বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতের পথে জয়ললিতা। শনিবার।
আঠারো বছরের পুরনো দুর্নীতির ভূত। সেই ভূতের ঢিলেই শনিবারের বারবেলায় কাত আম্মার প্রবলপ্রতাপ! দুর্নীতির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত চার বছরের মেয়াদে জেলেই যেতে হল ৬৬ বছরের জয়ারাম জয়ললিতাকে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কেউ মুখ্যমন্ত্রীর তখ্ত থেকে সোজা চললেন জেলে। আর পরিণামে ফের টলে গেল দ্রাবিড় রাজনীতি। তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হবেন কে, অন্নাদ্রমুকের ভবিতব্যই বা কি এই সব হাজারো প্রশ্ন ভাবতে বসে গেলেন জাতীয় রাজনীতির কুশীলবরাও। এমনকী তামিলনাড়ুর এই পরিণতি দেখে অন্য রাজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়েও শুরু হয়ে গেল জল্পনা!
হিসাব বহির্ভূত সম্পত্তি মামলায় তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতার বিরুদ্ধে আজ চার বছরের হাজতবাসের সাজা শোনায় বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালত। সঙ্গে ১০০ কোটি টাকা জরিমানাও ধার্য করেন বিচারপতি জন মাইকেল ডি’কুনহা। যার অর্থ একটাই। অবিলম্বে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিতে হবে তামিল নেত্রীকে। কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ, ফৌজদারি মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর আর এক দণ্ডও আইনসভার সদস্য থাকা যাবে না। শুধু তাই নয়, জনপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী হাজতবাসের পর আরও ছ’বছর ভোটে লড়তে পারবেন না জয়া।
জয়ললিতার পাশাপাশি আজ সাজা হয়েছে তাঁর তিন ঘনিষ্ঠেরও। পালিত পুত্র সুধাকরণ, ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শশীকলা নটরাজন এবং আত্মীয়া ইলাবরসীকেও চার বছরের কারাবাসের সাজা শুনিয়েছে আদালত। তবে তাঁদের জরিমানা হয়েছে কম, দশ কোটি টাকা করে। বেঙ্গালুরু বিশেষ আদালত এই সাজা শোনানোর পরই আজ সরকারি ভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে জয়ললিতা সহ চার জনকে। যদিও ‘শরীরে ঝিমুনির কারণে’ জেল থেকে সন্ধ্যায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তামিল নেত্রীকে। কিন্তু সেটুকু রেহাই-ই বা কত ক্ষণের! উচ্চ আদালত জামিন না দিলে আপাতত জেলেই থাকতে হবে জয়ললিতাকে।
অথচ শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না। প্রবাদপ্রতিম তামিল অভিনেতা এম জি রামচন্দ্রনের হাত ধরে তামিল রাজনীতিতে প্রবেশ করেছিলেন জয়ললিতা। পরিচালক শিবাজি গণেশনের একদা পছন্দের এই তামিল অভিনেত্রীর জনপ্রিয়তা তখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। রামচন্দ্রনের পর ৯১ সালে যখন তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন জয়া, নিজেকে সততার জানা যায় চেন্নাইয়ের পয়েস গার্ডেনে দু’-দু’টি বাংলো ছাড়াও হায়দরাবাদে প্রাসাদোপম বাড়ি, উটিতে খামারবাড়ি, বিস্তর চাষের জমি রয়েছে জয়ললিতার। তাঁর ঘনিষ্ঠদের সম্পত্তির পরিমাণও কিছু কম নয়।
বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতে কড়া পাহারা।
বান্ধবী শশীকলা নটরাজনের ছেলে সুধাকরণকে দত্তক নিয়েছিলেন জয়া। সেই সুধাকরণের বিয়ের জাঁকজমক দেখে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের। আয়োজনের আড়ম্বরে গিনেস বুকের রেকর্ডে ঢুকে যায় সেই বিয়ে। এ হেন শশীকলা, সুধাকরণ এবং তাঁর আত্মীয়া ইলাবরসীকেও আজ চার বছর কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত। তবে তাঁদের জরিমানার পরিমাণ কম, দশ কোটি টাকা করে। রায় শোনার পরেই অসুস্থ হয়ে পড়েন ৬৬ বছরের নেত্রী। বেঙ্গালুরুর কেন্দ্রীয় জেলে দাখিল করার পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তাঁকে।
অনেকেই বলছেন, আজকের রায় সেই সব নেতানেত্রীদের শিরদাঁড়া বেয়েও হিমস্রোত নামাবে, যাঁরা দুর্নীতিতে যুক্ত। জয়ললিতাই প্রথম রাজনীতিক, যিনি মুখ্যমন্ত্রীর গদি থেকে জেলে গেলেন। এর আগে পশুখাদ্য মামলায় জেলে যাওয়ার উপক্রম হতে ইস্তফা দিয়েছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী লালুপ্রসাদ যাদব। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে জেলে গিয়েছেন ঝাড়খণ্ডের শিবু সোরেন, মধু কোড়া, হরিয়ানার ওমপ্রকাশ চৌটালা। ক্ষমতার অলিন্দে নাম যতই রাশভারী হোক না কেন, দুর্নীতির পাঁক গায়ে থাকলে এক দিন না এক দিন ফল ভুগতেই হবে, এই বিশ্বাস আরও শক্তিশালী করে তুলল জয়ললিতা মামলার রায়।
বামপন্থী রাজনীতিক তথা রাজ্যের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী অশোক মিত্র আজ বলেন, “দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অনাচারের বিরুদ্ধে দেশে নানা ধরনের প্রতিবাদ হচ্ছে। যেখানে সংগঠিত রাজনৈতিক প্রতিবাদ কার্যকর হচ্ছে না, সেখানেও যেমন যাদবপুরে ছাত্রছাত্রীরা যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন এ ধরনের হঠাৎ হঠাৎ বিস্ফোরণ অন্যদেরও সাহস জোগাবে।” তাঁর মতে, এই সব বিক্ষিপ্ত প্রতিবাদের মধ্য দিয়েই হয়তো কোনও সৎ রাজনৈতিক সংগঠন আত্মপ্রকাশ করবে। তবে একই সঙ্গে তাঁর বক্তব্য, নিছক দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ কোনও সামগ্রিক আদর্শের বিকল্প হতে পারে না। অশোকবাবুর কথায়, “আপ-এর উদাহরণ মনে রেখেই বলছি, সংহত সুস্পষ্ট আদর্শের ভিত্তিতেই ভারতকে চরম সর্বনাশের হাত থেকে উদ্ধার করা সম্ভব।”
জয়ললিতার দুর্নীতি নিয়ে বেঙ্গালুরুর বিশেষ আদালতের রায় এমন একটা সময়ে এল, যখন সারদা কেলেঙ্কারি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরের দোরগোড়ায় এসে ধাক্কা মারছে সেই কেলেঙ্কারির ঢেউ। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই এই রায়কে হাতিয়ার করে সরব হয়েছে তৃণমূলের বিরোধীরা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের মন্তব্য, “জয়ললিতাকে দুর্নীতির জন্য জেলে যেতে হল, বঙ্গললিতার কী হবে! বাংলা তামিলনাড়ুর পথেই এগোচ্ছে।” বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও কারও নাম না-করে প্রশ্ন তুলেছেন, “জয়ললিতা যদি জেলে যান, তা হলে আপনার কী হবে?”
লোকসভা ভোটের আগে জয়ললিতার সঙ্গে হাত মেলাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভোটের পরেও এডিএমকের সঙ্গে জোট করে লোকসভায় প্রধান বিরোধী শক্তি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। সেই জয়ার জেল নিয়ে আজ তৃণমূলের পক্ষ থেকে সরকারি ভাবে কেউ কোনও মন্তব্য করেননি। কিন্তু দলের শীর্ষ নেতারা যে বিব্রত এবং খানিকটা শঙ্কিত সেই খবর মিলছে তৃণমূলের অন্দর থেকেই।
রাজনীতির এই পর্বের বাইরে একটা জিনিস অবশ্য স্পষ্ট। দীর্ঘ প্রায় দু’দশক আইনি যুদ্ধ, কেন্দ্র ও রাজ্যে ক্ষমতার সমীকরণের রদবদল কিছুই দুর্নীতির শাস্তিকে ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। অথচ ভবিতব্যকে আটকাতে কত চেষ্টাই না করেছেন জয়ললিতা! দুর্নীতির দায় ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে অনায়াসে ত্যাজ্য করেছেন সুধাকরণকে। ২০০১ সালে ফের ক্ষমতায় আসার পরে মামলা লঘু করার চেষ্টার অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। সে বছরই সেপ্টেম্বরে আদালতের রায়ে মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিতে হয় তাঁকে। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে উপনির্বাচনে জিতে আবার মুখ্যমন্ত্রী হন জয়া। তাঁর মামলার শুনানি নিয়ে টালবাহানাও হয়েছে বিস্তর। শেষ পর্যন্ত ২০০৩ সালে বেঙ্গালুরুতে মামলা সরিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।
২০১১-তে রাজ্যে ফের ক্ষমতায় আসেন জয়া। সদ্য সমাপ্ত লোকসভা ভোটে তামিলনাড়ুর ৩৯টি আসনের মধ্যে ৩৭টিতেই জেতে তার দল। কিন্তু এই বিপুল জনাদেশও তাঁর রক্ষাকবচ হতে পারল না। রক্ষাকবচ হলো না আমজনতার জন্য বিপুল খয়রাতির আয়োজনও। এ দফায় ক্ষমতায় এসে ‘আম্মা ক্যান্টিনের’ মাধ্যমে গোটা রাজ্যে গরিবদের প্রতিদিন সস্তায় খাবারের ব্যবস্থা করেছেন জয়া। ভর্তুকি মূল্যে সবাইকে ওষুধ দিতে শুরু হয়েছে ‘আম্মা মেডিসিন শপ’। তার জেরে তামিলনাড়ুতে আজকান্নার রোল উঠেছে ঠিকই, বেঙ্গালুরুর পথে পাড়ি দিয়েছেন হাজারো মানুষ। কিন্তু জয়ার জেলযাত্রা ঠেকানো যায়নি।
এডিএমকে-র ভবিষ্যৎ কী হবে, এই মুহূর্তে বড় প্রশ্ন সেটাই। জয়ার প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী করুণানিধির পরিবারও দুর্নীতির অভিযোগে জীর্ণ। টুজি কেলেঙ্কারিতে জেল খেটেছেন তাঁর মেয়ে কানিমোঝি এবং দলের নেতা এ রাজা। ডিএমকের আর এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা দয়ানিধি মারানের বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। এই অবস্থায় জয়ার শাস্তি করুণাকে খানিকটা স্বস্তি দেবে বলেই মনে করছে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল। ডিএমকে নেতাদের আশা, এ বার করুণা-পুত্র এম কে স্ট্যালিনের হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে দল।
এডিএমকে নেতারা অবশ্য পাল্টা বলছেন, উচ্চ আদালতে আবেদন করে শীঘ্রই জামিন পাবেন জয়া। ঠিক যেমন পশুখাদ্য মামলায় পাঁচ বছর সাজার নির্দেশ সত্ত্বেও জামিন পেয়েছেন লালুপ্রসাদ। তা ছাড়া, জেলে থাকলেও দল ও সরকারের রাশ থাকবে আম্মারই হাতে। জরাজীর্ণ ডিএমকে এই অবস্থার কোনও ফায়দাই নিতে পারবে না। আর তামিলনাড়ুতে কংগ্রেস এবং বিজেপির দশা মোটেই ভাল নয়।
তবে মুখ্যমন্ত্রীর গদি থেকে যে জয়ললিতাকে আপাতত দূরেই থাকতে হচ্ছে, সেটা ঘোরতর বাস্তব। সুতরাং বেঙ্গালুরুর আদালতের রায় তামিলনাড়ুর রাজনীতিকে কোন পথে নিয়ে যায় সে দিকে নজর থাকবে সবার। কিন্তু তার থেকেও বেশি আগ্রহ থাকবে অন্য রাজ্যের রাজনীতির বাঁক বদলের দিকে।
ছবি: পিটিআই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy