Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

নিষ্কৃতি পান নিরীহ, দোষী যেন পার না পায়

বছর কয়েক আগে ডায়মন্ড হারবার আদালতে দুই ভাসুরের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন এক গৃহবধূ। কিন্তু স্বামীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না। অভিযোগ পেয়েই পুলিশ গ্রেফতার করে দুই ভাসুরকে। গ্রেফতারের কয়েক দিন পর আদালতে যখন দুই ভাসুরকে ফের হাজির করানো হল, ওই মহিলা কিন্তু জামিনের বিরোধিতা করলেন না। তদন্তে পরে উঠে এসেছিল, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরে মহিলা ও তাঁর স্বামী বধূ নির্যাতনের অভিযোগকে ঢাল করে মামলা সাজিয়েছিলেন। ভাসুরেরা গ্রেফতারের পর সম্পত্তি লিখে দিতে রাজি হলে ওই মহিলা আর জামিনের বিরোধিতা করেননি।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ জুলাই ২০১৪ ০৩:৫৫
Share: Save:

বছর কয়েক আগে ডায়মন্ড হারবার আদালতে দুই ভাসুরের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ এনেছিলেন এক গৃহবধূ। কিন্তু স্বামীর বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ ছিল না। অভিযোগ পেয়েই পুলিশ গ্রেফতার করে দুই ভাসুরকে। গ্রেফতারের কয়েক দিন পর আদালতে যখন দুই ভাসুরকে ফের হাজির করানো হল, ওই মহিলা কিন্তু জামিনের বিরোধিতা করলেন না। তদন্তে পরে উঠে এসেছিল, সম্পত্তি নিয়ে বিবাদের জেরে মহিলা ও তাঁর স্বামী বধূ নির্যাতনের অভিযোগকে ঢাল করে মামলা সাজিয়েছিলেন। ভাসুরেরা গ্রেফতারের পর সম্পত্তি লিখে দিতে রাজি হলে ওই মহিলা আর জামিনের বিরোধিতা করেননি।

বছর কয়েক আগে বিয়ে করেছিলেন রাজ্য সরকারের এক ইঞ্জিনিয়ার। কয়েক মাসের মধ্যেই তাঁর বিরুদ্ধে নির্যাতনের মামলা করেন স্ত্রী। দাবি করেন খোরপোষেরও। মামলা চলাকালীনই ওই ইঞ্জিনিয়ার জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রীর আগেও একটি বিয়ে রয়েছে। সেখানেও নির্যাতনের মামলা করে মোটা টাকা আদায় করার চেষ্টা করেছিলেন ওই মহিলা। পূর্বতন স্বামীর সঙ্গে ডিভোর্সের মামলা চলার সময়ই ওই মহিলা রাজ্য সরকারের ইঞ্জিনিয়ারকে বিয়ে করেন।

গৃহবধূদের নিরাপত্তা দিতে ১৯৮৩ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে ঢুকেছিল বধূ নির্যাতন আইন (৪৯৮এ ধারা)। কিন্তু রক্ষাকবচ হিসেবে তৈরি হওয়া সেই আইনকে যে অনেকেই অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, তা গত কয়েক বছর ধরেই টের পাচ্ছিলেন আইনজীবী-পুলিশেরা। এ বার একই উপলব্ধি সুপ্রিম কোর্টেরও। তার ভিত্তিতেই বধূ নির্যাতন আইনে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করতে নিষেধ করেছে শীর্ষ আদালতের বিচারপতি চন্দ্রমৌলিকুমার প্রসাদ ও বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষের ডিভিশন বেঞ্চ। বুধবার শীর্ষ আদালতের এই রায়ের পর আইনজীবী-বিচারকদের একাংশের বক্তব্য, এর ফলে আইনের অপব্যবহার কিছুটা হলেও কমবে। একই সঙ্গে এই নির্দেশ যাতে প্রকৃত অপরাধীদের গ্রেফতারি এড়াতে সাহায্য না করে, পুলিশকেও সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে বলে আইনজ্ঞেরা মনে করছেন।

আইনজীবীরা বলছেন, তিন দশক আগের পরিস্থিতিতে বধূ নির্যাতন বিরোধী আইন অত্যন্ত সংবেদনশীল ও কঠোর করে প্রণয়ন করা হয়। যার ফলে এই ধরনের অভিযোগ দায়ের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এফআইআরে নাম থাকা অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে হবে, এমন নির্দেশও ছিল পুলিশ-কর্তাদের প্রতি। গ্রেফতার হওয়ার পরে তড়িঘড়ি জামিনও মিলত না।

এমনই একটি মামলার অভিযুক্ত অরনেশ কুমার দেশের শীর্ষ আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। সেই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, এ বার থেকে অভিযোগ পাওয়ার পরেই অভিযুক্তদের তড়িঘড়ি গ্রেফতার করার প্রয়োজন নেই। ঘটনাচক্রে, বিচারপতি পিনাকীচন্দ্র ঘোষ কলকাতা হাইকোর্টে থাকাকালীন একটি বধূ নির্যাতনের মামলায় অভিযোগকারিণীর স্বামী ছাড়া বাকি সবাইকে জামিন দিয়েছিলেন। তাঁর যুক্তি ছিল, স্বামীর মদত না থাকলে পরিবারের অন্য কেউ অত্যাচার করতে পারে না। শুধু তিনিই নন, এই আইনের অপব্যবহার নিয়ে বিভিন্ন মামলায় মন্তব্য করেছেন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সুদীপ অহলুওয়ালিয়া ও বিচারপতি প্রণব চট্টোপাধ্যায়ও।

আইনের অপব্যবহার ও গ্রেফতার করা নিয়ে কড়া মন্তব্য করেছে শীর্ষ আদালতও। বিচারপতিরা বলেছেন, কিছু মামলা স্বামীর শয্যাশায়ী ঠাকুর্দা-ঠাকুমা, প্রবাসী বোনকেও অভিযুক্ত হিসেবে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই প্রসঙ্গেই এক আইনজীবীর মন্তব্য, “বছর খানেক আগে দমদমের এক গৃহবধূ তাঁর পঙ্গু, শয্যাশায়ী শ্বশুরের নামেও নির্যাতনের মামলা করেছিলেন।” মিথ্যা মামলা নিয়ে সরকারি আইনি পরিষেবা চাওয়ার নজিরও রয়েছে। কলকাতা জেলা আইনি পরিষেবা সংস্থার সেক্রেটারি মৌ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “কিছু মামলা যে সাজানো, তা অভিযোগের ধরন দেখেই বুঝতে পারি। কিন্তু নিয়ম মেনে তাঁদেরও আইনি সাহায্য দিতে হয়।”

তবে এই আইন যে বহু মহিলাকে নির্যাতনের হাত থেকে সুরক্ষা দিয়েছে, তা-ও মেনে নিয়েছেন আইনজীবী-বিচারকরা। তাঁরা বলছেন, এই আইনে মামলা করা হলে তড়িঘড়ি গ্রেফতার করা হবে, এই ভয় দেখিয়েই অনেককে নির্যাতন থেকে নিরস্ত করা যেত। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের নয়া নির্দেশের পরেও এই আইনটি কী প্রকৃত নির্যাতিতাকে সেই সাহায্য করতে পারবে?

আইনজীবীদের একাংশ অবশ্য মনে করছেন, এই নির্দেশে আইনটি দুর্বল হয়ে পড়ল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। কারণ এই নির্দেশের পরে প্রকৃত দোষীদের গ্রেফতার করতে পুলিশের কোনও অসুবিধা হবে না। আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, তড়িঘড়ি গ্রেফতার না করলেও এই আইনের ঝাঁঝ বজায় থাকবে। উল্টে গ্রেফতার করলে বেশির ভাগ সময়েই সংসারে পাকাপাকি ফাটল ধরত। সেটাও অনেক ক্ষেত্রে এড়ানো সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকাটা গুরুত্বপূর্ণ।

আইনজীবীদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন রাজ্য মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন সুনন্দা মুখোপাধ্যায়। তিনি বলেন, “পুরুষশাসিত সমাজে শ্বশুরবাড়ির অত্যাচার থেকে বাঁচতে মেয়েদের এই একটাই রক্ষাকবচ ছিল। সেটাও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।” তাঁর বক্তব্য, “কোন আইনের অপব্যবহার হয় না? অপব্যবহারের জন্য যদি এ ভাবে আইনে পরিবর্তন আনতে হয়, তা হলে তো সব আইনের ক্ষেত্রেই সেটা প্রযোজ্য।” এ ব্যাপারে জাতীয় মহিলা কমিশনের সঙ্গে কথা বলে তাঁরা যৌথ ভাবে প্রতিবাদের কথাও ভাবছেন বলে জানান সুনন্দাদেবী।

সুনন্দাদেবীর থেকে কিছুটা ভিন্নমত নারী আন্দোলনের কর্মী শাশ্বতী ঘোষ। তাঁর বক্তব্য, সঠিক ঘটনায় ৪৯৮এ ধারার প্রয়োগ খুব কমই করে পুলিশ। সত্যিকারের বধূ নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ এই ধারা দিতেই চায় না। আর দিলেও অভিযুক্তকে খুঁজেই পান না তদন্তকারীরা। “আইনের যে ধারাটির সঠিক ভাবে ব্যবহারই হয় না, তার আবার অপব্যবহার কীসের?” প্রশ্ন শাশ্বতীদেবীর।

বস্তুত এই আইনকে কাজে লাগিয়ে পুলিশের একাংশ যে দুর্নীতি করে এসেছে, তা-ও উল্লেখ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা। এ বার কি এড়ানো যাবে সেই দুর্নীতি? এ ব্যাপারে আইনজীবী, নারী আন্দোলনের কর্মী বা পুলিশকর্তারা কিন্তু মোটামুটি একমত। সবারই বক্তব্য, আইনের এই ধারা প্রয়োগ নিয়ে দুর্নীতির সুযোগ আগেও যেমন ছিল, এখনও তেমনই থাকবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

supreme court verdict women's rights
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE