Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

টিম রাহুলের বিরুদ্ধে ক্ষোভ এখন প্রকাশ্যেই

কংগ্রেস তখনও লোকসভার ভোট প্রচারে নামেনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় রাহুল গাঁধী বলেছিলেন, ভোটের পর দলের সংগঠন আমুল বদলে দেবেন তিনি। আর আজ, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপুল ভরাডুবির পর তাঁর নিজের টিম নিয়েই বিরাট প্রশ্নের মুখে কংগ্রেস সহ-সভাপতি। বস্তুত ঘরোয়া আলোচনায় গত ক’দিন ধরেই ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন কংগ্রেসের সব পোড় খাওয়া নেতারা। কিন্তু গোহারা হওয়ার পরে ঘরোয়া এই বিদ্রোহ এখন আর চাপা থাকছে না। এক জন দু’জন করে কংগ্রেস নেতারা এ বার তা প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ১৮ মে ২০১৪ ০৩:১৮
Share: Save:

কংগ্রেস তখনও লোকসভার ভোট প্রচারে নামেনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতায় রাহুল গাঁধী বলেছিলেন, ভোটের পর দলের সংগঠন আমুল বদলে দেবেন তিনি। আর আজ, লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিপুল ভরাডুবির পর তাঁর নিজের টিম নিয়েই বিরাট প্রশ্নের মুখে কংগ্রেস সহ-সভাপতি।

বস্তুত ঘরোয়া আলোচনায় গত ক’দিন ধরেই ক্ষোভ উগরে দিচ্ছিলেন কংগ্রেসের সব পোড় খাওয়া নেতারা। কিন্তু গোহারা হওয়ার পরে ঘরোয়া এই বিদ্রোহ এখন আর চাপা থাকছে না। এক জন দু’জন করে কংগ্রেস নেতারা এ বার তা প্রকাশ্যেই বলতে শুরু করেছেন। যেমন বরাবরের ঠোঁট-কাটা কংগ্রেস নেতা তথা ওয়ার্কিং কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য অনিল শাস্ত্রী এ দিন বলেন, “রাহুলকে ভুল পথে ঠেলে দিয়েছেন তাঁর পরামর্শদাতারাই। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনা, স্লোগান রচনা, প্রার্থী বাছাই, প্রচারের বিষয়বস্তু নির্ধারণ সবেতেই ওঁরা ফেল।”

নির্দিষ্ট কারও নাম মুখে আনেননি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর পুত্র অনিল। তবে টিম রাহুলের সদস্যদের ওই নামগুলি কারও কাছে গোপন নয়। গত প্রায় এক বছরে ধরে রাহুল-টিমের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিলেন মোহন গোপাল, জয়রাম রমেশ, মধুসূদন মিস্ত্রী, মোহন প্রকাশ, লুইজানো ফেলেইরো, অজয় মাকেন এবং দলিত নেতা কে রাজু। যাঁদের মধ্যে জয়রাম ও অজয় মাকেন ছাড়া নিচু তলার কংগ্রেস নেতারা অধিকাংশের মুখও চেনেন না। কেন না তৃণমূল স্তরের রাজনীতির সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্কই নেই। অথচ রাহুলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তাঁরাই।

‘রাজীব গাঁধী ইনস্টিটিউট অব কনটেম্পোরারি স্টাডিজ’-এর বর্তমান ডিরেক্টর তথা হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একদা আইনের ছাত্র মোহন গোপালই এ বার ছিলেন রাহুলের মূল মন্ত্রগুরু। রাহুলের প্রচারের থিম কী হবে, সেটা তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। তাঁরই পরামর্শে দারিদ্রসীমা ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মাঝের ৭০ কোটি মানুষকে প্রচারে টার্গেট করেছিলেন রাহুল। তাঁদের বার্তা দিতে দেশের বিভিন্ন স্থানে গিয়ে চৌপাল করেছিলেন কংগ্রেস সহ-সভাপতি। কংগ্রেস নেতৃত্ব এখন বলছেন, ওই সব চৌপাল করে ফালতু সময় নষ্ট করেছেন রাহুল। নরেন্দ্র মোদী যখন জনসভা করে গোটা দেশে ঝড় তুলছেন, তখন বাছাই করা কয়েক জন রিক্সাচালক, কলেজ পড়ুয়া, হকার বা কুলির সঙ্গে কথা বলা ছাড়া বৃহত্তর জনতার কাছেই পৌঁছতে পারেননি রাহুল।

মোহন গোপালের ওপর ২৪ নম্বর আকবর রোডের ক্ষোভ এখানেই থেমে নেই। কংগ্রেস সূত্র বলছে, কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের সঙ্গে মোহনের ব্যক্তিগত টানাপড়েনও বিস্তর। অতীতে ২০০৪ ও ২০০৯ সালে কংগ্রেসের ওয়ার রুম পরিচালনার অন্যতম মুখ ছিলেন জয়রাম। অতীতে ওই ওয়ার রুমেই দলের বর্ষীয়ানরা একত্র হয়ে ভোট-কৌশল রচনা করতেন। কিন্তু জয়রাম-মোহনের পারস্পরিক টানাপড়েনে এ বার ব্রাত্য হয়ে যায় গুরুদ্বার রকাব গঞ্জ রোডের সেই কৌশল কক্ষ। বরং রাহুলের বাসভবনে সমান্তরাল একটি ওয়ার রুম তৈরি করেন মোহন গোপাল। তাতে কৌশল রচনায় দলের পোড় খাওয়া নেতাদের আর কোনও ভূমিকাই থাকে না।

তবে জয়রামও সমালোচনার ঊর্ধ্বে নন। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, ইউপিএ জমানায় মন্ত্রী থেকেই কংগ্রেসের সর্বনাশ শুরু করেছেন এই নেতা। প্রথমে পরিবেশ ও পরে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী থেকে তিনি পরিবেশ সংক্রান্ত ছাড়পত্র ও জমি নীতি রচনা নিয়ে এতটাই সমাজ-বিপ্লবীর মতো আচরণ করেছেন যে শিল্পপতিদের বড় অংশ তাতে চটে গিয়েছেন। অভিযোগ উঠেছে, বিজেপির দিকে তাঁদের ঝুঁকে পড়ার অন্যতম কারণটাই হলেন রাহুল ঘনিষ্ঠ এই নেতা।

এ বার লোকসভা ভোটে রাহুলের প্রচার নীতি মোহন গোপাল নির্ধারণ করলেও কংগ্রেসের নির্বাচনী স্লোগান চূড়ান্ত করেছেন জয়রাম। মূলত তাঁরই পরামর্শে দলের পুরনো স্লোগান বাতিল হয়। নতুন স্লোগান হয়, ‘হর হাত শক্তি, হর হাত তরক্কি’। যে স্লোগানের মাথামুন্ডু নেই বলেই মনে করেন কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা। তা ছাড়া ঝাড়খণ্ড ও অন্ধ্রপ্রদেশে এ বার কংগ্রেসের প্রচারের দায়িত্বে ছিলেন জয়রাম। নিজে যিনি কোনও দিন ভোটেই লড়েননি, তাঁর নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দক্ষতায় রাহুল কী ভাবে ভরসা করলেন, সেটাই কংগ্রেসে বড় আশ্চর্যের বিষয়।

জয়রামের পাশাপাশি এখন নিশানায় দিগ্বিজয় সিংহও। কংগ্রেস নেতৃত্বের মতে, অতি ধর্মনিরপেক্ষ হয়ে উঠে দিগ্বিজয়ের নানান বক্তব্যই আখেরে মেরুকরণের রাজনীতিতে অক্সিজেন জুগিয়েছে। তা ছাড়া পৃথক তেলঙ্গনা করেও কংগ্রেস যে তার রাজনৈতিক ফায়দা নিতে পারেননি, তার মূলেও রয়েছেন দিগ্বিজয়। কারণ, তেলঙ্গনা রাষ্ট্র সমিতি নেতা চন্দ্রশেখর রাও কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর দলকে মিশিয়ে দেওয়ার শর্ত হিসাবে মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবি করেছিলেন। কিন্তু দিগ্বিজয়ের পরামর্শে তা খারিজ করে দেন রাহুল।

অন্ধ্রে যখন দিগ্বিজয় ব্যর্থ হয়েছেন, তেমনই সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছেন আর এক মোহন মোহন প্রকাশ। অতীতে জনতা দলে ছিলেন এই নেতা। গত দু’বছরে প্রথমে উত্তরপ্রদেশ, পরে গুজরাত, মহারাষ্ট্রে সাংগঠনিক দায়িত্ব পেয়ে বার বার তাঁর অদক্ষতার নজির রেখেছেন মোহন প্রকাশ। অথচ রাহুলের চোখে তিনিই বড় নেতা। এ বার তাঁকে নিজের টিমে রাখার পাশাপাশি মধ্যপ্রদেশের দায়িত্ব দিয়েছিলেন রাহুল।

রাহুল ঘনিষ্ঠ মধুসূদন মিস্ত্রীর বিরুদ্ধেও প্রশ্ন তুলেছেন কংগ্রেসের নেতারা। উত্তরপ্রদেশ সহ গোটা দেশে কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভাবনাময় সব আসনে এ বার প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্ব তাঁকে দিয়েছিলেন রাহুল। কিন্তু মধুসূদনের নাম না করলেও আজ অনিল শাস্ত্রী বলেন, ভোটে লড়ার ব্যাপারে যাঁর নিজের অভিজ্ঞতা সীমিত, তিনি প্রার্থী বাছাই করবেন কী ভাবে? তাই এমনও হয়েছে, তালিকা ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর একের পর এক প্রার্থী কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দিয়েছেন।

কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির এক নেতার কথায়, অতিরিক্ত দলিত রাজনীতি করাও রাহুলের এ বার ভুল হয়েছে। তার মূলে ছিলেন কংগ্রেসের দলিত নেতা কে রাজু। অথচ এ বার ভোটে কংগ্রেসের এক জনও দলিত নেতা জিততে পারেননি।

তা হলে কি এ বার তাঁর টিম ভেঙে দেবেন রাহুল?

কংগ্রেস সূত্র বলছে, লোকসভা ভোটে ভরাডুবির দায় নিয়ে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে হয়তো এ বার ইস্তফার প্রস্তাব দিতে পারেন সনিয়া-রাহুল। যদিও কংগ্রেস নেতৃত্ব এ-ও জানাচ্ছেন, সেই পদত্যাগপত্র যে গ্রহণ করা হবে না তা-ও এখনই বলে দেওয়া যায়। তবে এটা ঠিক যে কংগ্রেস সংগঠনে আমুল সংস্কারের জন্য রাহুলের ভাবনা এ বার ধাক্কা খাবে। সেই সঙ্গে এই দাবিও উঠবে, রাহুলের তুলনায় এ বার আরও বেশি সংগঠনের বিষয় দেখুন সনিয়া গাঁধী। তবে কংগ্রেস সভানেত্রী এমনিতেই অসুস্থ। দশ বছর আগের মতো তিনিও আর সংগঠন সামলাতে পারবেন কি না, সে ব্যাপারেও সংশয়ে রয়েছেন নেতারা।

সব মিলিয়ে ভরাডুবির পরে দিশেহারা অবস্থা এখন কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের। ক্ষোভ-বিক্ষোভ যত প্রকাশ্যে আসবে, ফাটলও তত বাড়বে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

rahul gandhi congress
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE