‘‘দাদাবাবু, চলো না ঘুরে আসি। অ্যাতো দিন হয়ে গেল এই ভিন রাজ্যে এয়েছি, অথচ জুহু বিচটাও তো দেখালে না। কাছেই তো!’’
‘‘যাব যাব। গেলেই হয়—। কাল পরশু গেলেও তো হবে। তোমার বিচ তো আর পালিয়ে বা হারিয়ে যাবে না।’’
প্রথমে আবদার। পরে তার সঙ্গে গোঁসার ভাব জুড়ে রক্ষেকালীর পান-খেকো ঠোঁট-ওল্টানো,
‘‘হুঁহ্! আপনি আর গ্যাছো। ছাই—থাক দরকার নেই গিয়ে। এই ঘরের মধ্যেই পচে মরি—ছোঃ—’’।
ওঁর সেই গোঁসা ভাঙাতেই এত দিনে, জোর করে আলস্যি খেদিয়ে আজ এসে পড়েছি জুহু সৈকতে। অবশ্য এখানে বা সমুদ্রের এই খ্যাতনামা বেলাভূমিতে যদিও বহু বার আসা হয়েছে। ফি বছর। তবে, তা হল গিয়ে—দায়িত্ব পালনে। দুর্গোৎসবের শেষ দিনে। বিসর্জনের দিন সদলবলে, বলতে গেলে প্রায় চল্লিশ-পঞ্চাশ জনের শোভাযাত্রার সঙ্গে সঙ্গে। পদব্রজে বান্দ্রা থেকে জুহু অবধি। কাঁসর-ঘণ্টা-ঢাক-ঢোলের বাজনা-বাদ্যির তালে তালে নাচ-গান ও ‘দুগগা মাঈকি জয়’ ইত্যাদি সহযোগে। সারা লিংক রোডে, বিশেষত এই ভিন রাজ্যে সে ভারি অভিনব দৃশ্য। বাঙালিদের ভাসান উৎসবের শোভা দেখতে দু’ ধারের বারান্দা-জানালায় জড়ো হয়।.....
সে যাক গে। যে কথা বলা হচ্ছিল। সেই বিজয়াদশমীর দিন ছাড়া যাতায়াতের পথে সৈকত দেখতে পেয়েছি এক ঝলক। ব্যাস, ওই পর্যন্তই। নেমে, সময় নিয়ে, ঘুরে-ফিরে দেখার মতন, মুক্ত মনে বিশুদ্ধ বাতাস বুক ভরে নেওয়ার সময় হয়ে ওঠেনি, হায়! এই অ্যাতগুলো দশক এ রাজ্যে বসবাস করেও। ফলে আজ বালির ওপর খালি পায়ে হাঁটতে দারুণ ভাল লাগছে। রক্ষেকালীও আমার দেখাদেখি বাঁ-হাতে চটি নিয়ে খালি পায়েই হেঁটে চলেছে।
সৈকতের বালি তিন ভাগে ভাগ করা যায়। গোড়ালি অবধি জলে বালি ডুবে যাচ্ছে ঢেউয়ের আনাগোনায়। ক্রমশ পায়ের দিকে স্রেফ স্যাঁতসেঁতে ভেজা বালি। আর আমরা হাঁটছি পুরোপুরি শুকনো বালিতে। যার বালুকণা দমকা বাতাসে ওড়াওড়ি করে। কী হল, হঠাৎ রক্ষেকালী শুকনো বালি উড়িয়ে দৌড়োতে লাগল। এক্কেবারে কচি বালিকাটির মতন। ভারী শরীর। ভয় পেলুম, হুমড়ি খেয়ে পড়ে না যায়। ভেজা বালি পেরিয়ে এক্কেবারে জলের কিনারায়। ভাটার নিস্তেজ ঢেউ ওর পা ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। অঞ্জলি ভরে হাতে খানিকটা জল নিয়ে পেরথম ঠেকাল মাথায়। দ্বিতীয় অ়ঞ্জলি মুখে দিয়েই বলে উঠল, ‘‘ভারী নোনতা!’
আসলে ও তো এই প্রথম সমুদ্র দেখছে। চেখেও।
আমিও ওর দেখাদেখি জলের কাছে নেমে এসেছি। রক্ষেকালী বললে, ‘‘সমুদ্দুরের জল তো কাজে লাগানো যায়, দা’বাবু!’’
‘‘কী রকম’’? ও একেবারে দেখি খুশিতে ডগোমগো। বললে, ‘‘ক্যানো? ছেঁকে, চামরমণি চাল, আলু ঢেলে উনুনে চাপিয়ে দিলেই হল। ফাস্টো কেলাশ ভাতে-ভাত হয়ে যাবে। কাঁচা লংকা ডলে খেয়ে নাও। লবণ লাগবে না। হে হে!’’
অ্যাতো দিনে বোঝা গেল সমুদ্দুরের দলের প্রধান উপকারিতা!
পায়ের পাতা ডোবা জলে হাঁটছি দক্ষিণ মুখো। পশ্চিমে, আমাদের ডান হাতে সূর্য নেমে গেছে জলে অর্ধেকের বেশি। বা দিকে সার বাঁধা সব বড় বড় হোটেলের পেছনে দেওয়াল শুরু হচ্ছে। দু’চার কদম এগোতেই হঠাৎ রক্ষেকালীর চাপা চিৎকার,
‘‘ম্যাঁ—গো’’।
চমকে উঠে ওর দিকে নজর ফেলতেই দেখে, আঁচল দিয়ে নাক চেপে প্রায় লাফিয়ে সরে যাচ্ছে জলের দিকে। কী হল, কী হল করে একটু এগোতেই অদৃশ্য দেওয়ালে ধাক্কা খেলুম। ‘অদৃশ্য’ এই জন্যে যে, এ দেওয়াল না ইটের তৈরি, না পাথরের। মাটিরও নয়। বাঁ দিকে হোটেলের দেওয়াল সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সেদিক থেকেই বীভৎস কটু গন্ধ ছড়াচ্ছে। উগ্র, ঝাঁঝালো। কটু গন্ধে ম’ ম’ করছে এমন সুন্দর অপাপবিদ্ধ প্রকৃতি। যেখানে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষি, জাতি, ধর্ম নির্বিচারে বিশুদ্ধ ‘হাওয়া খেতে’, সমুদ্র ও তার বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে মন-প্রাণ-ভাল করতে আসে, সেখানে অকস্মাৎ বিপরীত বোধের আক্রমণের মতো প্রস্রাবের দুর্গন্ধ ঝাঁপিয়ে পড়ে, পাঁচটি ইন্ডিয়াকে তছনছ করে দেয়। বিষাক্ত করে অস্তিত্ব, মন, প্রাণ এবং যাবতীয় পরিপার্শ্বের সুন্দরতাকে।