Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

নেতাজি ফাইল নিয়েও চাপ আডবাণীর

রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন ফাইল প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে যখন চাপে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক তখনই সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী।

জয়ন্ত ঘোষাল
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০৩:৩১
Share: Save:

রাজ্য সরকারের হেফাজতে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত ৬৪টি গোপন ফাইল প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় সরকারকে যখন চাপে ফেলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ঠিক তখনই সেই চাপ আরও বাড়িয়ে দিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণী। প্রবীণ বিজেপি নেতার দাবি, কেন্দ্রের কাছে নেতাজি সংক্রান্ত যা ফাইল আছে তার সবই প্রকাশ করে দেওয়া হোক। তাঁর কথায়, ‘‘যত দিন না সমস্ত ফাইল ডিক্লাসিফাই করা হবে, তত দিন নেতাজি নিয়ে রহস্য থেকে যাবে। নানা ধরনের গুজব চলতেই থাকবে। সমস্ত গুজব বন্ধ হয়ে যাবে যদি ফাইলগুলি প্রকাশ করে দেওয়া হয়।’’

বিরোধী আসনে থাকার সময় বিজেপি নেতাজি ফাইল প্রকাশের ব্যাপারে সওয়াল করত। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পরে তারা আগের ইউপিএ সরকারের পথ অনুসরণ করে চলছে বলেই অভিযোগ। নরেন্দ্র মোদী সরকারেরও বক্তব্য, ফাইলগুলি প্রকাশ করে দিলে অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ নিয়ে সাবধানে পদক্ষেপ করা প্রয়োজন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতাজি-ফাইল প্রকাশ করার পরের দিনই, অর্থাৎ ১৯ সেপ্টেম্বর, সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলেন, ‘‘কেন্দ্র এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দেখতে হবে ওই সব ফাইলে কী রয়েছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার কী প্রভাব পড়বে। অন্য দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক, বিশেষ করে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে কী প্রভাব পড়বে, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার।’’

আসলে নেতাজি-ফাইল নিয়ে খানিকটা কৌশলী পদক্ষেপ করার পরিকল্পনাই ছিল মোদী সরকারের। গত ষোলো মাসে নেতাজি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক করেছেন প্রধানমন্ত্রী। আগামী মাসে বসু পরিবারের প্রায় ৫০ জন সদস্যের সঙ্গে ফের বৈঠক করবেন তিনি। কেন্দ্রের হাতে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত গোপন ফাইলগুলি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটিও গড়ে দিয়েছেন মোদী। তার পর গত এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে থাকা নেতাজি সংক্রান্ত ৪১টি গোপন ফাইলের মধ্যে দু’টি জনসমক্ষে আনে কেন্দ্র। (এ ছাড়াও বিদেশ মন্ত্রকে ২৭টি, ইনটেলিজেন্স ব্যুরোয় ৭৭টি ফাইল রয়েছে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকে রয়েছে ৬০ হাজার পাতার নথি) তাতে দেখা যায়, স্বাধীনতার পরে প্রায় তিন দশক ধরে বসু পরিবারের সদস্যদের উপরে নজরদারি চালাত পুলিশ। এই খবর প্রকাশিত হওয়ার ফলে অস্বস্তিতে পড়ে কংগ্রেস, কারণ, ওই সময়ে কেন্দ্র ও রাজ্য দু’জায়গাতেই ক্ষমতায় ছিল তারা। বিজেপি সূত্র বলছে, এ ভাবে ধাপে ধাপে বাছাই ফাইল প্রকাশ করে কংগ্রেসকে বিড়ম্বনায় ফেলে রাজনৈতিক ফায়দা তোলাই মোদী সরকারের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু মমতা এক লপ্তে সব ফাইল প্রকাশ করে দিয়ে তাদের বিপাকে ফেলে দিয়েছেন। আর এ বার চাপ বাড়ালেন আডবাণী।

এখন প্রশ্ন হল, আডবাণী নিজেই তো টানা ছ’বছর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন। ছিলেন দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রীও। তা হলে তখন তিনি নিজেই কেন নেতাজি-ফাইল প্রকাশ করে দেননি? আডবাণীর জবাব, ‘‘সে সময় এ ব্যাপারে কেউ কোনও দাবি তোলেননি। এটা তখন কোনও ইস্যু ছিল না।’’ ফরওয়ার্ড ব্লকের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস অবশ্য বলেন, ‘‘অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে পরেই আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করে সমস্ত ফাইল অবিলম্বে প্রকাশ করার দাবি জানাই। নেতাজি মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনের জন্য নতুন করে তদন্ত কমিশন গঠনেরও দাবি জানাই। বিচারপতি মুখোপাধ্যায় কমিশন গঠন হয় ১৯৯৯ সালে।’’ আডবাণীর বক্তব্য, ‘‘তদন্ত কমিশনের ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভায় সর্বদলীয় প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং হাইকোর্টও জনস্বার্থ মামলার ভিত্তিতে নির্দেশ দেয়। তাই তখন নতুন কমিশনের নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই কমিশনের রিপোর্টও বিতর্কের অবসান ঘটায়নি।’’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকলেও নেতাজি সংক্রান্ত গোপন ফাইলগুলি তিনি দেখেননি বলেও দাবি করেন লালকৃষ্ণ আডবাণী।

সাম্প্রতিক অতীতে এই নিয়ে দ্বিতীয় বার বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদী সরকারকে বিড়ম্বনায় ফেললেন আডবাণী। গত জুন মাসে ললিত মোদীকে ঘিরে বিতর্ক যখন তুঙ্গে, সুষমা স্বরাজ-বসুন্ধরা রাজের অপসারণের দাবিতে বিরোধীরা সরব, তখন সেই আঁচ গায়ে না-লাগিয়েও আডবাণী মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, নব্বইয়ের দশকের মধ্যভাগে হাওয়ালা কেলেঙ্কারিতে নাম জড়ানোমাত্র তিনি সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দিয়‌েছিলেন। এই প্রতিবেদককে একান্ত সাক্ষাৎকারে আডবাণী বলেছিলেন, নিজের বিবেকের ডাকে সাড়া দিতে সে দিন বাজপেয়ীর বারণও উপেক্ষা করেছিলেন। তদন্তে নির্দোষ প্রমাণিত না-হওয়া পর্যন্ত লড়েননি নির্বাচনে। ‘রাজধর্ম’ পালনের যে পরোক্ষ পরামর্শ সে দিন আডবাণী দিয়েছিলেন, তা অবশ্য মান্য করেনি বিজেপি। কিন্তু সেটা বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল বিরোধীদের। আডবাণীর মন্তব্য তুলে ধরে বারংবার সরকারকে কটাক্ষ করেছিল তারা, এ বারও আডবাণীর দাবির জেরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের উপরে চাপ বাড়তে পারে বলেই মনে করা হচ্ছে।

বিতর্ক দানা বাধছে মোদীর সঙ্গে নেতাজি পরিবারের সদস্যদের আসন্ন বৈঠক ঘিরেও। প্রধানমন্ত্রী দেখা করবেন নেতাজির ভাইপো অমিয়নাথ বসুর ছেলে চন্দ্র বসু-সহ পরিবারের আরও কিছু সদস্যের সঙ্গে। যাঁরা মোটের উপর তাইহোকুতে বিমান দুর্ঘটনায় নেতাজির মৃত্যুর তত্ত্বে বিশ্বাসী নন। অন্য দিকে, নেতাজির আর এক ভাইপো শিশির বসুর স্ত্রী কৃষ্ণা বসু এবং তাঁর ছেলে, তৃণমূল সাংসদ সুগত বসু বিশ্বাস করেন তাইহোকুতেই নেতাজির মৃত্যু হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছে, এঁদের সঙ্গে কেন দেখা করছেন না প্রধানমন্ত্রী? মোদীর দফতর অবশ্য জানাচ্ছে, চন্দ্র বসুরা দেখে করতে সময় চেয়েছিলেন, তাই তিনি দেখা করছেন। যাঁরা দেখা করতে চাইবেন, তিনি তাঁদের সঙ্গেই দেখা করবেন।

অনেকের আবার বক্তব্য, এত বৈঠক করার প্রয়োজন কী? নেতাজির ফাইলগুলি প্রকাশ করে দিলেই তো হয়। কারণ গোপনীয়তাই তো বহু আজগুবি কাহিনির জন্ম দেয়। চন্দ্র বসু হোন বা সুগত বসু, ফাইল প্রকাশের ব্যাপারে সওয়াল করেছেন নেতাজি পরিবারের সকলেই। এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যদি ৬৪টি ফাইল প্রকাশ করে দিতে পারেন, তা হলে মোদী পারবেন না কেন।

নেতাজি-প্রশ্নে মমতার পথেই হাঁটুন মোদী, প্রকারান্তরে এমন দাবি তুলে প্রধানমন্ত্রীর উপরে চাপ বাড়ালেন বিজেপির ‘লৌহপুরুষ’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE