বড়কুরবাড়ি গ্রাম দিয়ে বয়ে চলা রাঙাপানিয়া। ফাইল চিত্র।
তেষ্টা পেয়েছে রাঙাপানিয়ার!
সে নদীর বুকে যা জল তাতে তার নিজের তেষ্টাই মেটে না। দাঁড়িয়ে আছি রাঙাপানিয়ার ঠিক পাশটিতে। দুপুরের কড়া রোদ কিঞ্চিৎ মিঠে করে দিচ্ছে তার বুকের উপর দিয়ে বয়ে আসা হাওয়া। রাঙাপানিয়ার উপর ইস্পাতের কাঠামোর সেতু হয়েছে অনেক বছরের কাকুতি-মিনতির পর। আগে ছিল বাঁশের। মাঝে মাঝেই সে হেলে পড়ত। এখন ইস্পাতের কাঠামোর উপরে কাঠের পাটাতন পাতা। তার উপর দিয়ে মোটরবাইক যেতে পারে।
এ পারে বড়কুরবাড়ি গ্রাম। বড়কুরবাড়ি কোথায়? আগরতলা শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামটি যে বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত, সেই চড়িলাম (সংরক্ষিত) কেন্দ্রটি অধুনা বিখ্যাত এখানকার বিজেপি প্রার্থী যিষ্ণু দেববর্মণের জন্য। যিষ্ণু সদ্য ত্রিপুরার উপ-মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন। যদিও এই কেন্দ্রে এ বার ভোট স্থগিত হয়ে যায় এখানকার সিপিএম প্রার্থী রমেন্দ্র নারায়ণ দেববর্মার অকাল প্রয়াণে। এই কেন্দ্রে পুনর্নির্বাচন হচ্ছে সোমবার, ১২ মার্চ। ভোটগণনা ১৫ মার্চ, বৃহস্পতিবার।
যে জনজাতি ছিল বাম শক্তির অন্যতম প্রধান শক্তি, সেই জনজাতি এ বার এ ভাবে সিপিএমের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল কেন? ত্রিপুরার বিভিন্ন প্রান্তের উপজাতীয় এলাকায় পা রাখলেই এর উত্তর নানা ভাবে মেলে। যেমন, এই চড়িলাম। চড়িলাম বাজারে বসে সে কথাই জানাচ্ছিলেন অমূল্য দেববর্মা। ২৩ বছর সিপিএমের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ছিলেন স্থানীয় সমবায় সমিতির চেয়ারম্যানও। কিন্তু দল ছাড়েন দুর্নীতির প্রশ্নে। বলেন, ‘‘মুখ খুললেই ওরা বলত দলবিরোধী কাজ বরদাস্ত করা হবে না। তার পরেই বিজেপিতে যোগ দিই।’’
স্থানীয় স্বপন দেববর্মা বলেন, ‘‘উপজাতিদের সঙ্গে দিনের পর দিন বঞ্চনা করা হয়েছে। গ্রামে ঘুরে দেখুন রাস্তার হাল, স্বাস্থ্যের হাল।’’ স্বপনবাবু ছিলেন কংগ্রেসে। ২০১৩-র বিধানসভা ভোটের পর যোগ দেন বিজেপিতে। বস্তুত, চড়িলামের বহু গ্রামেই দলে দলে কংগ্রেস কর্মী বিজেপির হয়ে এ বার কাজ করেছেন বলে শোনা গিয়েছে। বহু সিপিএম কর্মী হয় দল ছেড়েছেন অথবা বসে গিয়েছেন।
আরও পড়ুন: হাজির মোদী-শাহ, মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ বিপ্লব দেবের
বঞ্চনার অভিযোগ কী ধরনের? যেমন, চড়িলামের বাঁশতোলি এলাকার যুগতলি গ্রামের বিশ্বম্ভর দেববর্মা বললেন, ‘‘ঠিকমতো খাবার জল পাই না। পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শ্যালো পাম্প কিনেছি। টিউবওয়েলও বসাতে হয়েছে।’’ এলাকা বিদ্যুৎ এসেছে বটে, কিন্তু সবার ঘরে তা পৌঁছয়নি বলে এলাকাবাসীর অভিযোগ। কেন? কারণ, বিদ্যুতের খুঁটি বসানোর টাকা অনেকেরই হাতে নেই। স্থানীয় মানুষই জানিয়েছেন, অনেকেই ‘হুকিং’ করে বিদ্যুৎ নিয়েছেন বাধ্য হয়ে। বছরের পর বছর ইট পাতা রাস্তা। বর্ষাকালে চলাফেরা প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে।
যুগতলি গ্রামে প্রায় ১৬০ ঘরের বাস। সকলেই দেববর্মা। কেমন আছেন? প্রশ্নের উত্তরটা এ ভাবেই দিলেন প্রৌঢ় বিরহরি দেববর্মা: ‘‘কোনও উন্নয়ন হয়নি। ভাল নেই আমরা।’’ তা হলে যে এডিসি এলাকায় (স্বশাসিত জেলা পরিষদ) প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে বলে সিপিএম দাবি করছে? বিরহরির সাফ কথা: ‘‘আগরতলায় বসে ও সব অনেক কিছু বলা যায়। নিজে ঘুরে দেখুন না।’’
নলজলা গ্রাম সংখ্যালঘু প্রভাবিত। প্রায় তিনশো পরিবারের বাস এ গ্রামে। সেখানেই কথা হচ্ছিল জাহাঙ্গির হোসেনের সঙ্গে। জানালেন, বিশ্রামগঞ্জের প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রই ভরসা। বেশি কিছু হলে আগরতলা শহরে যেতে হয়। তিনি ও তাঁর মা অবশ্য কলকাতায় যান চিকিৎসা করাতে।
এত কথার মধ্যে উপজাতিদের জন্য পৃথক রাজ্যের প্রসঙ্গ ওঠা মাত্রই অবশ্য সতর্ক হয়ে যান কামাল হোসেনরা। তাঁর কথায়: ‘‘কী ভাবে সম্ভব আলাদা রাজ্য গঠন? এটা অন্য ভাবে বিবেচনা করে দেখা উচিত।’’
একশো দিনের কাজ নিয়েও অভিযোগ বিস্তর। বড়কুরবাড়ি গ্রামে কার্যত ঘিরে ধরেন সুখেন্দু দেববর্মা, বুদ্ধিকুমার দেববর্মা, জ্যোতিলাল দেববর্মা, সুকুমার দেববর্মারা। এত দূর এসেছেন গ্রামের অবস্থা দেখতে? আমরা কেমন আছি দেখতে? গলায় কিঞ্চিৎ অবিশ্বাস ও অভিমানের সুর মেলানো। সুখেন্দু বলেন, ‘‘আমরা কেমন আছি, কেউ খোঁজ নেয়? সিপিএম খোঁজ নিয়েছে? এডিসি নিয়ে এত কথা বলে ওরা। সব বাজে কথা। এর নাম উন্নয়ন? এই জন্যই তো ভোটে ওদের এ রকম হল। তবে এ বার উপ-মুখ্যমন্ত্রী নিশ্চয়ই এলাকার জন্য কিছু করবেন।’’ স্থানীয় প্রমোদনগর হায়ার সেকেন্ডারি স্কুলের পলিটিক্যাল সায়েন্সের শিক্ষক কুঞ্জ দেববর্মা বলতে থাকেন, ‘‘আমরা সত্যিই বঞ্চিত। রাস্তাঘাট-শিক্ষা-স্বাস্থ্য, সব খারাপ। নেতাদের ব্যবহার আরও খারাপ। উপজাতীয়রা কি অন্যদের দয়ায় বেঁচে থাকবে? আমাদের এই পাহাড়ি এলাকা কেন বছরের পর বছর পিছিয়ে থাকবে?’’
অসংখ্য প্রশ্ন বুকে নিয়ে বয়ে চলে রাঙাপানিয়া। তার বুকে অগাধ তৃষ্ণা। ‘চলো পাল্টাই’-এর ডাকে সাড়া দিয়েছে গোটা ত্রিপুরা।
অনুন্নয়নের খরা কবে উন্নয়নের স্রোতে ভেসে যাবে, সে অপেক্ষায় রইল রাঙাপানিয়া!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy