Advertisement
E-Paper

‘গঙ্গার মতো ময়লা হলে বিয়েই হবে না’

কানপুরে জাজমৌ এলাকায় যত ট্যানারি রয়েছে, সেই ট্যানারির বর্জ্য মেশানো জল পরিস্রুত করে চাষের জন্য ব্যবহার শুরু হয়েছিল অতীতে।

দেবাশিস ঘড়াই

শেষ আপডেট: ০২ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:৫১
মেয়ের সঙ্গে গুড়িয়া। নিজস্ব চিত্র

মেয়ের সঙ্গে গুড়িয়া। নিজস্ব চিত্র

একচিলতে দাওয়া। খড়-বিচুলির ছাদ। আশপাশের মধ্যে দেড় হাতের মতো ছায়া বলতে ছাদের নীচটুকুই। কিছুটা দূরেই মেঠো পথে ধুলো উড়ছে। ভিতরে কোনও কাজ করছিলেন। ডাকাডাকি শুনে বেরিয়ে এলেন। পরিচয় জানার পরই ক্ষিপ্ত স্বরে দেহাতি হিন্দিতে বললেন, ‘‘কুছু নেহি হোগা। বহুত সারে লোগ আয়ে। কুছু নেহি হোনেওয়ালা ইধার।’’

গুড়িয়া ক্ষিপ্ত। গুড়িয়ার পায়ের কাছে এক বছরের মেয়ে মাটিতে খেলা করছে। ভিতরে বড় মেয়ে ঘরকন্নার কাজে ব্যস্ত। বড় মেয়ের বয়স মাত্র দশ! ছোট দুই ছেলে (১২ আর সাত বছরের) বাবার সঙ্গে খেতে কাজ করছে, না অন্য কোথাও ঘুরে বেড়াচ্ছে, বলতেই পারলেন না গুড়িয়া। ছ’জনের সংসার। সম্বল বলতে চাষের জমি। আর চাষ করতে গিয়েই বিপত্তি!

চাষের জন্য নালা দিয়ে যে জল আসছে, তাতে নানা দূষিত পদার্থ এত মিশে থাকছে যে হাত-পায়ের আঙুলে কালো ছোপ পড়ছে। অনেক জায়গায় ক্ষয়ে যাচ্ছে আঙুল। চর্মরোগ, পেটের রোগ হামেশাই লেগে রয়েছে। চাষের জমিও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ওই জলে। গুড়িয়া বলছিলেন, ‘‘আমাদের কথা বলে কী হবে! কে শুনবে?’’

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

কানপুরে জাজমৌ এলাকায় যত ট্যানারি রয়েছে, সেই ট্যানারির বর্জ্য মেশানো জল পরিস্রুত করে চাষের জন্য ব্যবহার শুরু হয়েছিল অতীতে। গঙ্গায় যাতে সরাসরি ট্যানারির বর্জ্য না মেশে, তাই কানপুরে এক সময় ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধনের প্লান্ট তৈরি হয়েছিল। তার মধ্যে একটি প্লান্ট আছে ওয়াজিদপুরে। সেই প্লান্টেরই জল যায় গুড়িয়াদের গ্রাম শেখপুর-সহ আরও ১৫টি গ্রামে। কিন্তু পরিস্রুত করার পদ্ধতিতে ত্রুটি থাকায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ফলে না বাঁচানো যাচ্ছে গঙ্গাকে, উল্টে জাঁতাকলে আটকে পড়ছে গুড়িয়াদের জীবন!

কানপুরের ট্যানারি যে শুধু গঙ্গা দূষণ করছে না, ভূগর্ভস্থ জলকেও ক্রমশ দূষিত করে তুলেছে, তা নিয়ে একাধিক রিপোর্টও ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। সেই ১৯৯৩ সালেই ট্যানারির জলের বিপদ সম্পর্কে সচেতন করে দিয়েছিল একটি সমীক্ষাকারী সংস্থা।

বন্ধ নালার পাশেই নমামি গঙ্গের বিজ্ঞাপন। নিজস্ব চিত্র

ট্যানারিগুলিতে পর্যাপ্ত পরিশোধনের প্লান্ট না থাকায় ভূগর্ভস্থ জলে যে ক্রমশ ক্রোমিয়াম মিশছে, তা নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্টে সে সময় শোরগোলও হয়েছিল।

কিন্তু আড়াই যুগ অতিক্রান্ত হওয়ার পরেও পরিস্থিতির বিন্দুমাত্র উন্নতি হয়নি। উত্তরপ্রদেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ মাস তিনেক আগে গঙ্গা দূষণের জন্য দায়ী ১৯টি ট্যানারি বন্ধের নির্দেশ দিলেও স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, সে সমস্ত নির্দেশ শুধু খাতায়-কলমেই! বাইরে থেকে তালা মারা থাকলেও ভিতরে-ভিতরে ঠিকই ট্যানারির কাজকর্ম চলে।

নমামি গঙ্গে প্রকল্পে কিছু হচ্ছে না?

গুড়িয়া আবারও ক্ষিপ্ত! জানালেন, যা কিছু কাজকর্ম, তা শুধুমাত্র গঙ্গার কয়েকটি ঘাটেই সীমাবদ্ধ। গুড়িয়া বলছিলেন, ‘‘নমামি গঙ্গে কা কোঈ জানকরী নেহি হ্যায় ইহা পে!’’ মাটিতে খেলা করা মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন। তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্বগতোক্তি করলেন, ‘‘তু বাস গঙ্গা জ্যায়সি মৈলী মত হো যা! ফির শাদি নেহি হোগি!’’ বলে নিজেই হেসে উঠলেন।

‘গঙ্গা জ্যায়সি মৈলী’!—অবাকই হতে হল। হিন্দি বলয়ে গঙ্গা মাঈয়া, মুখে-মুখে ঘোরা গঙ্গার স্তব। সেখানে প্রান্তিক এক মা একরত্তি মেয়ের গায়ের রঙের সঙ্গে কানপুরের দূষিত গঙ্গার অনায়াস তুলনা টানলেন!

এমনিতে কানপুরের গঙ্গা দেশের মধ্যে সর্বাধিক দূষিত। লাবণ্যহীন, রুক্ষ, শুষ্ক। শিল্পাঞ্চলের, বিশেষ করে ট্যানারি-বর্জ্য সরাসরি মিশতে-মিশতে গঙ্গা জলের চরিত্রই পাল্টে গিয়েছে এখানে। জলে স্রোত নেই। বুকে চড়া। নমামি গঙ্গে প্রকল্পে নিকাশি নালাগুলি বন্ধের কাজ চলছে বটে। কিন্তু তাতে আরেক বিপত্তি। নিকাশি নালাগুলি বন্ধ করার ফলে তা উপচে পড়ছে আশপাশে। অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে নালা সংলগ্ন এলাকার মানুষের জীবন।

ডবকেশ্বর ঘাটই হোক বা জাজমৌয়ের কাছে লখনউ রোডের নিকাশি নালা, ভৈরব ঘাট কিংবা পরমত ঘাট, সব জায়গায় একই চিত্র। নালা বন্ধের প্রমাণস্বরূপ সে-সব জায়গায় নমামি গঙ্গের বোর্ড লাগানো হয়েছে বটে, কিন্তু লক্ষ করলেই দেখা যাচ্ছে, নালার থেকে জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে সেই গঙ্গামুখী-ই!

দীর্ঘ তিন দশক ধরে কানপুরের গঙ্গার দূষণ নিয়ে কাজ করছেন পরিবেশকর্মী রাকেশ জয়সওয়াল। বলছিলেন, গঙ্গাতটেই প্রায় ৪০০টির বেশি ট্যানারি রয়েছে। তা থেকে প্রতিদিন অন্তত ৫ কোটি লিটার তরল বর্জ্য সরাসরি গঙ্গায় মেশে রোজ। তাঁর কথায়, ‘‘যতক্ষণ না ট্যানারি বর্জ্য পরিশোধনের পর্যাপ্ত সংখ্যক প্লান্ট হবে, কানপুরে গঙ্গার দূষণ কমবে না।’’ যদিও উত্তরপ্রদেশ জল নিগমের ‘গঙ্গা পলিউশন কন্ট্রোল ইউনিট’-এর প্রজেক্ট ইঞ্জিনিয়ার শত্রুঘ্ন সিংহ পটেল বললেন, ‘‘নমামি গঙ্গে প্রকল্পে নিকাশির উন্নয়ন, পরিশোধন প্লান্ট তৈরি এবং সেগুলির পরিকাঠামো উন্নয়ন-সহ একাধিক কাজ চলছে।’’ রাকেশের পাল্টা, ‘‘নমামি গঙ্গেতে কমন অ্যাফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তৈরির কথা শুধু খবরেই শুনছি। চোখে তো কিছু পড়ছে না!’’

সেই দাবি আর পাল্টা দাবি! গঙ্গা নিয়ে রাজনীতি। সব রাজ্যে যেমন হয় আর কী! কানপুরেও তেমনই। আছে দূষণের তথ্য নিয়ে বিভ্রান্তি, নমামি গঙ্গের বিজ্ঞাপন-বন্যাও!

আর সেই সমস্ত কোলাহল থেকে দূরে, কোনও এক প্রান্তিক গ্রামে গুড়িয়ার মতো মায়েরাও আছেন। যাঁরা নিজের একরত্তি মেয়েকে আদর করে বলেন, ‘গঙ্গার মতো ময়লা হয়ে গেলে কিন্তু আর বিয়ে হবে না!’

Water Pollution Ganga Lok Sabha Election 2019 গঙ্গা
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy