সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়া একটা ভিডিয়ো ঘিরে আপাতত মেতে আছে ওড়িশা।
নবীন নিবাসে শরীরচর্চায় ব্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী। পরনে কালো গোল-গলা টি শার্ট আর ধূসর রঙের ট্র্যাক প্যান্ট। কখনও তিনি জগিং করছেন বাড়ির বারান্দা থেকে লনে, কখনও যোগে মগ্ন, কখনও সাইক্লিংয়ে। আর সবার শেষে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলছেন, ‘গেটিং রেডি টু ফাইট ফর দ্য পিপল অব ওড়িশা’।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা মায়াবতীর মতো আগুন ঝরানো নেতা কোনও দিনই নন নবীন পট্টনায়ক। কথাই বলেন কদাচিৎ। যখন বলেন, তখনও স্বর এক পর্দাও চড়ে না। এমনকি জনসভাতেও না। চলাফেরায় ধীরস্থির। কিন্তু এ বার ভোটের মুখে নবীন যেন দৃশ্যতই ‘ক্লান্ত’। তা নিয়ে কথাও রটেছে বিস্তর। রাজনীতিক মহলে জল্পনা, নবীন অসুস্থ। বার বার পাঁচ বার ক্ষমতায় এলেও দায়ভার সামলাতে পারবেন কি না, প্রশ্ন উঠছে ইতিউতি। স্বাভাবিক ভাবেই বিরোধীরা তাতে ইন্ধন দিচ্ছেন। সেই জল্পনায় জল ঢালতেই ভোটের মুখে কৌশলে এমন ভিডিয়ো ছড়ানো হল বলেই খবর বিজেডি সূত্রের।
ছড়াতে হল, কারণ ২২ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এ বারই সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষার মুখে নবীনবাবু। ২০০০ সালে ক্ষমতায় আসা ইস্তক বিরোধীদের তো কোনও দিনই গ্রাহ্য করেননি তিনি। প্রথম ৯ বছরে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে কংগ্রেসের পায়ের তলার জমি কেড়েছেন। তার পর ২০০৯-এর ভোটের ঠিক মুখে বিজেপিকে হতবাক করে দিয়ে জোট ভেঙে বেরিয়ে এসেছিলেন। থই পায়নি লালকৃষ্ণ আডবাণীর দল। দাঁত ফোটাতে পারেননি নরেন্দ্র মোদীও। ২০১৪-য় প্রায় দেশ জুড়ে যখন মোদী-ঝড়, তখন মমতার মতোই তাঁর রথের চাকা বসিয়ে দিয়েছিলেন নবীন। লোকসভা ভোটের সঙ্গেই বিধানসভা নির্বাচন হয় ওড়িশায়। ১৪৭টি আসনের মধ্যে ১১৭টিই সে বার জিতেছিল বিজু জনতা দল (বিজেডি)। বিজেপি কুল্লে ১০টা। কংগ্রেস তাদের থেকে ৬টা বেশি। লোকসভার ২১টি আসনের মধ্যে ২০টিই গিয়েছিল বিজেডির ভাঁড়ারে। একটা পেয়েছিল বিজেপি।
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
“২০১৪-র অবস্থা আর নেই,” জনপথ রোডের ঝাঁ চকচকে দলীয় দফতরে বসে দাবি করলেন বিজেপির রাজ্য সম্পাদক লেখাশ্রী সামন্তসিংহ। ২০১৪-য় কেন্দ্রে ক্ষমতায় আসার পরেই দু’রাজ্যের উপরে নজর দিয়েছিলেন মোদী-অমিত শাহ। পশ্চিমবঙ্গ আর ওড়িশা। গত পাঁচ বছরে নবীনের রাজ্যে সংগঠন অনেকটাই বাড়িয়েছে বিজেপি। “গত বার রাজ্যের সব প্রান্তে আমাদের কর্মীই ছিল না। এ বার ৩৬ হাজার বুথের সব ক’টিতে কমিটি তৈরি হয়েছে এবং সেগুলো যথেষ্ট ভাল কাজ করছে,” দাবি লেখাশ্রীর।
সংগঠন বিস্তারের ফল খানিকটা হলেও ২০১৭-র পঞ্চায়েত ভোটে পেয়েছে বিজেপি। জেলা পরিষদে তাদের আসন এক ধাক্কায় ৩৬ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৯৭। বিজেডির আসন ১৭৮টা কমে হয়েছে ৪৭৩। মাত্র ৬০টা আসন পেয়ে তিন নম্বরে চলে গিয়েছে কংগ্রেস। লোকসভায় যেখানে বিজেপির ভোট ছিল ১৮ শতাংশ, পঞ্চায়েতে তা পৌঁছে গিয়েছে ৩৩ শতাংশে। বিজেডির ভোট ৪৩ শতাংশ থেকে কমে হয়েছে ৪০ শতাংশ।
গ্রামীণ ভোটের এই সাফল্য পালে হাওয়া জুগিয়েছে বিজেপির। অমিত শাহ ঘোষণা করে দিয়েছেন মিশন ১২০+। “পশ্চিম ওড়িশায় আমাদের জোর বরাবরই বেশি। উত্তর ওড়িশায় চিট ফান্ড কাণ্ড বিজেডি-কে ধরাশায়ী করে দেবে। কারণ, দুর্নীতিগ্রস্ত বা তাঁদের আত্মীয়দেরই টিকিট দিয়েছেন নবীনবাবু। আর বিজেডির শক্ত ঘাঁটি উপকূল ওড়িশাতেও আমাদের পায়ের তলার জমি ক্রমে শক্ত হচ্ছে,” বললেন লেখাশ্রী। এই বিশ্বাসে ভর করেই রাজ্য জুড়ে গোটা দল চনমনে। স্লোগান উঠেছে, ‘ওড়িশার পাই লড়িবা, নুয়া ওড়িশা গড়িবা’। রাত দশটাতেও দলের দফতরে কর্মীদের ভিড়, সামনের রাস্তায় গাড়ির সারি। বিরোধীরা বলছে, টাকা উড়ে বেড়াচ্ছে ওখানে।
অন্য দিকে দুপুর দু’টোতেও সুনসান ফরেস্ট পার্কের বিজেডি অফিস। এক জন নিরাপত্তা রক্ষী দরজাটা খুলে রেখেছেন। নেতারা কোথায় তিনি জানেন না। “আমাদের কি ঠান্ডা ঘরে বসে থাকলে চলবে!” ফোনে বললেন বিজেডি সাংসদ প্রসন্ন পতসানি। “সবাই যে যার মতো প্রচারে বেরিয়ে পড়েছেন। আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি কন্ধমালে।” অন্য বার তো এমন ছবি দেখা যায় না! তার মানে কি দল এ বার বেশ চাপে? চাপ তো বটেই, একান্তে মানছেন বিজেডি নেতারা। কিন্তু প্রকাশ্যে বলছেন, চাপটা বিজেপির নয়। অমিত শাহের পাল্টা হিসেবে দলের সামনে ১২৩টা আসন জেতার লক্ষ্য বেঁধে দিয়েছেন নবীন। ওড়িশা বিধানসভার ইতিহাসে রেকর্ড সংখ্যক আসন পেয়েছিলেন নবীনের বাবা বিজু পট্টনায়ক, ১৯৯০ সালে। সেই রেকর্ড ছুঁতেই কোমর বেঁধেছে দল।
রাজ্য রাজনীতির পর্যবেক্ষকেরা বলছেন, রেকর্ড দূরস্থান, সংখ্যাগরিষ্ঠতা ধরে রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ নবীনের। ১৯ বছরের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা মুছে ফেলা চাট্টিখানি কথা নয়। বিশেষ করে বিজেপির মতো প্রবল প্রতিপক্ষ যখন ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে।
গড় বাঁচাতে নবীন তাই ছুটে বেড়াচ্ছেন রাজ্যের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। বিজেপির রথের আদলে বিরাট এসি বাস। তার চওড়া জানলার ধারে আরামকেদারায় তিনি আসীন। হাত নাড়ছেন জনতার উদ্দেশে। মাঝে মাঝে বাস থামছে। খুলে যাচ্ছে তার মাথার কপাট। হাইড্রলিক লিফট বেয়ে উঠে আসছেন নবীন। সহকারীর কাছ থেকে কাগজ চেয়ে নিয়ে ভাঙা ভাঙা ওড়িয়ায় দু’চার কথা বলছেন। এত বছরেও মাতৃভাষাটা বিন্দুমাত্র রপ্ত হয়নি তাঁর! কাগজের বক্তৃতাটা রোমান হরফে লেখা।
তবু এই নবীন-বিস্ময়েই গত দু’দশক ধরে মজে ওড়িশা। এখনও তার রোড-শো ঘিরে হাজারো জনতার ভিড়। বাস এগোয়ই না। দুপুর গড়িয়ে রাত হয়। বাতিল করতে হয় শেষের জনসভাগুলো।
কিন্তু জনমতের দাঁড়িপাল্লার অন্য দিকও তো আছে।
ভুবনেশ্বর স্টেশনের কাছে সাইকেলে লাগানো ডালায় কলা বেচেন মানিক বেহরা। কথায় কথায় বললেন, “নবীনবাবু আমাদের কাছে ঈশ্বর ছিলেন।” ‘ছিলেন’ শব্দটা কানে বাজল। কেন, এখন আর নেই? ভিন্ রাজ্যের অচেনা সাংবাদিকের গোলমেলে প্রশ্নের জবাব দেওয়ার মতো না-লায়েক মানিক নন। তবে ঠোঁটের কোণে হাসিটা বুঝিয়ে দিল, ঠাকুরের রং চটে গিয়ে খড়-মাটি বেরিয়ে পড়েছে কোথাও কোথাও। বিসর্জন এ বারেই কি না, সেটা কোটি টাকার প্রশ্ন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy