সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের আঁচ শুধু রাজ্যের গণ্ডিতে বাঁধা থাকেনি। একই পথে অন্যান্য রাজ্যেও একই ধরনের আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। এ বার সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ও বিভিন্ন রাজ্যের সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মামলায় ছায়া ফেলবে বলে মনে করছে আইনি মহলের বড় অংশ।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী থেকে শুরু করে নানা রাজ্যের সরকারি আইনজীবী— এঁদের অনেকেই বলছেন, বিভিন্ন রাজ্যে বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বহু মামলা সুপ্রিম কোর্টে ঝুলে রয়েছে। সেগুলির উপরে সিঙ্গুর-রায়ের প্রভাব পড়ার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। পাশাপাশি ওঁরা মনে করছেন, এই রায়ের জেরে ভবিষ্যতে রাজ্যগুলো বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করতে গিয়ে অনেক হুঁশিয়ার হয়ে পা ফেলবে।
বস্তুত সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের জমি-আন্দোলনের আঁচ সারা দেশ এতটাই পুইয়েছিল যে, কেন্দ্রের তদানীন্তন ইউপিএ সরকারকে কৃষকস্বার্থের কথা মাথায় রেখে নতুন জমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন আইন প্রণয়ন করতে হয়। মোদী সরকার ‘শিল্পের সুবিধার্থে’ যার শর্ত শিথিল করতে চেয়েও পিছিয়ে এসেছে। সংসদে আইনও পাশ করতে পারেনি। একাধিক বার অর্ডিন্যান্স জারি করে হাল ছেড়ে দিয়েছে।
এরই মধ্যে বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে বহু মামলা সর্বোচ্চ আদালতে এসে জমেছে। উদাহরণ দিতে গিয়ে আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণ বলেন, ‘‘ছত্তীসগঢ়ে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত বেশ কিছু মামলা এখানে ঝুলছে। স্বাভাবিক ভাবেই সে সবের উপরে সিঙ্গুর-রায়ের প্রভাব পড়বে।’’ কী ভাবে?
প্রশান্তের ব্যাখ্যা, ‘‘এখানেও জনস্বার্থের যুক্তিতে বেসরকারি শিল্পসংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে। সুপ্রিম কোর্ট যে সব কারণ দেখিয়ে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ খারিজ করল, তার মধ্যে এটাই প্রধান।’’ সুপ্রিম কোর্টের আর এক প্রবীণ আইনজীবী কলিন গঞ্জালভেসের পর্যবেক্ষণ— এত দিন যে ভাবে শিল্পসংস্থার জন্য জমি অধিগ্রহণ হয়েছে, সিঙ্গুরের রায় তা বদলে দিতে চলেছে। ‘‘এ যাবৎ শিল্পপতিরা রাজার মতো হেলিকপ্টারে চড়ে এসে মুখ্যমন্ত্রীকে বলতেন, আমার ওই জমিটা চাই। রাজ্য সরকার সেটাই তাঁকে জোগাড় করে দিত। এখন সিঙ্গুরের রায় তাঁদের সতর্ক করে দেবে। আইন মেনে, সব শর্ত মেনেই অধিগ্রহণ করতে হবে।’’
পুরনো আইনে বলা ছিল, জনস্বার্থে প্রয়োজন হলে রাজ্য শিল্পের জমি অধিগ্রহণ করবে। কিন্তু সেখানে দেখতে হবে, কোথায় বহুফসলি জমিতে তুলনায় কম হাত পড়ছে, কোথায় কৃষকদের আপত্তি কম উঠছে। অধিগৃহীত জমি থেকে বিভিন্ন শিল্পসংস্থাকে প্রয়োজন অনুযায়ী জমি বরাদ্দ করতে হবে। অথচ অভিযোগ, সিঙ্গুরে এর উল্টোটা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছেছে— সিঙ্গুরে টাটা মোটর্স আগেই জমি পছন্দ করে ফেলেছিল। পরে তা অধিগ্রহণ করা হয়। সরকারি নথিও তা-ই বলছে।
এমতাবস্থায় অন্যান্য রাজ্য সরকার ভবিষ্যতে সতর্ক থাকবে বলে মনে করছেন বিভিন্ন রাজ্যের আইনি উপদেষ্টারা। যেমন কংগ্রেসশাসিত মিজোরামের অ্যাডভোকেট জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবের কথায়, ‘‘রাজনৈতিক দিক থেকে দেখলে, এই রায়ে মমতার আন্দোলন আইনি স্বীকৃতি পেয়ে গেল। আবার আইনি দিক থেকে দেখলে, এই রায় সব রাজ্যের প্রতি হুঁশিয়ারিও বটে। যাতে কোনও রাজ্য ভবিষ্যতে জনস্বার্থের নাম করে বেসরকারি শিল্পসংস্থার জন্য চাষের জমি অধিগ্রহণ না করে।’’
তবে একান্তই কৃষিজমি অধিগ্রহণ করতে হলে তা যাতে পুরোপুরি আইন মেনে করা হয়, সে কথাটাও সুপ্রিম কোর্ট এ দিন স্পষ্ট মনে করিয়ে দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন আইনজীবীরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy