Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

ঠিক যেন গরবাচভ, মোদীকে শ্লেষ রাহুলের

এ বার অস্ত্র অন্তর্জাল। মোদী সরকারকে ‘স্যুট-বুটের সরকার’ বলে সমালোচনা করে গত তিন দিন সমানে প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন রাহুল গাঁধী। বলেছেন, কর্পোরেটের কাছে দেনা মেটাতে কৃষকদের ‘কুড়ুল মারছেন’ প্রধানমন্ত্রী। রাহুলের এই কৃষক প্রীতি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। ইউপিএ আমলের দুর্নীতি নিয়েও কটাক্ষ ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নম্বর কুড়নোর লক্ষে মোদী সরকারের সমালোচনা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর কংগ্রেস সহ-সভাপতি।

ছবি: পিটিআই।

ছবি: পিটিআই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৩ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:৪৭
Share: Save:

এ বার অস্ত্র অন্তর্জাল।

মোদী সরকারকে ‘স্যুট-বুটের সরকার’ বলে সমালোচনা করে গত তিন দিন সমানে প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করেছেন রাহুল গাঁধী। বলেছেন, কর্পোরেটের কাছে দেনা মেটাতে কৃষকদের ‘কুড়ুল মারছেন’ প্রধানমন্ত্রী। রাহুলের এই কৃষক প্রীতি নিয়ে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। ইউপিএ আমলের দুর্নীতি নিয়েও কটাক্ষ ধেয়ে আসছে তাঁর দিকে। তা সত্ত্বেও রাজনৈতিক নম্বর কুড়নোর লক্ষে মোদী সরকারের সমালোচনা চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর কংগ্রেস সহ-সভাপতি। আজ তিনি কেন্দ্রকে কাঠগড়ায় তুলতে চাইলেন ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতার প্রশ্নে! এবং সে ক্ষেত্রেও কৌশলে সরকারের সঙ্গে কর্পোরেটের সখ্যর বিতর্ক ফের খুঁচিয়ে দিলেন কংগ্রেসের সহ-সভাপতি। আমজনতা, বিশেষ করে যুব সম্প্রদায়কে বার্তা দিয়ে বোঝাতে চাইলেন, তাঁদের হাত থেকে ইন্টারনেট পরিষেবার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে এ বার কিছু কর্পোরেট সংস্থার হাতে তা তুলে দিতে চাইছে সরকার।

রাহুলের বক্তব্য, সরকার শিল্পপতিদের হাতে নেট পরিষেবার ভার দিতে চাইছে। অথচ যুব সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেরই এই পরিষেবা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। তাই ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতা খর্ব করতে ট্রাই (টেলিকম রেগুলেটরি অথরিটি অব ইন্ডিয়া) যা সুপারিশ করেছে, তা অবিলম্বে খারিজ করুক সরকার।

আগের দু’দিনের মতো রাহুলকে অবশ্য আজ আর লোকসভায় ফাঁকা মাঠ ছেড়ে দেয়নি শাসক দল। কৃষকদের দুর্দশার প্রশ্নে গত পরশু রাহুল যখন মোদীর বিরুদ্ধে তীব্র কটাক্ষ করেন, তখন মোকাবিলার পথ ও ভাষা নিয়ে বিভ্রান্ত ছিলেন বিজেপি নেতৃত্ব। কিন্তু আজ গোড়া থেকে পাল্টা আক্রমণের পথে হাঁটেন বিজেপির মন্ত্রী-সাংসদরা। সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু রাহুলকে বলেন, ‘‘আপনি রাজনীতি না করে আলোচ্য বিষয়ের মধ্যে সীমিত থাকুন।’’ আবার তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, সরকার ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতা রাখার পক্ষে। সে জন্য ট্রাইয়ের রিপোর্ট পেশ হওয়ার আগেই এ ব্যাপারে কমিটি গঠন করা হয়েছে। রাহুলকে চুপ করিয়ে দিতে এর পরেই ইউপিএ জমানায় স্পেকট্রাম দুর্নীতির প্রসঙ্গ টেনে আনেন রবিশঙ্কর।

গরিব কৃষক ও আমজনতার প্রতিনিধি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে এখন উঠেপড়ে লেগেছেন রাহুল। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই দাবি, রাহুলের এই দাবি মানা মুশকিল। কারণ, কংগ্রেসের ইতিহাসই বলছে, প্রথম থেকেই তাদের কৃষক-বন্ধু ভাবমূর্তিতে বিস্তর গলদ রয়ে গিয়েছে। তাঁর জমানায় প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী যে জমি নীতি এনেছিলেন, সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছিল, জমি অধিগ্রহণ করলে জমির মালিক কোনও ‘ক্ষতিপূরণ’ পাবেন না। শুধু জমির জন্য একটা মূল্য তাঁকে দেওয়া হবে। কারণ হিসেবে শ্রীমতি গাঁধী তখন বলেছিলেন, জমি-মালিকেরা সবাই শোষক শ্রেণির মানুষ। তাই তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। তারও আগে, ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুই জমি অধিগ্রহণ আইনকে বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার বাইরে নিয়ে এসেছিলেন। শুধু তা-ই নয়, হীরাকুঁদ বাঁধ তৈরির সময়ে জমি অধিগ্রহণ করে নেহরু বলেছিলেন, ‘‘আপনাদের যদি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, মনে রাখবেন, সেটা দেশেরই স্বার্থে!’’

সেই সব ইতিহাস থেকে আপাতত দূরেই থাকছেন রাহুল। তাই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবেই মোদীকে পুঁজিপতিদের বন্ধু রূপে তুলে ধরতে চাইছেন তিনি। ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গে রাহুল আজ সংসদে তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন প্রধানমন্ত্রীকে ‘প্রশংসা’ করার মোড়কে। শাসক বেঞ্চের উদ্দেশে বলেন, ‘‘কাল বিকেলে কংগ্রেস সভানেত্রীর কক্ষে টাইম ম্যাগাজিনের একটা কপি দেখলাম। শুনে আপনারা খুশি হবেন, দেখি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা আমাদের প্রধানমন্ত্রীর খুব প্রশংসা করেছেন। আমেরিকা বড় বড় কর্পোরেটের দেশ। তার প্রেসিডেন্ট ভারতের প্রধানমন্ত্রীর প্রশংসা করছেন, এটা কম কথা নয়। গত ষাট বছরে কোনও রাষ্ট্রনেতাকে এই প্রথম এত প্রশংসা করল আমেরিকা। এর আগে শেষ বার তারা গরবাচভের (প্রাক্তন রুশ প্রেসিডেন্ট সার্গেই মিখাইল গরবাচভ) এমন প্রশংসা করেছিল।’’ রাহুলের মুখে এই কথা শুনে প্রথমে বিজেপির বহু সাংসদ টেবিল চাপড়ে তা স্বাগত জানান। রাহুলের শ্লেষটা তাঁরা বুঝতে পারেন পরে! কংগ্রেস নেতাদের মতে, আমেরিকার প্রশংসার কথা বলে ও গরবাচভের প্রসঙ্গে টেনে এনে আদতে মোদীকে বিঁধেছেন রাহুল। কারণ ‘আমেরিকার বন্ধু’ বলে পরিচিত গরবাচভের নীতির কারণেই তাঁর নিজের দেশ, সোভিয়েত ইউনিয়নে ভাঙন ধরেছিল।

আজ নিয়ে টানা চার দিন কেন্দ্রের বিরুদ্ধে মুখ খুললেন রাহুল! সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্ব মুলতুবি রেখে যাতে নেট নিরপেক্ষতার বিষয়ে বিতর্ক হয়, সেই দাবি তুলেছিলেন অমেঠীর সাংসদ। মুলতুবির দাবি স্পিকার মীরা কুমার না মানলেও জিরো আওয়ারে এ বিষয়ে বলার সুযোগ দেওয়া হয় রাহুলকে। তবে রাহুল যে আজ এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করবেন, তা আগেই আন্দাজ করেছিল সরকার। তাই তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রী আগে থেকেই জবাব দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। সংসদের ভিতরে ও বাইরে তিনি বলেন, ‘‘সকলের দরজায় ইন্টারনেট পরিষেবা পৌঁছে দিতে চান প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সরকার ডিজিটাল ইন্ডিয়ার
স্বপ্ন দেখছে। ইন্টারনেট নিরপেক্ষতার ইতি ও নেতিবাচক দিক বিচার করে কমিটি সুপারিশ দিলে কেন্দ্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।’’

প্রসঙ্গত, নেট নিউট্রালিটি বা অন্তর্জালের নিরপেক্ষতার মূল কথা, ইন্টারনেটে সব ধরনের পরিষেবার জন্য একই মাসুল ধার্য করা। কিন্তু সম্প্রতি আলাদা মাসুলের কথা বলে বেশ কয়েকটি পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা। বিতর্কের সূত্রপাত সেখান থেকেই। রবিশঙ্কর প্রসাদ সরকারি কমিটি কেন গড়েছেন, এই প্রশ্ন তুলে রাহুল বলেন, ‘‘সরকারের উদ্দেশ্য খারাপ। এ বার কর্পোরেটের হাতে তুলে দিতে চায় ইন্টারনেটের নিরপেক্ষতাও। কংগ্রেস সর্বশক্তি দিয়ে তা ঠেকানোর চেষ্টা করবে।’’

এ বার কেদার

কৃষকে রয়েছেন, আবার কেদারেও রয়েছেন! শাস্ত্রমতে চার ধাম যাত্রা শুরু হবে পরশু। তার আগে বুধবার কংগ্রেস সূত্র জানাচ্ছে, সে দিন হেঁটে কেদারনাথ মন্দিরের দরজায় পৌঁছবেন রাহুল গাঁধী! শীর্ষ নেতাদের পরামর্শে ব্যাপারটা স্থির হয়েছে, হঠাৎই! নইলে পরশু অমেঠী যাওয়ার কথা ছিল রাহুলের। কিন্তু হঠাৎ কেদারনাথ কেন? কংগ্রেসের প্রধান মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালা বলেন, ‘‘যে কারণে মানুষ কেদারনাথ যাত্রায় যান, সে কারণেই।’’ তবে পর্যবেক্ষকদের মতে, যে জন্য অজমের শরিফে চাদর চড়াতে সংসদ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মোখতার আব্বাস নকভিকে পাঠাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী, তেমন রাহুল যাচ্ছেন কেদারে। লোকসভা ভোটের পর এ কে অ্যান্টনি-সহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা দেখাতে গিয়ে কংগ্রেস নিজেকে সংখ্যালঘু-তোষণকারী হিসেবে প্রতিপন্ন করেছে। এই অবস্থানের বদল প্রয়োজন। রাহুলের পদক্ষেপে সেই বদলই দেখছেন রাজনীতির পর্যবেক্ষকরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE