Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
৩৫ মিনিটে বাজিমাত

যোগগুরু নরেন্দ্রভাই

শহরের ঘুম ভাল করে ভাঙার আগেই রাজপথ তখন যোগপথে। পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের একেবারে সামনের সারিতে তেরঙ্গা উত্তরীয় গলায় জড়িয়ে সাদা কুর্তা-পাজামায় যোগে বসলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পঁয়ত্রিশ মিনিটে প্রায় পঁয়ত্রিশটি আসন অনেকটাই নিখুঁত সামলে রীতিমতো বাজিমাত করলেন। শুধু কি প্রথম বিশ্ব যোগ দিবস পালনে? বিশ্ব রেকর্ড গড়ায়?

শলভাসনে ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

শলভাসনে ‘ছাপ্পান্ন ইঞ্চি’। রবিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: পিটিআই।

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০৪:১১
Share: Save:

শহরের ঘুম ভাল করে ভাঙার আগেই রাজপথ তখন যোগপথে।

পঁয়ত্রিশ হাজার মানুষের একেবারে সামনের সারিতে তেরঙ্গা উত্তরীয় গলায় জড়িয়ে সাদা কুর্তা-পাজামায় যোগে বসলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। পঁয়ত্রিশ মিনিটে প্রায় পঁয়ত্রিশটি আসন অনেকটাই নিখুঁত সামলে রীতিমতো বাজিমাত করলেন। শুধু কি প্রথম বিশ্ব যোগ দিবস পালনে? বিশ্ব রেকর্ড গড়ায়?

রাজধানীর রাজনীতিকেরা বলছেন, ঘরোয়া রাজনীতিতে আচমকা হাজির হওয়া চাপ কাটানোর লড়াই থেকে শুরু করে কূটনীতির জমি দখলের যুদ্ধ— সব ক্ষেত্রেই আজ বাজি মারলেন নরেন্দ্র মোদী।

যোগ শব্দটার সঙ্গে ভারতের নাড়ির যোগ। এ যেন ভারতীয়ত্বের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত। আর সেই ভারতীয়ত্বকেই হাতিয়ার করে আজ গোটা দুনিয়াকে আলোড়িত করলেন মোদী। সেই সঙ্গে গোটা দেশকেও। সরকার গড়ার এক বছরের মাথায় তাঁর কর্তৃত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিল ললিত মোদী বিতর্ক, তাকে যেন সপাটে উড়িয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন, এখনও তিনিই শেষ কথা।

জাতীয়তাবাদের সঙ্গে যোগকে এমনই জুড়ে দিয়েছেন মোদী যে, তাঁর সরকারের তীব্রতম সমালোচক হয়েও আজ রাজপথে যোগাভ্যাসে সামিল হতে হয়েছে অরবিন্দ কেজরীবালকে! যোগাভ্যাসে নামতে হয়েছে লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো ঘরের বিক্ষুব্ধদেরও। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ইদানীং বিজেপির সম্পর্ক আলো-ছায়ার। যোগ দিবসে তা বজায় রেখে বুদ্ধিমানের মতো ধরি মাছ না ছুঁই পানি পন্থা নেন তৃণমূল নেত্রী। বাড়াবাড়ি করেননি, আবার বর্জনও করেননি।

কিন্তু মোদীর সুবিধা করে দিয়েছে কংগ্রেস। রাজপথে তাদের অনুপস্থিতি অস্ত্র তুলে দিয়েছে মোদীর হাতে। ‘ললিতাসন’ দিয়ে ব্যঙ্গ করে মোদীকে বিঁধতে চেয়েছিল কংগ্রেস। ঘুরিয়ে প্রশ্ন তুলতে চেয়েছিল যোগের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েও। বিশ্ব জুড়ে বিপুল সাড়া, রাজপথে টুপি পরা সংখ্যালঘুদের উপস্থিতি বুঝিয়ে দিল, তাদের কৌশল কাজে আসেনি। জয় হয়েছে মোদীরই।

১৯৩টি দেশের সম্মতি আদায় করে রাষ্ট্রপুঞ্জকে দিয়ে ২১ জুনকে বিশ্ব যোগ দিবস হিসেবে ঘোষণা করিয়েছিলেন মোদী। তখন থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল, যোগের মাধ্যমে গোটা বিশ্বে ভারতের উপস্থিতি জাহির করা। মোদীর কথাতেই, ‘‘সূর্যের প্রথম আলো যেখানে পড়েছে, সেখান থেকে চব্বিশ ঘণ্টায় শেষ আলো যেখানে পড়বে, এই গোটা যাত্রাপথে এমন কোনও স্থান থাকবে না, যেখানে যোগ অভ্যাসীদের আশীর্বাদ করার সুযোগ থাকবে না। গোটা বিশ্বকে সে কথা স্বীকার করতে হবে।’’ সেই অঙ্কে শুধু দিল্লির রাজপথ নয়, আজ গোটা দেশে মন্ত্রী-নেতাদের ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজকে পাঠিয়েছেন নিউ ইয়র্কে, রাষ্ট্রপুঞ্জের সদর দফতরে যোগ দিবস পালনের অনুষ্ঠানে। বিভিন্ন দেশে ভারতীয় দূতাবাসে আজ পালিত হয়েছে যোগ দিবস। এ দেশে থাকা ভিন দেশি রাষ্ট্রদূতেরাও সামিল হয়েছেন অনুষ্ঠানে। তাঁদের সুবিধার্থে রাজপথে হিন্দির পাশাপাশি ইংরেজিতেও ব্যাখ্যা করা হয়েছে সব ক’টি যোগ। গিনেস বিশ্ব রেকর্ডের কর্তারাও আজ সকালে রাজপথের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়িয়েছেন সরেজমিনে খতিয়ে দেখতে। প্রায় ৩৬ হাজার মানুষ একসঙ্গে যোগ করে বিশ্ব রেকর্ডও গড়ে ফেলেছেন।

মোদীর লক্ষ্য অবশ্য পূরণ হয়েই গিয়েছে, বলছেন রাজধানীর পোড়খাওয়া রাজনীতিকেরা।

এক দিকে, কূটনীতিতে তিনি এগিয়ে গিয়েছেন বেশ কয়েক ধাপ। সরকারের জন্মলগ্ন থেকেই বিদেশনীতিকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে চেয়েছেন মোদী। সে জন্য গত এক বছরে ঘুরেছেন একের পর এক দেশ। প্রতিবেশী-রাজনীতিতেও পাকিস্তানকে অনেকটাই এক ঘরে করে ফেলেছেন সফল ভাবে। রাষ্ট্রনায়ক মোদীকে আজ অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেল যোগ দিবসের অনুষ্ঠান।

অন্য দিকে, তিনি চাপ কমালেন ঘরোয়া রাজনীতিতেও। সুষমাকে নিউ ইয়র্ক পাঠিয়ে বোঝালেন, বিদেশমন্ত্রীর ইস্তফার যে দাবি বিরোধীরা তুলছে, তাকে এই মুহূর্তে অন্তত পাত্তা দিচ্ছেন না তিনি। আর গোটা বিশ্বের কাছ থেকে যোগ দিবসের স্বীকৃতি আদায় করে এক ঘরে করে ফেললেন ‘অনুপস্থিত’ কংগ্রেসকে। রাজধানীর রাজনীতিকেরা বলছেন, যোগ দিবসের সাফল্য এই বার্তাকেই প্রতিষ্ঠা করে গেল যে, এটা কোনও একটা দলের সরকারের একান্ত নিজস্ব ভাবনা নয়। গোটা দেশের ভাবনার ফসল। সেই পার্বণে যোগ না দিয়ে নিজেদের ভারতীয়ত্ব থেকেই যেন বিচ্ছিন্ন করল কংগ্রেস। তাদের সঙ্গী হল বামেরা।

যোগ দিবসের সাফল্যের পরে ললিত মোদী বিতর্ক নিয়ে নরেন্দ্র মোদী কোন পথে হাঁটেন, তা-ই দেখতে এখন আগ্রহী রাজনীতিকেরা। যদিও তাঁদের অনেকেরই মত, গত কয়েক দিন ঘটনাপ্রবাহ যে ভাবে চলছিল, আজ তার গতি বদলের সম্ভাবনা অনেকটাই তৈরি হয়ে গিয়েছে। বিজেপির এক শীর্ষ নেতার কথায়, ‘‘দেখুন না, যে লালকৃষ্ণ আডবাণী ক’দিন আগে বেসুরো গাইছিলেন, আজ তিনিও হিমাচলে গিয়ে কপালভাতি করেছেন। সঙ্ঘ পরিবারের একাংশ ক’দিন আগেও রামমন্দির নিয়ে সরব হচ্ছিলেন। আর আজ প্রধানমন্ত্রীর করা এত বড় আয়োজন দেখে তাঁরা খুশি। আবার মোদী এর মাধ্যমে হিন্দুত্ব করেছেন, তেমন অভিযোগও তোলা যাবে না। কারণ, সংখ্যালঘুদের কথা ভেবে এ দেশে সূর্য নমস্কার বাদ দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে নরেন্দ্র মোদী আজ দশে একশো পেলেন!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE