দুর্ঘটনা না নাশকতা, জোরদার টানাপড়েন চলছে রেলে।
পরের পর দুর্ঘটনার জেরে যাত্রী-সুরক্ষা নিয়ে অনুযোগ-অভিযোগে জেরবার রেল। কেননা সাম্প্রতিক বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য আঙুল উঠছে রেলের ত্রুটিবিচ্যুতি-গাফিলতি, দেখভালে ঘাটতির দিকে। এই অবস্থায় অন্ধ্রপ্রদেশে হিরাখণ্ড এক্সপ্রেস বেলাইন হওয়ার ঘটনায় দুর্ঘটনা-নাশকতার ধাঁধা কাটাতে ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি বা এনআইএ-র দ্বারস্থ হল রেল মন্ত্রক।
এনআইএ কেন?
কারণ, রেলের একাংশের সন্দেহ, ওই ট্রেনের বেলাইন হয়ে যাওয়াটা আদৌ দুর্ঘটনাই নয়। নাশকতা। শুধু হিরাখণ্ড নয়, গত ডিসেম্বর থেকে পরপর তিনটি ট্রেন দুর্ঘটনার কারণ খুঁজতে গিয়েই নাশকতার সন্দেহ বড় হয়ে উঠেছে। কানপুরে ইনদওর-পটনা এক্সপ্রেস এবং শিয়ালদহ-অজমের এক্সপ্রেস দুর্ঘটনাতেও প্রাথমিক ভাবে নাশকতার গন্ধ পেয়েছিল এনআইএ। তার তদন্ত চলছে। এ বার হিরাখণ্ডের বিষয়টিও এনআইএ-কে দিয়ে যাচাই করিয়ে নিতে চাইছে রেল মন্ত্রক। ওই তিনটি দুর্ঘটনায় দুই শতাধিক যাত্রী প্রাণ হারিয়েছেন। আহত অনেক।
২৩ জানুয়ারি এনআইএ-র দিল্লি ও হায়দরাবাদ অফিস থেকে দু’দল গোয়েন্দা অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়ালটেয়ারে (বিশাখাপত্তনম) যান। যেখানে হিরাখণ্ড এক্সপ্রেস লাইনচ্যুত হয়েছিল, সেই এলাকা পরিদর্শন করে তদন্তকারীরা হাসপাতালে গিয়ে আহতদের সঙ্গেও কথা বলেন। এনআইএ-র খবর, ওই দু’টি দলে মোট চার জন অফিসার ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন বিস্ফোরক এবং ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরাও। দুর্ঘটনার গতিপ্রকৃতি দেখে প্রাথমিক ভাবে নাশকতার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে না বলে গোয়েন্দা সূত্রের খবর।
রেল মন্ত্রকের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, গত এক বছরে রেললাইনে নাশকতার ঘটনা ঘটেছে অন্তত ৪৫টি। তবে রেল-সুরক্ষা জোরদার থাকায় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। মন্ত্রকের এক কর্তা জানান, ওই ৪৫টি নাশকতার ঘটনার মধ্যে ১৮টিতে জঙ্গিদের হাত ছিল বলে মনে করা হচ্ছে। ১৩টি ঘটনায় রেললাইন থেকে উদ্ধার করা হয়েছে ইমপ্রোভাইজ্ড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা আইইডি। লাইন উড়িয়ে দেওয়ার জন্য ওই বিস্ফোরক কে বা কারা পুঁতে রেখে গিয়েছিল, তা অবশ্য স্পষ্ট হয়নি।
দুর্ঘটনা যদি না-ও হয়, নজরদারি সত্ত্বেও এত নাশকতা কেন?
রেল সূত্রের খবর, ১৯৫০ সাল থেকে বাড়তে বাড়তে সারা দেশে রেলপথের দৈর্ঘ্য এখন ৬৭ হাজার ৩১২ কিলোমিটার। তার মধ্যে প্রায় ২৮ হাজার কিলোমিটার লাইনে বিদ্যুদয়ন হয়েছে। এই সুদীর্ঘ লাইনে কে বা কারা কখন কোথায় নাশকতার ছক কষছে, সেটা আঁচ করে নজরদারি চালানো কার্যত অসম্ভব।
রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, এখন রেললাইনের নিরাপত্তায় নজরদারি বলতে সারা দিনে মাত্র তিন বা চার বার রেলকর্মীদের (গ্যাংম্যান বা ট্র্যাকম্যান) দিয়ে লাইন পরীক্ষা। দিন ও রাতের বাকি সময়টা রেললাইনের নিরাপত্তা পুরোপুরি নির্ভর করে সংশ্লিষ্ট রাজ্যের পুলিশের উপরে। রেলকর্তাদের একাংশের বক্তব্য, দুষ্কৃতীরা তো আর লাইনে থাকে না। তারা আসে কোনও না-কোনও বসত-এলাকা থেকেই। দুষ্কর্ম করে আবার সেই সব লোকালয়েই ফিরে যায় তারা। এই ধরনের দুষ্কৃতীর নাড়িনক্ষত্রের খোঁজখবর রাজ্য পুলিশেরই নখদর্পণে থাকার কথা। এই ধরনের নাশকতার পিছনে কারা, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রেল পুলিশের পক্ষে সেটা খুঁজে বার করা সম্ভব হয় না। তার জন্য রেলকে নির্ভর করতে হয় রাজ্য পুলিশের উপরেই।
তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন দুর্ঘটনার ধরন দেখে রেলকর্তাদের একটি অংশ এখনও নাশকতার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়ার পক্ষপাতী নন। ইনদওর-পটনা, শিয়ালদহ-অজমের এবং হিরাখণ্ড এক্সপ্রেস যে-ভাবে লাইনচ্যুত হয়েছে, তাতে তিনটি দুর্ঘটনার জন্য রেলের ত্রুটিই দায়ী বলে তাঁদের সন্দেহ। ওই রেলকর্তারা জানাচ্ছেন, পুরনো হয়ে যাওয়া লাইন ঠিক সময়ে বদলানো হচ্ছে না। সেগুলি ভেঙেই দুর্ঘটনা ঘটছে।
‘‘রেল বোর্ড যা-ই বলুক না কেন, রেলের রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যে গাফিলতি হচ্ছে, এ-সব দুর্ঘটনা তারই প্রমাণ,’’ বলছেন ওই রেলকর্তারা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy