দেশের অর্থনীতির প্রয়োজনেই যে ভর্তুকি ছাঁটাইয়ের মতো কড়া দাওয়াই জরুরি, বিজেপি নেতারা তা ভালই জানতেন। তবু মনমোহন সিংহের জমানায় তাঁরা এ জাতীয় পদক্ষেপের বিরোধিতা করেছেন স্রেফ রাজনৈতিক ফায়দা তুলতে। ভর্তুকির গ্যাস সিলিন্ডারের কোটা কমিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে পথেও নেমেছিলেন তাঁরা। অথচ কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকেও এখন কড়া আর্থিক ব্যবস্থার বার্তাই দিতে হচ্ছে। আর ভুক্তভোগী হয়েও কংগ্রেস এখন বিজেপির ছেড়ে যাওয়া জামাটাই পরে নিতে চাইছে। অর্থনীতির যুক্তি যা-ই বলুক, মানুষের দুর্ভোগ নিয়ে মুখর হয়েই পায়ের তলায় জমি খুঁজতে চাইছেন সনিয়া ও রাহুল গাঁধীরা।
গোয়ায় দলীয় বৈঠকে গিয়ে গত পরশু প্রধানমন্ত্রী বলেন, “অর্থনীতির উন্নতি ঘটাতে কড়া ব্যবস্থা নিতেই হবে। এ জন্য দেশের মানুষ আমাকে অপছন্দ করবেন। কিন্তু এ ছাড়া আর কোনও উপায় নেই।” মোদী অবশ্য এ-ও বলেন, “মানুষ যখন দেখবেন কঠোর পদক্ষেপে দেশের আর্থিক হাল ফিরেছে, তখন আবার তাঁদের ভালবাসা ফিরে পাব।”
প্রধানমন্ত্রীর মুখ থেকে এই ধরনের কোনও মন্তব্যেরই অপেক্ষায় ছিল কংগ্রেস। তারা আজ পাল্টা প্রশ্ন করেছে, মনমোহন সরকারের কড়া দাওয়াইয়ের সমালোচনা করে এই মোদীই বলেছিলেন, ‘আচ্ছে দিন আনেওয়ালে হ্যায়।’ এখন তবে কড়া দাওয়াই দিতে হবে কেন? ভোটের প্রচারে বিজেপি জিনিসপত্রের দাম কমানোরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সেই প্রতিশ্রুতি পালন না করে মোদীর এই উল্টো সুর কেন?
এর উত্তর অবশ্য আগামই দিয়ে রেখেছেন মোদী। গোয়ায় সে দিনই তিনি বলেছিলেন, “এমন একটা সময়ে দেশের রাশ হাতে নিয়েছি, যখন আগের সরকার কিছুই রেখে যায়নি। সব শূন্য করে দিয়েছে। দেশের অর্থনীতি এখন তলানিতে।”
এই ব্যাখ্যা উড়িয়ে দিয়ে কংগ্রেস মুখপাত্র তথা গুজরাতের নেতা শক্তি সিন গোহিল আজ বলেন, “ভোটের সময় দেওয়া আকাশকুসুম প্রতিশ্রুতি যে পালন করা সম্ভব নয়, ক’দিনেই তা বুঝে গিয়েছেন মোদী। এখন তাই অজুহাত খুঁজছেন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরেও কাজ না করে স্রেফ রাজনীতি করছেন।” কংগ্রেস মুখপাত্র উল্লেখ করেন, বিশ্ব জুড়ে মন্দা ও নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্যেও মনমোহন জমানায় দেশের আর্থিক বৃদ্ধি হয়েছে। অথচ মোদী ক্ষমতায় আসার পরে গত মাসের তুলনায় এ মাসে মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়ে গিয়েছে।
ঘরোয়া আলোচনায় কংগ্রেস নেতারা বলছেন, অর্থনীতির চাকা ঘোরানো সহজ কাজ নয়। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মনমোহনকে এই কারণেই কড়া দাওয়াইয়ের কথা বলতে হয়েছিল। সার ও পেট্রোপণ্যের দাম ঠিক করার ভার সরকারের হাত থেকে ছেড়ে দেওয়া, ভর্তুকিতে দেওয়া রান্নার গ্যাসের সিলিন্ডারের সংখ্যা কমানো, ভর্তুকির টাকা সরাসরি মানুষের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে পৌঁছে দেওয়ার মতো সিদ্ধান্তও নিয়েছিলেন সে কারণেই। রাজনৈতিক বিপদ আছে জেনেও দেশের অর্থনীতির স্বার্থে কড়া দাওয়াই দিতে দ্বিধা করেননি তিনি। সেই সঙ্গে খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি লগ্নির দরজা খুলে আরও বিনিয়োগ টেনে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে চেয়েছিল সরকার। কিন্তু বিজেপি তখন রাজনৈতিক কারণে এ সবের অন্ধ বিরোধিতা করেছিল। কংগ্রেস এ বার সেই একই পথে বেগ দিতে চায় বিজেপিকে।
তবে মোদীর সুবিধা একটাই, মনমোহনের মতো তাঁকে শরিকদের তোয়াজ করে চলতে হবে না। বরং কংগ্রেস বা বিরোধীরা আপত্তি করলেও সংস্কারের বিপুল সুযোগ রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর সামনে। তাই কংগ্রেসের আক্রমণকে আমল না দিয়ে বিজেপি মুখপাত্র মীনাক্ষী লেখি এ দিন মনে করিয়ে দেন, “সংস্কার প্রশ্নে ইউপিএ-র অন্দরেই বিরোধ ছিল। নীতিপঙ্গুত্ব গ্রাস করেছিল সরকারকে। তাই অর্থমন্ত্রী হিসেবে যে মনমোহন নয়ের দশকে উদারিকরণের পথে হেঁটে বিশ্বায়নের দরজা খুলে দিতে পেরেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী হয়ে তাঁকেই প্রতি পদে হোঁচট খেতে হয়েছে। এ জন্য বিজেপিকে দুষে লাভ নেই।”
এই চাপানউতোরের মধ্যে দুই শিবিরের নেতারাই মানছেন, অর্থনীতি ও রাজনীতির এই দ্বন্দ্বটাই এ দেশে বাস্তব ও চিরন্তন। গঠনমূলক বিরোধিতা স্রেফ একটা কথার কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy