Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ইলিশের ইলিউশন

সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, বেহেস্তে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না, তাই তিনি বেহেস্তে যাবেন না। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, সব বাসনার সেরা বাসা রসনায়। রসনাতৃপ্তির জন্য বাঙালি অনেক অসাধ্যসাধন করতে প্রস্তুত। যতই দেশটা মার্কিন মুলুক হোক না কেন, মাছে-ভাতে বাঙালি ঠিক খুঁজে বার করবে একটি মাছের দোকান। লিখছেন জয়া ঘোষ

জয়া ঘোষ
শেষ আপডেট: ১৮ অগস্ট ২০১৫ ১৮:৩৩
Share: Save:

সৈয়দ মুজতবা আলি বলেছিলেন, বেহেস্তে ইলিশ মাছ পাওয়া যায় না, তাই তিনি বেহেস্তে যাবেন না। রবি ঠাকুর বলেছিলেন, সব বাসনার সেরা বাসা রসনায়। রসনাতৃপ্তির জন্য বাঙালি অনেক অসাধ্যসাধন করতে প্রস্তুত। যতই দেশটা মার্কিন মুলুক হোক না কেন, মাছে-ভাতে বাঙালি ঠিক খুঁজে বার করবে একটি মাছের দোকান। আজকাল হল ফিউশনের জমানা। ফুড নিয়ে ফিউশন, ফ্যাশনে ফিউশন, তেমনই আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের জন্য আছে ফিশ ফিউশন বা ইলিশের ইলিউশন, ‘শ্যাড’ মাছ। এই মাছ ইলিশের মতো দেখতে সার্ডিন শ্রেণির এক রকম সামুদ্রিক মাছ যার স্বাদ অনেকটাই ইলিশের মতো। দামও বেশ চড়া। মেমসাহেবের মতো সুন্দরী ইলিশ অনেক দাম দিয়ে কাঠখড় পুড়িয়ে পাওয়া গেলেও দেশের সুন্দরীর মতো সেই মিষ্টি স্বাদ নেই এই বিদেশি ইলিশে। পদ্মা বা রূপনারায়ণের ইলিশ হলেন মত্স্যকুলের মুকুটহীন সম্রাজ্ঞী। তার উজ্জ্বল বর্ণ এবং আভিজাত্যই সব বুঝিয়ে দেয়। ডাকসাইটে সুন্দরীরা যেমন যে কোনও সাজেই সুন্দর, ইলিশও তেমনি যে কোনও ভাবে রাঁধলেই রসনায় নোলা ঝরানোর ক্ষমতা রাখে। মহিলাদের নরম হাতের পাগল করা পাতুরি কিম্বা ভালবাসার ঝাঁঝে ভরা সর্ষেমাখা ইলিশ বা ত্রিকোণ ইলিশের পেটির ভাপা— খায় না কোন পাগল খ্যাপা। কোনও বন্ধুর বাড়ির পার্টিতে এ সব মন কেড়ে নেওয়া রান্না খেতে পেলে,বলতে ইছে করে, ঋতুর ছন্দে বাঁধা, মাটির গন্ধে সংতৃপ্ত, আতিথেয়তার উঞ্চতায় সিক্ত ইলিশ ‘কত যে তুমি মনোহরণ, মনই তাহা জানে’।


ছবি: গেটি ইমেজেস।

প্রবাসে প্রথম কিছু দিন চিকেন স্যান্ডউইচ, টাকো, পিত্জ্জায় পেট ঠান্ডা হলেও কিছু দিন বাদেই ওসবে ওষ্ঠাগত বাঙালি ‘চাচা আপন প্রাণ বাঁচা’ 'বলে দৌড়বেন মাছ-মিষ্টির সন্ধানে। পোস্ত, পটল, পাটালি কিম্বা ইলিশ বিরহে মন তখন হু হু করে উঠবে। ‘সেই যে আমার নানা রঙের দিন গুলি’ এই গানগুলো মাথায় ঘুরপাক খাবে অহরহ। যে কোনও দুষ্প্রাপ্য জিনিসেরই একটা অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। যেমন দেশে থেকে প্রবাসের অনেক কিছুর প্রতি আকর্ষণ হয়, ঠিক উল্টোটা হয় বিদেশে বাস করলে। আমেরিকান গ্রসারি স্টোরগুলোর সবেতেই মোটামুটি তেলাপিয়া, স্যামন, ট্রাউট, চিংড়ি, ক্যাট ফিশ— এইসব মাছ পাওয়া যায়। মন বলে চাই চাই, চাই গো, যারে নাহি পাই গো। ওই তেলাপিয়ার ত্যালত্যালে ঝোলে মনে বেদন জাগে, ইলিশ নাই নাই নাই গো।
খাদ্য রসিক বাঙালি কিনা খায়! সত্যজিতের ভাষায় সাপ, ব্যাঙ, শকুনির ঠ্যাং। তাই ইলিশ না পেলেও… হেথা নয় অন্য কোথা, অন্য কোনও খানে থুড়ি অন্য মাছে অন্য কোনওখানে ঠিক ধাবিত হন। ভাগ্য ভাল থাকলে অনেকটা পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো,বন্ধুর পার্টিতে মাঝে মাঝে ইলিশের রসনা তৃপ্তি ঘটে। বাকি দু’আনার আশায় আমার মন কেমন করে কেজানে কিসের তরে!
কথায় বলে কষ্ট না করলে কেষ্ট মেলে না। আরে বাবা সেটা তো হাড়ে হাড়ে টের পেলাম আমেরিকায় এসে। বিবাহ সূত্রেই বলুন বা ভাগ্যনুসন্ধানে— যে কারণেই বিদেশে বাঙালি আসেন সেটা তো ওই কেষ্ট পাওয়াই হল। আপনার কেষ্ট যদি করিতকর্মা এবং বেশ কেষ্টবিষ্টু গোছের কেও হয়, তা হলে ঠিক আসল ইলিশের সন্ধান পেয়ে যাবেন কারও না কারও কাছে। পতিদেবের পকেট গরম ও পত্নীব্রতা হলে তিনি ঠিক দশ-বিশ মাইল ড্রাইভ করে শহরের এঁদো পাড়ার দেশি দোকান থেকে সোনার হরিণ থুড়ি ইলিশ মাছ ধরে এনে দেবেন আপনার হাতে। আর যদি আপনার কেষ্ট ফাটাকেষ্ট হন, পকেটে টান থাকে তা হলে পতির পছন্দই সতীর পছন্দ নইলে খরচ বাড়ে এই বলে আপনাকে আমেরিকান স্টোর থেকে তেলাপিয়া বা ক্যাট ফিশের ফিলে ধরিয়ে দেবেন। তখন ইলিশ ভুলে তেলাপিয়ার ত্যালতেলে ঝোল বা বা ফিলে ফ্রাই খেয়ে, গাইতে হবে তুই ফেলে এসেছিস কারে মন মন রে আমার। আপনি যদি প্রতি পদে পদে এক ডলারকে যথাক্রমে ৪০, ৫০ বা ৬০ দিয়ে গুণ করেন তা হলে কার আর মাথা ঠিক থাকবে বলুন। বিশেষ করে ছাত্র বা স্বল্প রোজগেরে হলে তো ইলিশের দোকানে নো এন্ট্রি।
ও মাছ ইলশা রে জামাই পাগল করা মাছ। ইলিশে নাকি জামাই বশ হয়। অথচ সেই জামাই যদি কিছু দিন আমেরিকায় থাকার পরে বলেন, তিনি ইলিশ মাছ ভালবাসেন না কাঁটা বেছে খেতে হয় বলে, তা হলে আপনি মাছে মারা যাবেন। লালমোহনবাবুর ভাষায় বলি, উঁট কি কাঁটা বেছে খায়? আরে মশাই মাছ খাবেন তায় এত ইয়ের কি আছে যে কাঁটা বেছে খেতে জানেন না। যত্তসব অমেছো কথা বার্তা। সেই অনেকটা যেমন বেনী তেমনি রবে চুল ভেজাবো না-র মতো মাছ খাব কিন্তু কাঁটা বাছা চলবে না।
ইলিশ চিরকালই একটু কুলীন গোত্রীয় মাছ। পয়সা পকেটে না থাকলে ইলিশ ওই বছরে দু’চার বারের বেশি খাওয়া সম্ভব নয়। দেশে থাকাকালীনও বিশেষ পুজো-পার্বন, পয়লা বৈশাখে বা বর্ষার বিশেষ কোনও দিন ছাড়া ইলিশ মধ্যবিত্ত বাঙালির পাতে সে রকম ভাবে জায়গা পায়নি। সরস্বতী বা লক্ষ্মী পুজোয় জোড়া ইলিশ খাওয়ার রীতি অনেকেরই ছিল। নিদেন পক্ষে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলায় ইস্টবেঙ্গল জিতলে বাজারে ইলিশের চাহিদা একটু বেড়ে যেত। প্রবাসে সেটা আরও বেশি করে প্রকট। কারণ, সহজলভ্যতার অভাব বলে দাম বেশি। এখন হিউস্টনে ওজনে ৬০০- ৭০০ গ্রামের ছোট গঙ্গার ইলিশের দাম প্রায় ৭ -৮ ডলার। বড় বাংলাদেশের ইলিশ প্রায় ১০-১১ ডলার প্রতি পাউন্ডে। এই সব মাছের স্বাদও সেই বহু দিনের বরফের মাছ যেমন হয় সেই রকম। সেই কারণে অনেকটা আঙুর ফল টকের মতন,ওই ছোট ইলিশে বড্ড কাঁটা— এই বলেই প্রবাসী বাঙালি নিজেকে প্রবোধ দিয়ে থাকেন। প্রবাসী জীবনের শুরুতে অনেকেই ইলিশ নিয়ে নালিশ করেন। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সকলেই মানিয়ে নেয়। অচেনা পৃথিবীর নিঃসঙ্গ মুহূর্তে সিডি বা ভিডিওতে বৃষ্টির গান শুনতে পেলেও ইলিশ পাওয়া সব ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। তখন মায়ের হাতের ইলিশ মাছের ঝোল আর ডিম ভাজার কথা মনে পড়ে দেশান্তরীর দুঃখ দ্বিগুণ হয়। এ পরবাসে রবে কে হায়! এই গানটা আগে শুনেছি। কিন্তু, প্রবাসে না এলে বোধয় এর মানে অন্তঃকরণ করতে পারতাম না।
মিশিগান থেকে ম্যাসাচুসেটস বা কেন্টাকি থেকে ক্যালিফোর্নিয়া— নিউ জার্সি বা নেব্রাস্কা— সব জায়গাতেই দেশি দোকান থাকলে সিজিনে অল্পবিস্তর ইলিশ পাওয়া যায় যদি আপনার পকেট গরম থাকে। তবে আমেরিকার বেশির ভাগ শীতপ্রধান শহরে পদ্মার বড় ইলিশ দুস্প্রাপ্য। হিউস্টনের রুমকি দ্য বলেছিলেন আরবদেশগুলিতে কিন্তু যথেষ্ঠ ভাল দেশি-ইলিশ পাওয়া যায়। লন্ডনের নন্দিতাও একই কথা বলল যে, ব্রিটেনে বেশ ভাল ইলিশ পাওয়া যায়। কানাডার মিঠুর মতে ওখানে ইলিশ খুব একটা পাওয়া যেত না আজ থেকে ৭-৮ বছর আগে। এখন অবশ্য আমদানি বেড়েছে। তাই আমেরিকার বড় শহরগুলিতে মোটামুটি জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ভালই ইলিশ পাওয়া যাচ্ছে আজ কাল।
দিন বদলের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছুই বদলে গেছে। বাঙালির জীবনযাত্রার ধরন বদলেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার ইছে বা অনুরাগ ধূসর থেকে ধূসরতর হয়েছে এই পরবাসে। বিশ বছর আগে যারা আমেরিকায় এসেছেন তাদের ওই ইলিশের ইলিউশনেই দিন কেটেছে, শ্যাড জাতীয় মাছ খেয়ে। মনে পড়ে ৯৫তে যখন ডেট্রয়টে ছিলাম তখন অনেকটা ড্রাইভ করে গুজরাতিদের দোকানে বাজার করতে যেতাম যেখানে অন্য সব কিছু পাওয়া গেলেও মাছের নাম গন্ধ ছিল না। পরে কেরেলিয়ান দোকানে অল্প স্বল্প পমফ্রেট মাছ পেতাম। অনেক দূরে একটি বাংলাদেশি দোকানে মাছ পাওয়া যেত, কিন্তু সেখানে যাওয়া মানে বেশ সময় ও তোড়জোড় লাগত। হিউস্টনে অবশ্য ইলিশের আকাল পড়েনি কখনও। এখানে বেশ কয়েকটি দেশি দোকান ও বড় ভিয়েতনামিস, মেক্সিকান বাজারে গঙ্গার ছোট বড় সব ধরনেরই ইলিশ মাছ পাওয়া যাচ্ছে আজকাল।
বাঙালি এখন ভুবন গ্রামের বাসিন্দা। পৃথিবীটা এত ছোট হয়ে গেছে যে আজকের জেনারেশন এখন প্রবাসে এসে মাছ-মিস্টির খোঁজ না করে মোর-কেই খুঁজে বেড়ায় ! কাঁটা ছাড়া গ্রিল্ড স্যামনের ফিলেতেই মজেছে আজ বাঙালির মন। তবুও দুরে কোথায় দুরে দুরে আমার মন বেড়ায় গো ইলিশের ঘোরে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Jaya Ghosh Illusion of Hilsa
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE