অ্যাস্ট্রোস্যাট নিয়ে রকেট উড়ল। সোমবার শ্রীহরিকোটায়। ছবি: পিটিআই।
পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক....।
গুনতির রেশ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই আগুনের শিখা ছড়িয়ে রকেট উড়ল আকাশ ফুঁড়ে। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে পুলিকট হ্রদ লাগোয়া শ্রীহরিকোটার সতীশ ধবন মহাকাশকেন্দ্র জুড়ে মালুম হল তার প্রতিক্রিয়া— গুমগুমগুম শব্দে। উৎক্ষেপণস্থলের সাত কিলোমিটার দূরে মিডিয়া সেন্টারও রেহাই পেল না। মাটিতে ধাক্কা দিয়ে রকেটের ঊর্ধ্বগমনের পাল্টা অভিঘাতে থরথর করে কেঁপে উঠল চারতলা বাড়িটা!
সোমবার কাঁটায় কাঁটায় সকাল দশটায় এ ভাবেই পিএসএলভি সি-৩০ রকেটে সওয়ার হয়ে মহাকাশে পাড়ি দিল অ্যাস্ট্রোস্যাট। ভারতের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি কৃত্রিম উপগ্রহ, যার উপরে বর্তেছে ব্ল্যাক হোল-সহ ব্রহ্মাণ্ডের বিবিধ রহস্য সন্ধানের ভার। পাঁচ বছর ধরে মহাকাশে চক্কর মারতে মারতে সে ওই দায়িত্ব পালন করে যাবে। তার ভূমিকা হবে পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের। চোখের সামনে ধীরে ধীরে মেঘের ও-পারে মিলিয়ে গেল পিএসএলভি। তার চলার চিহ্ন তখনও ছড়িয়ে আকাশ জুড়ে। মেঘের বুক চিরে যেন সরু এক ফালি রাস্তা! তুলিতে আঁকা!
বেলা সওয়া বারোটা। সাংবাদিক সম্মেলন করে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইসরো) কর্তারা জানালেন, ঘড়ির কাঁটা মেপে ঠিক ১০টা ২২ মিনিটে তাঁদের ‘দূত’ পৌঁছে গিয়েছে ভূপৃষ্ঠের সাড়ে ছ’শো কিলোমিটার উপরের নির্দিষ্ট কক্ষপথে। তাকে শক্তি জোগানোর জন্য খুলে গিয়েছে সোলার প্যানেল। এবং এতটা পথ পাড়ি দিয়েও সে রীতিমতো তরতাজা। ইসরো-র ইন্ডিয়ান স্যাটেলাইট সেন্টারের অধিকর্তা মিলস্বামী আন্নাদুরাই জানিয়েছেন, অ্যাস্ট্রোস্যাটের তোলা ছবি আসতে এখনও মাস দুয়েক। ছবিগুলো বিশ্লেষণ করে প্রাথমিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে আরও মাস চারেক লাগবে ধরে নেওয়া যায়।
সে যা-ই হোক, উৎক্ষেপন সফল হতেই টুইটার-ফেসবুকে শুভেচ্ছাবার্তার ঢল নেমেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী টুইটারে ইসরো’কে অভিনন্দন জানিয়েছেন। আবার প্রকল্পের ‘জন্মবৃত্তান্ত’ নিয়ে ফেসবুকে স্মৃতিচারণ করেছেন পুণের ইন্টার ইউনিভার্সিটি সেন্টার অব অ্যাস্ট্রোনমি অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিক্স (আইইউকা)-এর বর্তমান অধিকর্তা সোমক রায়চৌধুরী। লিখেছেন, ১৯৯৬-এ ইসরোর বেঙ্গালুরু সদরের বৈঠকে এমন একটি প্রকল্পের প্রস্তাব উঠেছিল। ইসরোর তৎকালীন চেয়ারম্যান কৃষ্ণস্বামী কস্তুরীরঙ্গন তাতে সায় দিয়েছিলেন।
মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ, পুণের আইইউকা, বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এর মতো দেশের প্রথম সারির গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সেই পরিকল্পনাকেই এ দিন বাস্তব রূপ দিল ইসরো। যে সাফল্যের হাত ধরে মহাকাশ গবেষণায় নতুন ধাপ টপকে গেল ভারত। এ যাবৎ মহাকাশ কিংবা চাঁদ-মঙ্গলের মধ্যে তার যাতায়াত সীমাবদ্ধ ছিল। এ বার মহাকাশে নিজস্ব পর্যবেক্ষণকেন্দ্র মজুত করে জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যোতিঃপদার্থবিদ্যার তাত্ত্বিক গবেষণাও ভারত শুরু করে দিল। চলে এল ‘অভিজাত’ তালিকায়। কী রকম?
এর আগে আমেরিকা (সঙ্গী ইউরোপীয় ইউনিয়ন), রাশিয়া ও জাপান এমন গবেষণায় হাত দিয়েছে। তালিকায় ভারতই হচ্ছে চতুর্থ দেশ। ‘‘চাঁদ-মঙ্গলে সফল অভিযানের সুবাদে মহাকাশ অভিযান ও উৎক্ষেপণ-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (নাসা) এবং ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ইসা)-র সঙ্গে টক্কর দেওয়ার জায়গায় আমরা আগেই চলে এসেছিলাম। এ দিনের সাফল্য সেই মুকুটে আর একটা উজ্জ্বল পালক জুড়েছে।’’— দাবি এক বিজ্ঞানীর।
কী ভাবে জুড়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে গবেষকদের অনেকের বক্তব্য: বিভিন্ন মহাজাগতিক রশ্মি চিহ্নিতকরণের জন্য অ্যাস্ট্রোস্যাটে বসানো হয়েছে পাঁচ-পাঁচটা ‘চোখ।’ যার কল্যাণে তথ্যের জন্য তাঁদের আর বিদেশিদের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হবে না। বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাস্ট্রোফিজিক্সের শিক্ষক সুজন সেনগুপ্তের প্রতিক্রিয়া, ‘‘এখন তো আমরাই তথ্য লেনদেনের জায়গায় পৌঁছে গেলাম।’’
ইসরো-সূত্রের খবর: ব্রহ্মাণ্ডের রহস্য সন্ধানে ১৯৯০-এ নাসা ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথ ভাবে ‘হাবল’ নামে একটি টেলিস্কোপ পাঠিয়েছে মহাকাশে, গত ২৫ বছর ধরে যে নানা ধরনের তথ্য জুগিয়ে এসেছে। ২০০৫-এ জাপান, তার পরে রাশিয়া একই ধরনের টেলিস্কোপবাহী উপগ্রহ মহাকাশে পাঠালেও হাবলের তথ্যই ছিল গবেষকদের মূল ভরসা। এখন অ্যাস্ট্রোস্যাটকে অনেকে ‘ভারতীয় হাবল’ হিসেবে ডাকতে শুরু করেছেন। দুয়ের তুলনাও শুরু হয়ে গিয়েছে।
ইসরো-কর্তারা অবশ্য প্রকাশ্যে এ হেন তুলনায় যেতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, হাবলের সঙ্গে অ্যাস্ট্রোস্যাটের বিস্তর ফারাক। ঘটনা হল, এই সূত্রেই ইসরো-র চেয়ারম্যান এএস কিরণকুমার এ দিন তুলে এনেছেন ভারতীয় প্রকল্পের ‘নিজস্বতা’র প্রসঙ্গ। জানিয়েছেন, হাবল-অ্যাস্ট্রোস্যাট তুলনা চলে না ঠিকই। কিন্তু অ্যাস্ট্রোস্যাটে এক্স-রশ্মি বা অতিবেগুনি রশ্মি ধরার যে টেলিস্কোপ আর স্ক্যানিং স্কাই মনিটর নামে যন্ত্র বসানো রয়েছে, তা বর্তমান সময়ের তুলনায় যথেষ্ট আধুনিক। ‘‘হাবল অনেক বড় ক্ষেত্রে গবেষণার জন্য তৈরি। আমরা অত বড় আকারে কিছু না-করলেও স্বাতন্ত্র বজায় রেখেছি।’’— মন্তব্য তাঁর।
সরাসরি না-বললেও উন্নত দুনিয়ার উদ্দেশে কার্যত চ্যালেঞ্জ-ই ছুড়েছেন ইসরো-চেয়ারম্যান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy