জল ঠেলে নৌকায় জওয়ানরা এগোচ্ছিলেন তিন তলা একটা বাড়ির দিকে। জল এত গভীর আর তাতে এত স্রোত যে প্রতি মুহূর্তে ভেসে যাওয়ার ভয়। তাই তাঁরা ঠিক করেন, এই নৌকা ফিরিয়ে নিয়ে মোটরবোটে আসবেন। ফেরার সময়েই বিপত্তি। এক জওয়ান চেঁচিয়ে ওঠেন, ‘‘কেউটে!’’ বাকিরা জল ছিটিয়ে সেটাকে তাড়ানোর চেষ্টা করেন। ওটা তখনকার মতো বিদেয় হলেও এক মিটার দূরত্বে ফের আর একটি।
দুর্গতদের উদ্ধার করতে গিয়ে আট-দশ ফুট জল ঠেলতে হবে জানতেন ভারতীয় সেনার তরুণ জওয়ানরা। কিন্তু বিষধর সাপদের সঙ্গেও সাক্ষাৎ হবে, ভাবেননি। বন্যার তাণ্ডবে চেন্নাইয়ের ডিফেন্স কলোনির এখন তছনছ অবস্থা। অ্যাডেয়ার নদীর ঠিক পাশেই এই এলাকা। পরিবার নিয়ে সেনাবাহিনীর বিভিন্ন অফিসারের বাস এখানে। তাঁদের উদ্ধারেরই কাজ চলছিল আজ।
সাপের আগমনে জওয়ানরা সাময়িক ভাবে প্রমাদ গোনেন। কিন্তু ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা মহিলা-শিশুদের আর্তি শুনে ফের শুরু করেন জল ঠেলা। সাপ তাড়াতে এক জওয়ান সোজা ঝাঁপ দেন গভীর জলে। সাঁতরে ওঠেন একটা আধডোবা গাড়ির মাথায়। নৌকা থেকে দড়ি ছোড়া হয় তাঁর দিকে। সেই দড়ি তিনি ছুড়ে দেন ছাদে দাঁড়িয়ে থাকা লোকজনের দিকে। একে একে উদ্ধার হয় সাতটি শিশু, তিন মহিলা এবং দু’জন পুরুষ। এই সময় ফের আবির্ভাব এক কেউটের। নৌকার একদম পাশেই। তবে সে আর কাছে ঘেঁষেনি। এক ঘণ্টার টানটান অভিযান শেষ। স্রোত পেরিয়ে নৌকাও তখন শান্ত জলে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন সবাই। জওয়ানরা ছুটলেন পরের এলাকায় উদ্ধারের জন্য।
আরও পড়ুন, অসময়ের বন্ধু #চেন্নাইফ্লাডস, #চেন্নাইমাইক্রো
চেন্নাইয়ের বিভিন্ন অংশে এখন এমন ছবিই চোখে পড়ছে। নাগাড়ে বর্ষণের পরে শেষ পর্যন্ত আজ সূর্যের দেখা মিলেছে। বৃষ্টির পরিমাণও কমেছে অনেকটাই। হাওয়া অফিস বলছে, আগামী ৪৮ ঘণ্টায় নিম্নচাপ ক্রমশ দুর্বল হবে। কিন্তু রোদ্দুরের আঁচেও ভরসা পাচ্ছেন না মানুষ।
কারণ কোথাও কোথাও জল সরতে শুরু করলেও এখন বেশির ভাগ এলাকা জলমগ্ন। তার মধ্যে সতর্কতা ঘোষণা না করেই কিছু এলাকায় চেম্বারাবক্কম বাঁধের জল ছাড়া হচ্ছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। সব মিলিয়ে ঘণ্টায় ঘণ্টায় জল বেড়ে যাচ্ছে সে সব এলাকায়। সেনাবাহিনী, বায়ুসেনা এবং জাতীয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা বাহিনী মিলিত ভাবে উদ্ধারকাজ চালিয়ে সাত হাজারেরও বেশি মানুষকে বন্যা কবলিত এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে পেরেছে। কিন্তু সঙ্কটাপন্ন এখনও বহু মানুষ।
আজ আকাশপথে চেন্নাইয়ের অবস্থা ঘুরে দেখেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। চেন্নাই থেকে ৭০ কিলোমিটার পশ্চিমে আরাকোন্নামে নৌবাহিনীর বিমানঘাঁটি ‘আইএনএস রাজালি’তে তিনি পৌঁছন বৃহস্পতিবার বিকেলে। বন্যা-পরিস্থিতি চাক্ষুষ করার পর পরই হাজার কোটি টাকা ত্রাণের কথা ঘোষণা করেন তিনি। রাজ্যপাল কে রোসাইয়া এবং মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতাকে পাশে নিয়ে মোদী তামিল ভাষায় রাজ্যের মানুষের উদ্দেশে বলেন, ‘‘আমি আপনাদের পাশে আছি।’’ পরে অবশ্য টুইট করেও জানান, ‘এই আশু প্রয়োজনের সময়ে ভারত সরকার তামিলনাড়ুর মানুষের পাশে আছে।’
মোদীর মন্ত্রিসভার আর এক সদস্য এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ চেন্নাইয়ের পরিস্থিতিকে অত্যন্ত সঙ্কটজনক বলেছেন। আজ লোকসভায় তিনি বলেন, ‘‘এটা বললে হয়তো অতিরঞ্জন হবে না যে চেন্নাইয়ের অবস্থা এখন একটা দ্বীপের মতো। সব জাতীয় সড়ক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তামিলনাড়ুর রাজধানী।’’ এখনও পর্যন্ত এখানে মৃতের সংখ্যা ২৬৯। পুদুচেরিতে মারা গিয়েছেন দু’জন এবং অন্ধ্রপ্রদেশে মৃতের সংখ্যা ছুঁয়েছে ৫৪।
আশার কথা, আটকে থাকা অনেক মানুষকেই উদ্ধার করা গিয়েছে। এঁদের মধ্যে ছিলেন সাত মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২৯ বছরের এক মহিলাও। তিন বছরের আর এক সন্তানের সঙ্গে সুকন্যা নামে ওই মহিলাকে জলমগ্ন এলাকা থেকে নির্বিঘ্নে তুলে আনা হয়েছে বায়ুসেনার চেতক হেলিকপ্টারে। চেন্নাইয়ের মেদুমবক্কমে আটকে ছিলেন সুকন্যা। টানা বর্ষণে ভয়ঙ্কর ভাবে বিপর্যস্ত এলাকার মধ্যে রয়েছে মেদুমবক্কম। ওই এলাকা থেকে মহিলাকে তাম্বারাম বিমানঘাঁটিতে নিয়ে আসা হয়। তার পরেই দ্রুত সেখানকার হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। পরে সুকন্যা জানান, ‘‘একতলা, দু’তলা সবই ভেসে গিয়েছিল। আমরা তিন তলায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। দু’দিন ধরে বিদ্যুৎ ছিল না। সব আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম। শেষমেশ আজ মুক্তি পেলাম।’’ সুকন্যার স্বামীকেও ওখানে নিয়ে আসা হবে। সেখান থেকে তাঁরা রওনা দেবেন কাঞ্চিপুরমে বাবা-মায়ের কাছে। উদ্ধার করতে গিয়ে এমন অজস্র করুণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি বায়ুসেনা। তাঁরা আকাশপথে ঘুরতে ঘুরতে দেখেছেন, অসংখ্য মানুষ ছাদ থেকে হাত তুলে আর্তি জানাচ্ছেন সাহায্যের। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জনেরও বেশি ছাত্রকে উদ্ধার করে আনা হয় তাম্বারাম বিমানঘাঁটিতে। সেখান থেকে তাঁদের কেউ কেউ রওনা হয়ে গিয়েছেন হায়দরাবাদ, কেউ বা দিল্লি।
তবে কোথাও কোথাও এখনও পৌঁছতেই পারছেন না উদ্ধারকারীরা। জলের তোড়ে ভেঙে যাওয়া বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তার ছড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে। যে কোনও মুহূর্তে ঘটে যেতে পারে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। এই সব এলাকায় খাবার জল বা দুধের মতো অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রী মিলছে না বলে আরও বিপদে পড়েছেন বাসিন্দারা। এক লিটারের দুধের প্যাকেট কোথাও বিকোচ্ছে একশো টাকায়, কুড়ি টাকার মিনারেল ওয়াটার দেড়শো টাকায়।
বৃষ্টি এখন অনেকটা কম। তবে দুর্ভোগ আরও কত দিন চলবে, জানেন না দুর্গতরা। উদ্ধারের পথ চেয়ে বসে এখনও অনেকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy