ঈশ্বর-ভগবান দেবতা এরা কারা? কোথায় এদের অধিষ্ঠান? যুগের আবহমান গতির সঙ্গে মানুষের মধ্যে এই প্রশ্ন চলে আসছে। বেদ-উপনিষদ-পুরাণে এর উত্তরও মিলেছে। তবুও মানুষের সন্দেহ দূর হয় না। জানতে চায় ভগবানের উৎস।
ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে দুষ্টের দমন শিষ্টের পালন এবং ধর্ম রক্ষার লক্ষ্যে মহাবতার ভগবান রূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ।
সে বহু যুগ আগের কথা। রজঃগুণ মিশ্রিত অহংকারে দর্পে ভারাক্রান্ত হল পৃথিবী। মানব তার মান ও হুঁশকে ভুলে আসুরিক শক্তিতে শক্তিমান হয়ে উঠল। সেই সময় পৃথিবী দেবগণের শরণাপন্ন হলেন। সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সঙ্গে গাভিরূপ ধারণ করে জগৎপতির সকাশে ক্ষীর সমুদ্র তীরে গমন করলেন। এবং পুরুষোত্তমের স্তব করতে লাগলেন। অতঃপর সেই পুরুষোত্তম আকাশবাণী দ্বারা জানালেন, “আমি ধরার দুঃখ সম্পর্কে অবগত আছি। ঈশ্বরের ঈশ্বর কালশক্তি সহকারে ধরিত্রীর ভার হরণ করার জন্যে পৃথিবীতে বিচরণ করবেন। দেবগণ তাঁর আর্বিভাবের পূর্বে আপন অংশে জন্মগ্রহণ করুন।” এও বললেন, পরম পুরুষ ভগবান বসুদেবের গৃহে জন্মগ্রহণ করবেন অত্যাচারী কংসের হাত থেকে মথুরাবাসীকে রক্ষা এবং এই ধরিত্রীকে পাপমুক্ত করার জন্য। এই আকাশবাণী শোনার পর দেবকুলের মধ্যে আনন্দের বন্যা বয়ে গেল। অবশেষে পুরুষোত্তমের আকাশবাণী ফলিত হল। সে দিনটি ছিল দুর্যোগপূর্ণ। আকাশে বজ্র বিদ্যুৎ-সহ অবিরাম বৃষ্টি ধারা ভাদ্র মাসের কৃষ্ণ পক্ষের অষ্টমী তিথি। এক দিকে নিরবিচ্ছিন্ন দুর্যোগময় রাত্রি, অন্য দিকে অত্যাচারী কংসের অত্যাচারে সমস্ত দেবতাগণ উদ্বিগ্ন এবং সদ্বগুণরূপী বসুদেব এবং দৈবী প্রকৃতি রূপিনী দেবকী কংসের কারাগারে আবদ্ধ।
এই রকম একটি দুর্যোগময় দিনে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিয়েছিলেন। অর্ধরাত্রিকাল সময় রোহিণী নক্ষত্র উঠল। সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি মাতা তাঁর ভাণ্ডার উন্মোচন করে দিলেন। চতুর্দিকে এক দিব্যজোতি দেখা গেল। বনের পশু, পক্ষী, বৃক্ষ প্রত্যেকেই নিজ নিজ আনন্দে উদ্ভাসিত হল। নদী, সাগরে জলতরঙ্গের জোয়ার উঠল। চতুর্দিকে কেবল আনন্দ। স্বর্গের দেবতারা স্তব করতে লাগলেন। আনন্দ শঙ্খধ্বনি বাজাতে শুরু করলেন এবং পুষ্পবৃষ্টি করতে লাগলেন। এই শুভ মুহূর্তে বসুদেব তখন চর্তুভূজ, শঙ্খ-চক্র-গদা-পদ্মধারী সুন্দর আকৃতি ও তেজঃপুঞ্জ কলেবর সেই নবজাতককে দেখতে লাগলেন। মনে মনে ভাবলেন ভগবান তাঁর পুত্ররূপ নিয়ে জন্ম নিয়েছেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি ও দেবকী ভগবানের স্তব করতে আরম্ভ করলেন। শ্রী ভগবান বললেন, হে পতিব্রতে। প্রথম জন্মে তোমার নাম ছিল পৃশ্নি এবং বসুদেব ছিলেন সুতপা নামে প্রজাপতি। আমার তপস্যা করায় আমি খুশি হয়ে বর দিয়েছিলাম এবং পৃশ্নিগর্ভে তোমাদের পুত্র হয়েছিলাম। কাশ্যব প্রজাপতির ঔরসে অদিতির গর্ভে আসি দ্বিতীয় বার। সে বার আমার নাম ছিল উপেন্দ্র এবং আমি খর্বাকৃতি বলে বামন নাম ছিল। আমি তৃতীয় বার তোমাদের পুত্র হয়ে জন্ম নিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে বাসুদেব ভগবানের আদেশ অনুসারে পুত্রকে সঙ্গে নিয়ে কংসের কারাগার থেকে বাইরে এলেন। একে একে বৃহৎ লৌহ কপাট সব খুলে গেল। ঠিক তখনই যশোদার গৃহে যোগমায়া জন্ম নিলেন। প্রচণ্ড বজ্রবিদ্যুৎপূর্ণ রাতে অনন্তদেব সহস্র ফনা বিস্তার করে বৃষ্টির হাত থেকে নিস্তারের জন্য বসুদেবের পিছু নিলেন। মথুরাবাসী এবং ব্রজবাসীদের অজান্তে নিশুতি রাতের সমস্ত ঘটনার সাক্ষী রইলেন শুধুমাত্র দেবতাগণ। কারাগারের রক্ষকগণ নবজাতকের ক্রন্দন শুনে কংসকে সংবাদ দিলেন। এই পুত্রের জন্মের জন্য কংস তৎক্ষানাৎ কারাগারে ছুটে আসেন। কংসকে দেখে ভগ্নী দেবকী করুণ ভাবে পায়ে ধরে বললেন, একে বধ করবেন না। এর আগে আপনি আমার সাত পুত্র বধ করেছেন। এটি কন্যা সন্তান। আমার এই শেষ সন্তান, একে ভিক্ষা দিন। কংস নবজাতিকাকে হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পা দু’টি ধরে সজোরে পাথরের উপর নিক্ষেপ করেন। তৎক্ষণাৎ কৃষ্ণের অনুজা সেই কন্যা কংসের হাত থেকে মুক্ত হয়ে অষ্টভূজা দেবী মূর্তিতে আকাশ মার্গে গমন করলেন। আট হাতে ধনু, শূ্ল, বান, চর্ম, অসি, শঙ্খ, চক্র, গদা ধারণ করে কংসকে বললেন, ‘তোমারে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে’। এ দিকে নন্দের পুত্র জন্মগ্রহণ করার পর পরমানন্দে নতুন বস্ত্র ধারণ ও তিলক লেপে ব্রাহ্মণকে ডেকে পুত্রের জাত কর্ম করালেন। ব্রজবাসীগণ মহানন্দে নন্দ উৎসব করতে লাগল। ব্রজের গোপগণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল। কৃষ্ণের জন্ম সংবাদে আকাশ বাতাস, জল, পশু, পাক্ষী, বাগানের পুষ্প সকলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠল। গোটা ব্রজবাসীর ঘরে আনন্দের প্লাবন বয়ে গেল। দুধ, দই, মাখনের গন্ধে আকাশ বাতাস মাতোয়ারা হয়ে গেল। এই ভাবে কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী ও নন্দ উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে যুগের ক্রম বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আজও মানুষ এই উৎসব পালন করছে।
তাই আজকের এই পূণ্যতিথিতে সকল মানুষের উচিত শ্রদ্ধা ও ভক্তি সহকারে কৃষ্ণ সাধনা করা, নিষ্কাম ভাবে তাঁকে ডাকা। বর্তমানে মানুষ কিছু স্বার্থ নিয়ে ডাকে, স্বার্থপূরণ না হলে সেই সব মানুষের কাছে ভগবান মিথ্যা হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy