পরবর্তী কালে অবশ্য মজিদ মাস্টার, বি ডি দাশরাই দলের ‘সম্পদ’ হয়ে ওঠেন। এই সম্পদদের দাপটেই ভোটের পর ভোটে নিশ্চিন্তে জয়। তাই এদের বাহিনী ভেড়ি লুঠ বা দখল করতে গিয়ে খুন, জখম করলে অথবা চোখের সামনে দিয়ে জঙ্গলের গাছ সাফাই করলেও পুলিশ নিধিরাম হয়ে বসে থাকত। সেই সময়ে এদের বিরুদ্ধে থানায় গিয়ে অভিযোগ করার সাহস কারও ছিল না। যদি সাহস থাকত তাহলে অভিযোগ জমে জমে যে পাহাড় তৈরি হত তাতে পুরুলিয়া ঘেঁষা বাঁকুড়ার শুশুনিয়ার বদলে এই পাহাড়েই রক ক্লাইম্বিংয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া যেত।
আজকে দু’হাতে পয়সা ওড়ানো জমিদারদের মতো আক্ষেপ করলে কী হবে, সে দিন যে সমস্ত নেতা, মন্ত্রীর আশীর্বাদে মজিদ মাস্টাররা নিশ্চিন্তে ছিলেন, তাদের সম্পর্কে আলিমুদ্দিন কিছুই জানত না, এ কথা শুনলে ঘোড়াও হাসবে। নেতা-মন্ত্রীদের প্রশ্রয়েই লালঝান্ডাধারী এক দল লুুঠেরা তৈরি হয়েছিল। উত্তরবঙ্গের অরণ্য-সম্পদ লুঠ বাড়ায় বাম আমলের বেশ কয়েক জন মন্ত্রীর সরাসরি মদত ছিল। বাম আমলের নেতা-মন্ত্রীদের চোখের মণি এক পুলিশ-কর্তা খিদমত খাটতে খাটতে হাঁফিয়ে উঠেছিলেন। শেষ পর্যন্ত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথম বার রেলমন্ত্রী হওয়ার সময়ে শিবির পাল্টে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধরে রেলরক্ষী বাহিনীর কর্তা হয়েছিলেন।
কিন্তু মমতা হঠাৎ করেই রেল মন্ত্রিত্বে ইস্তফা দেওয়ায় সেই পুলিশ-কর্তাকে ফের বাম সরকারের অধীনেই ফিরতে হয়। সেই সময় প্রতিশোধ নিতে তাঁকে আই জি ফরেস্ট পদে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সল্টলেকের অরণ্য-ভবনে তাঁর দফতর। দফতর বলতে পাঁচতলায় মোটামুটি একটি ঘর। বেল বাজালে অধস্তন কর্মী তো দূরের কথা, চা-জল দিতেও কেউ আসে না। শুধু অফিস যেতে-আসতে গাড়ি মেলে। তাও সপ্তাহে পাঁচ দিন। শনিবার, রবিবার অফিস বন্ধ। তাই ওই দু’দিন গাড়ি নেই। এই অবস্থায় অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে থাকা ওই পুলিশ অফিসার কর্তার মুখে শুনেছিলাম পাল্টা প্রতিশোধ নেওয়ার কাহিনি।
সেই কাহিনি হল উত্তরবঙ্গে সেই সময়ে টিম্বার মাফিয়াদের নেতা ছিলেন এক মন্ত্রী-পুত্র। সেই মন্ত্রী-পুত্র যে বনসম্পদ উজার করছেন তা জানা ছিল জেলার পুলিশ-কর্তাদের। কিন্তু রাজতন্ত্র গিয়ে তার জায়গায় এসেছে গণতন্ত্র। আর বেনোজলে গণতন্ত্রে রাজশক্তি নয়, মন্ত্রী-শক্তির হাতেই সমাজের জিয়নকাঠি-মরণকাঠি। অতএব কে ছোঁবে মন্ত্রী-পুত্রকে। কিন্তু যে পুলিশ-কর্তা নেতা-মন্ত্রীদের বিষ নজরে রয়েছেন, প্রতিদিন হেনস্থার মুখে পড়ছেন, অবসরের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর তো পিছনে তাকানোর কিছু নেই। তাই প্রতিশোধ নিতে সেই মন্ত্রী-পুত্রের বেআইনী কাঠ বোঝাই ২১টি ট্রাক বাজেয়াপ্ত করেছিলেন তিনি। তখন তিনি নিশ্চয়ই ভেবেছিলেন, ‘দ্যাখ কেমন লাগে!’ শোধ নেওয়ার তো একটা সুখ নিশ্চয়ই আছে!
রাজ্যের ভোট সংস্কৃতিতে সিপিআইএম-এর বড় অবদান সায়েন্টিফিক রিগিং। তার সঙ্গে রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন এবং রাজনৈতিক আধিপত্যকে কাজে লাগিয়ে বিভিন্ন অসামাজিক কাজেও লালঝান্ডাধারীদের হাত ধরেই শিকড় গজিয়েছে। ৩৪ বছর ধরে লালঝান্ডাধারী একদল লুঠেরা নতুন ভোটারদের তাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে তৃণমূলের দিকে। এখন আবার তাদের অনেকেই ‘পদ্ম’ ‘পদ্ম’ বলে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। তৃণমূলকে আনার সময় এরা জানত না কী তৃণমূলের অর্থনীতি, কী তাদের আদর্শ।
ঠিক তেমনই এরা এখনও জানে না বিজেপি-র লক্ষ্য ও আদর্শের কথা, কোন অর্থনীতির কথা বলে বিজেপি অথবা সেই দলের রাজনৈতিক স্লোগানের মধ্যে আমাদের মিলেমিশে থাকা সমাজ জীবনে বিপর্যয়ের কোনও ইঙ্গিত আছে কি না। তাদের এ সব ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তারা শুধু চারপাশে যা ঘটে চলেছে, তার পরিবর্তন চাইছে।
বাম আমলে শিল্পাঞ্চলের যুবক দেখেছে সারি সারি বন্ধ কারখানা। সেই বন্ধ কারখানার জমিতে পার্টি অফিসের প্রশ্রয়ে বহুতল নির্মাণ। অর্থাৎ প্রোমোটার রাজ। পার্টির নেতাদের প্রোমোটার বনে যাওয়া। কোনও কোনও বহুতলে প্রোমোটারের বদান্যতায় পার্টি অফিস তৈরি হওয়া। শহরাঞ্চল ও শহরের লাগোয়া প্রায় সর্বত্রই প্রভাবশালী নেতার ছত্রচ্ছায়ায় থাকা কমরেড বা হাফ-নেতারা একই ব্যাধিতে আক্রান্ত। কিছু কমরেড, কিছু হাফ-নেতা জমির দালালি, ঠিকাদারি, প্রোমোটারি, বাড়ি করার অনুমতি দিয়ে অর্থ আদায়, বিল্ডিং মেটেরিয়াল সাপ্লাই বা কালোয়ারি ব্যবসা, এমনকী সুদের ব্যবসা করার মতো পেশায় যুক্ত হয়ে পড়েছিলেন।
আর গ্রামাঞ্চলে যে মোড়লতন্ত্রকে হঠিয়ে সাধারণ মানুষের ক্ষমতায়নের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তাকেও উপরে ফেলে কমরেডদের হাত ধরে ফের মোড়লতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাও মানুষকে পরিবর্তন চাইতে বাধ্য করেছিল। ১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে তৎকালীন সিপিআইএম-এর রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত বলেছিলেন, “গ্রাম পঞ্চায়েত হল এমনই একটি ধারালো অস্ত্র যা দিয়ে শত্রু পক্ষকে কাটতে কাটতে এগোনো যাবে। যদি ঠিক মতো ওই অস্ত্র ব্যবহার করা না যায়, তাহলে নিজেদের জখম হতে হবে।”
চুরুটসেবী প্রয়াত রাজ্য সম্পাদকের এই মন্তব্য ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পরে নিশ্চয় আলিমুদ্দিনের কর্তাদের মনে পড়েনি। পড়লে তাঁরা হয়তো সতর্ক হতেন। সে ক্ষেত্রে হয়তো আজকে নৌকা পুড়িয়ে ঘাটে নামার মতো অবস্থা হত না। বাম আমলের পার্টির প্রভাব খাটিয়ে অনিয়ম বা সামাজিক অপরাধ তো মানুষ চট ঘেরা টেবিলে রাখা মেশিনে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু যে আশায় তা করেছিলেন, তার কি আদৌ কোনও পরিবর্তন হয়েছে?
এই প্রশ্নের উত্তরে যদি না বলেন তাহলে ভুল হবে। বাম আমলের বেনিয়ম বা অসামাজিক কাজের মহীরুহগুলো রং পাল্টে একই থেকে গিয়েছে। অন্য দিকে চারাগাছগুলো মহীরুহ হয়ে উঠেছে। এই চারাগাছ থেকে মহীরুহ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াতে কিছু পরিবর্তন এসেছে। বাম আমলের চারাগাছ সিন্ডিকেটরাজ আর তোলাবাজি যেমন এখন মহীরুহে পরিণত হয়েছে, তেমনই ওই দুই অবৈধ বাবসায় অভিনবত্ব এসেছে।
বাম আমলে বাড়ি করতে গেলে বা কারখানা গড়তে গেলে পার্টি অফিস বা ইউনিয়নের দাপট দেখিয়ে তোলাবাজি চলত। এখন সে সব তো আছেই, তার সঙ্গে যোগ হয়েছে আরও অনেক কলাকৌশল। যেমন দমদম, বাগুইআটি, কেষ্টপুর, নিউটাউন বা রাজারহাট এলাকায় চলছে অদ্ভুত উপায়ে তোলাবাজি। ধরুন আপনি বাড়ি করছেন, আপনি প্রোমোটার হতে পারেন। আপনি বসবাসের জন্যও বাড়ি করতে পারেন। কিন্তু তোলা আপনাকে দিতেই হবে।
কেন দিতে হবে? কারণ আপনার নির্মীয়মাণ বাড়ি অথবা বহুতল বাড়িতে অসামাজিক কাজ চলছে। আপনি সেই কাজে মদত দিচ্ছেন।
কী রকম অসামাজিক কাজ চলছে? সন্ধ্যা নামলেই আপনার বাড়ি অথবা বহুতলে কিছু যুবক মদ্যপান ও জুয়ার আসর বসাচ্ছে। সমাজে তো এ সব চলতে পারে না। পুলিশে তো নালিশ করতেই হবে। একমাত্র উপায় স্থানীয় নেতাকে নগদ অর্থ ধরে দেওয়া। তা হলেই এড়ানো যাবে থানা-পুলিশ।