চরিত্র বদলে বিপুল আগ্রাসী হয়ে উঠছে স্তন ক্যানসার। গত আট-ন’বছরের মধ্যে তার স্বভাব পাল্টে কলকাতা-সহ গোটা ভারতে এমন বিধ্বংসী রূপে তা দেখা দিচ্ছে যে, প্রমাদ গণছেন উদ্বিগ্ন চিকিৎসকেরাই।
ভয় পাওয়ানো একাধিক কারণ মজুত এর পরিবর্তিত চরিত্রে— রোগ দেখা দিচ্ছে অপেক্ষাকৃত অল্পবয়সীদের মধ্যে, যাঁদের বয়স ২৫-৫০। ক্যানসারের প্রচলিত ওষুধে কাজ হচ্ছে না। প্রচলিত বেশির ভাগ কেমোথেরাপিও এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। প্রথম অবস্থায় ধরা পড়লেও কয়েক মাসের মধ্যে রোগ হুড়হুড় করে বেড়ে স্টেজ-ফোর এ পৌঁছে যাচ্ছে। এবং এক বার রোগ সেরে যাওয়ার এক থেকে দু’ বছরের মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই রোগ আবার ফিরে আসছে রোগীর দেহে! অর্থাৎ প্রথমাবস্থায় ধরা পড়লে স্তন ক্যানসার মারণ হয় না বলে যে ধারণা ছিল, তা আর খাটছে না।
স্বাস্থ্য মন্ত্রকের সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুযায়ী, ভারতে ৭-৮ বছর আগেও এই ধরনের স্তন ক্যানসার হতো মোট স্তন ক্যানসার-আক্রান্তদের ১০-১৫ শতাংশের। এখন যা দাঁড়িয়েছে ৩১-৪০ শতাংশ। চিকিৎসাশাস্ত্রে এর নাম—‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার।’
গত ১৯ জানুয়ারি প্রখ্যাত আন্তর্জাতিক জার্নাল ‘প্যাথলজি রিসার্চ অ্যান্ড প্র্যাকটিস’-এ কলকাতার কয়েক জন চিকিৎসক ও গবেষকের একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে এই ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসারের বাড়বাড়ন্ত নিয়ে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে কলকাতার একাধিক বেসরকারি ক্যানসার হাসপাতালে সমীক্ষা চালিয়ে তাঁরা দেখেছেন, যত রোগী স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাঁদের ৩৫-৪০ শতাংশের অত্যন্ত আগ্রাসী ধরনের ক্যানসার হচ্ছে।
এর আগে ২০১৫ সালে মধ্য ভারতের এক বেসরকারি হাসপাতালে ৮৫ জন স্তন ক্যানসার রোগীর মধ্যে ৩৭ জনের (অর্থাৎ প্রায় ৪৪% এর) এই আগ্রাসী ক্যানসার পেয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। ২০১৬ সালে অন্ধ্র প্রদেশের সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলগুলির ক্যানসার রোগিণীদের একটা বড় অংশের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে তাঁদের ৫৭% ‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’-এ ভুগছেন।
৪ ফেব্রুয়ারি ‘বিশ্ব ক্যানসার দিবস’ উদযাপনের সপ্তাহখানেক আগে কলকাতা, ভোপাল, মুম্বই, হায়দরাবাদের মোট ৩২ জন ক্যানসার চিকিৎসক ‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’ নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত একাধিক সমীক্ষা রিপোর্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রকে পাঠিয়ে একটি আবেদন রেখেছেন। বলেছেন, ‘‘পশ্চিমি দেশগুলির তুলনায় ভারতে দ্বিগুণ সংখ্যক আগ্রাসী স্তন ক্যানসারের রোগী মিলছে। অথচ এর চিকিৎসার উপযুক্ত ওষুধ ও কেমোথেরাপি আমাদের হাতে নেই। নেই যথাযথ গবেষণাও। অবিলম্বে এর জন্য আলাদা চিকিৎসা প্রোটোকল তৈরি করতে হবে। অন্যথায় পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে। কারণ, ভারতে শহরাঞ্চলে মেয়েদের যত রকম ক্যানসার হয়, তার মধ্যে স্তন ক্যানসারের হার সর্বাধিক।’’
প্রসঙ্গত শুধু কলকাতাতেই এখন স্তন ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজার। প্রতি বছর সংখ্যাটা প্রায় ৪ হাজার করে বাড়ছে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, এই ধরনের স্তন ক্যানসারে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা কম। ইউরোপ-আমেরিকায় যেখানে স্তন ক্যানসারের চিকিৎসার পরে ৮০ শতাংশ মহিলা দীর্ঘদিন বাঁচছেন, সেখানে ভারতে ৫ বছরের বেশি বাঁচছেন মাত্র ৬০ শতাংশ মহিলা।
১৯ জানুয়ারির আন্তর্জাতিক জার্নালে কলকাতার যে চিকিৎসক-গবেষকদের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে, তাঁদের অন্যতম চিকিৎসক আশিস মুখোপাধ্যায় জানান, সাধারণ স্তন ক্যানসারের ক্ষেত্রে ক্যানসার কোষগুলির উপর তিন ধরনের রিসেপটার পাওয়া যায়। ফলে ওষুধ ও কেমো অনেক ভাল কাজ করে। কিন্তু ‘ট্রিপল নেগেটিভ ব্রেস্ট ক্যানসার’-এ এ রকম কোনও রিসেপটার থাকে না। ফলে ওষুধও কাজ করে না। আশিসবাবুর হাসপাতালে এই মুহূর্তে দুই মহিলা এই ধরনের স্তন ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি। এর মধ্যে হাতিবাগানোর বাসিন্দা তুলিকা ভদ্রের বয়স মাত্র ২৮ এবং বারাসতের বাসিন্দা কমলা দাসের বয়স ৪০।
কলকাতার অন্যতম স্তন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ তাপ্তী সেনের কথায়, ‘‘যত রোগী পাচ্ছি, তাঁদের ২৭-৩৫%-এর এই ক্যানসার। সব অল্পবয়সী মেয়ে। দশ বছর আগেও এমন ছিল না। এঁদের কোনও ওষুধ দেওয়া যাচ্ছে না, কারণ কাজ হচ্ছে না।’’ রাজারহাটের টাটা ক্যানসার হাসপাতালের স্তন বিশেষজ্ঞ রোজিনা আহমেদেরও বক্তব্য, ‘‘আমাদের হাসপাতালে ১০ জন স্তন ক্যানসারের রোগী এলে তাঁদের ২-৩ জনের এই ধরনের ক্যানসার পাচ্ছি। যেহেতু এঁদের অনেক ওষুধ আর কেমো দেওয়া যায় না, তাই এক বার সুস্থ হওয়ার ২-৩ বছরের মধ্যে আবার শরীরে রোগ ফিরে আসছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy