিশের সঙ্গে চাটুতে ভাজলে তৈরি এই দুরন্ত স্টার্টার,’’ গোপন রেসিপি ভেঙে বললেন সুবীরবাবু।

রেসিপির অবশ্য তোয়াক্কা করেন না নির্বাসিতা লেখিকা তসলিমা নাসরিন। তাঁর ঢাকার ইলিশ-প্রেম নয়াদিল্লিতেও অব্যাহত। লেখাটি শেষ করা যাক প্রবাস থেকে পাঠানো তাঁর ‘ইলশেগুঁড়ি’ ই-মেল দিয়ে। তসলিমা লিখছেন, ‘‘মাছ ছাড়া আমার কোনও দিন নেই যে, যায়। ইলিশ তো কিনিই। পদ্মার ইলিশ কিনতে গিয়ে ঠকেছি অনেক। ভুল করে গুজরাতের ইলিশও কিনেছি। ঘাসের মতো খেতে! ভাল ইলিশের দাম বিচ্ছিরি রকম বেশি। মাছ কেনার বেলায় আমি অবশ্য টাকাপয়সার হিসেব করি না। ইলিশ আমি বেশির ভাগ সময়ই কালো জিরে কাঁচা লঙ্কা দিয়ে রাঁধি। একা কখনও খাইনি ইলিশ। বন্ধুবান্ধব নিয়ে খাই। ইলিশ একা খাওয়ার মাছ নয়।’’

হক কথা! একা খাওয়ার মাছ নয় ইলিশ।

উৎসব আবার একা একা হয় নাকি!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Delhi Hilsa Agni roy fish bangladesh ganga
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE