ঠিক উল্টো দিকে তাঁর নেতৃত্বাধীন বেঞ্চই নরেন্দ্র মোদী সরকারকে স্বস্তি দিয়ে আধার-এ সবুজ সঙ্কেত দিয়েছে। মসজিদ ইসলামে আবশ্যিক নয় বলে যে রায় দিয়েছে, তা রামমন্দির-বাবরি মসজিদ মামলাকে প্রভাবিত করবে বলেই ধারণা আইনজীবী মহলের বড় অংশের। আর সেই সম্ভাবনার আঁচ পেয়ে উল্লসিত বিজেপি-সঙ্ঘ। সবশেষে ভীমা কোরেগাঁও মামলায় সমাজকর্মীদের গ্রেফতারিতে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি নাকচ করেছে, যাতে খুশি বিজেপি সরকার— দু’পক্ষই।
ভীমা কোরেগাঁও মামলার রায় ঘোষণার আগে শুক্রবার প্রবীণ আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিংহ বলেছিলেন, ‘‘শেষ বিচারের সময় দেখা হবে, বিচারক লোয়া মৃত্যুরহস্যে তদন্ত দাবির মামলা, আধার ও ভীমা কোরেগাঁও মামলায় প্রধান বিচারপতি মিশ্র কী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যতই তিনি পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সমান ন্যায়ের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিন, দুঃখের কথা হল, সেগুলো কিন্তু শেষ বিচারের সময় দাঁড়াবে না।’’ আর রায়দানের পরে ইন্দিরা বলছেন, ‘‘বিদায়ী প্রধান বিচারপতি নিজেই নিজের উত্তরাধিকারে টোল ফেলে গেলেন। আপনি নাগরিক স্বাধীনতায় বিশ্বাস না করে, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে সমতায় বিশ্বাস করতে পারেন না। এ ভাবে ন্যায়ের বিভাজন হয় না।’’
প্রবীণ আইনজীবীরা এ কথা বলার সুযোগ পাচ্ছেন। কারণ শেষবেলায় প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের যে তিনটি রায়ে বিজেপি বা মোদী সরকার খুশি হয়েছে, তার কোনওটিই ঐকমত্যের ভিত্তিতে হয়নি। আধার এবং ভীমা কোরেগাঁও মামলায় প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন বিচারপতি ধনঞ্জয় চন্দ্রচূড়, ইসলাম ও মসজিদ সংক্রান্ত মামলায় বিচারপতি এস আবদুল নাজির।
মিজোরামের এজি তথা প্রবীণ আইনজীবী বিশ্বজিৎ দেব বলেন, ‘‘প্রধান বিচারপতির শেষবেলায় প্রতিটি রায়ই নিঃসন্দেহে মাইলফলক। সামাজিক ক্ষেত্রে তার প্রভাব সুদূরপ্রসারী। কিন্তু ইসলামে মসজিদের আবশ্যিকতা নিয়ে রায়ের সঙ্গে রামমন্দির-বাবরি মসজিদ মূল মামলার যোগসূত্র থেকেই যায়। মূল মামলাতেও এর সূক্ষ প্রভাব পড়তে পারে।’’ তাঁর যুক্তি, ‘‘এই রায় নিয়ে রাজনৈতিক সুবিধা নিতে বিজেপির নেমে পড়াটা চিন্তার কারণ। কারণ সংবিধানে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর কথাই বলা হয়েছে।’’
সুপ্রিম কোর্টের ৪৫-তম প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের বিরুদ্ধেই সরকারের চাপে বিচারবিভাগের স্বাধীনতা বিসর্জন দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল। সুপ্রিম কোর্টের চার প্রবীণ বিচারপতি নজিরবিহীন ভাবে প্রকাশ্যেই প্রধান বিচারপতির কাজ নিয়ে সরব হন। তাঁকে ইমপিচমেন্টের প্রস্তাবও ওঠে। একদিকে ব্যক্তি পরিসরের অধিকারকে মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া বা সমকামিতাকে স্বীকৃতি দিয়ে ৩৭৭ ধারা নাকচ করা, উল্টো দিকে বিচারক লোয়ার মৃত্যুরহস্যে তদন্তের দাবি খারিজ— কুর্নিশ ও সমালোচনা দুইই শুনতে হয়েছে তাঁকে।
নীরব থেকেই এত দিন সঙ্কট ও সাফল্যের সময় পেরিয়ে এসেছেন। সোমবারই সুপ্রিম কোর্টের এক নম্বর এজলাসে তাঁর শেষ দিন। সে দিনই বিকেলে বিদায় সংবর্ধনা। বিদায়ের আগে কি প্রধান বিচারপতি নিজের উত্তরাধিকার নিয়ে নীরবতা ভাঙবেন? সেটাই এখন প্রশ্ন।