দু’নম্বর মোদী নাকি দু’নম্বর রণকৌশল!
শশী তারুরের মুখে নরেন্দ্র মোদীর প্রশংসা কংগ্রেসের ভিতরে-বাইরে অনেকেরই চোখ কপালে তুলেছে। শশী বলেছেন, দশ বছর ধরে যে মোদীকে সবাই দেখেছে, প্রধানমন্ত্রী মোদী তার চেয়ে অনেক আলাদা। ইনি ‘মোদী ২’ বা ‘মোদী ২.০’।
কংগ্রেস আনুষ্ঠানিক ভাবে শশীর মন্তব্যের থেকে নিজেকে আলাদা করে রেখেছে ঠিকই। কিন্তু দলের একাংশের সঙ্গে কথাবার্তা বললে আরও একটা সম্ভাবনার কথাও উঠে আসছে। সেটা হল, প্রথম থেকেই মোদীর বিরুদ্ধে গলা না চড়িয়ে কংগ্রেস আসলে একটা বার্তাও দিতে চাইছে। দায়িত্বশীল বিরোধীর ভূমিকা পালন করার বার্তা। শশীর মন্তব্যকে সেই নিরিখে বিচার করলে একটা ট্র্যাক টু বা সমান্তরাল রণনীতির ইঙ্গিতই উজ্জ্বল হচ্ছে।
কী রকম? নরেন্দ্র মোদী ২৮২টি আসন নিয়ে সবে ক্ষমতাসীন হয়েছেন। কংগ্রেসের আসন ৫০-এর নীচে নেমে গিয়েছে। এখন এই মুহূর্তে গোড়া থেকেই আক্রমণাত্মক বিরোধিতায় যেতে চান না সনিয়া গাঁধী। কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছেন, মোদী সরকারের বিরুদ্ধে অন্তত আগামী এক বছর আক্রমণাত্মক হওয়া অর্থহীন। বরং শশীর মতো নেতার মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ট্র্যাক টু রাজনীতি করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। এই ট্র্যাক টু রাজনীতির মাধ্যমে কংগ্রেস প্রথমে সরকারের কাছ থেকে বিরোধী দলনেতার পদটি আদায় করতে চায়।
লোকসভায় কংগ্রেসের এখন আসন সংখ্যা ৪৪। কংগ্রেসকে বিরোধী দলের মর্যাদা দেওয়া যাবে না বলে ইতিমধ্যেই হুঙ্কার ছেড়েছে বিজেপি। অতীতে নেহরু কিন্তু দুর্বল বিরোধী শিবির দেখেও সিপিআই সাংসদ পি সুন্দরাইয়াকে বিরোধী দলনেতার মর্যাদা দিয়েছিলেন। ইউপিএ জমানায় কংগ্রেস এনডিএ-কে ডেপুটি স্পিকারের পদ দিয়েছিল। বিজেপি কিন্তু কংগ্রেসকে সেটি দিতেও রাজি নয়। বরং এডিএমকে-কে ওই পদ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এই আবহে মোদীর সঙ্গে একটি সমান্তরাল কূটনীতির দরজা খুলে রাখতে চাইছে কংগ্রেস। সেটা যেমন এই মুহূর্তের জন্য জরুরি, তেমনই মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
জয়রাম রমেশ সে দিকে তাকিয়েই বলছেন, “কৌটিল্য বলেছেন, প্রতিপক্ষ শক্তিশালী হলে যুদ্ধ করতে নেই। এখন মোদী সরকার সম্পর্কে মানুষের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। এখনই আমরা নিন্দা করব কেন?” কার্যত শশীকে সমর্থন করেই জয়রাম বলেন, “সরকার প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হলে তখন আমরা সমালোচনা করব। তার আগে নয়।”
প্রায় এই কথাটাই কিন্তু লিখেছিলেন শশী। একটি মার্কিন ওয়েবসাইটে নিজস্ব কলামে শশী লেখেন, মোদীকে এত দিন বিভাজনের রাজনীতির মুখ হিসেবেই দেখেছেন বিরোধীরা। কিন্তু ভোটে জেতার পর মোদী যে ভাবে সামগ্রিক উন্নয়ন ও সবাইকে নিয়ে চলার কথা বলছেন, তা বিস্ময়কর ঠিকই। কিন্তু তাঁর এই অবস্থানকে স্বাগত না-জানিয়ে বিরোধিতার স্বার্থে বিরোধিতা করা ঠিক হবে না। শশীর বক্তব্য, অনেকেই ভেবেছিলেন মোদী ক্ষমতায় আসার পরে বিজেপির কট্টর মতাদর্শকে সামনে রেখে উল্লাস শুরু হবে। অথচ মোদী তা করেননি। এমন কোনও শব্দই ব্যবহার করেননি যাতে সংখ্যালঘুদের ভাবাবেগ আহত হতে পারে। তারুরের মতে, তিনি মোদী-অনুরাগী নন। কিন্তু প্রাথমিক পর্বটুকু এখনও ইতিবাচকই।
লক্ষণীয়, শশী শুধু কলাম লিখেই রণে ভঙ্গ দেননি। সংবাদমাধ্যমেও মোদীর স্তুতি করেছেন। মোদী যে তাঁর সঙ্গে টুইটে যোগাযোগ রাখতেন, সে কথাও উল্লেখ করেছেন। শশী বলেছেন, ‘মোদী ২’ বা ‘মোদী ২.০’কে এখনই সমালোচনা করার মতো কিছু ঘটেনি। মোদী যদি আবার ‘মোদী ১’ অর্থাৎ বিভাজনের পুরনো রাজনীতিতে ফিরে যান, তা হলে অবশ্যই আবার সুর চড়ানো হবে।
আনুষ্ঠানিক ভাবে অবশ্যই কংগ্রেসের তরফে শশীর এই সব কথাকে সমর্থন করা সম্ভব নয়। তা করা হয়ওনি। দলের পক্ষ থেকে বিবৃতি দিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারুরের বক্তব্য তাঁর ব্যক্তিগত মন্তব্য। মোদীর প্রশংসা করা দলের নীতি নয়। মণিশঙ্কর আইয়ার বা দিগ্বিজয় সিংহের মতো নেতারা প্রকাশ্যে শশীর সমালোচনাও করছেন। আইয়ার তো শশীকে ‘অপরিণত’ বলে আখ্যা দিয়ে নিজের হতাশা ব্যক্ত করেছেন।
পাশাপাশি কংগ্রেস মহলেই কিন্তু অনেকে বলছেন অতীতে মণিশঙ্কর-দিগ্বিজয় সিংহ, এমনকী জয়রামও কখনও কখনও হাইকমান্ডের মনোভাব না জেনেই আলটপকা মন্তব্য করে বসেছেন। শশীর কিন্তু সে বদনাম নেই। সংসদে কংগ্রেসের নেতা সত্যব্রত চতুর্বেদীই বলছেন, “শশী যথেষ্ট ভাবনাচিন্তা করেই কথা বলেন। এ হেন শশী কেন এ কথা বললেন, সেটা আমার কাছেও রহস্য।” তা ছাড়া তাঁদের প্রশ্ন, শশী যদি পার্টি লাইনের বিরুদ্ধেই কথা বলে থাকেন, তা হলে তাঁকে দলের মুখপাত্র পদ থেকে সরিয়ে দেওয়াই বা হচ্ছে না কেন?
সে ক্ষেত্রে হিন্দি কবি সত্যব্রতের মতো অনেক নেতাই এখন ভাবছেন, ১০ জনপথের ঘনিষ্ঠ শশী হাইকমান্ডের সঙ্গে শলা-পরামর্শ করেই সম্ভবত এই কৌশল নিয়েছেন। কারণ সনিয়া চাইছেন, মোদী বিরোধী আক্রমণের তাপমাত্রা আপাতত কমিয়ে সংসদীয় গণতন্ত্রে একটি সহজ স্বাভাবিক সম্পর্ক তৈরি করতে। সংসদে যত বার মোদীর মুখোমুখি হয়েছেন, সনিয়া নিজেও হাসিমুখেই সৌজন্য বিনিময় করেছেন।
আবার শশী নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে দলের প্রধান মুখপাত্র অজয় মাকেনকে আজ যে চিঠি দিয়েছেন, তাতেও যথেষ্ট কৌশলী অবস্থানেরই ইঙ্গিত রয়েছে। সেখানে শশী লিখেছেন, তাঁর কলামটা পুরোটা মন দিয়ে পড়লেই তাঁর উদ্দেশ্য বোঝা যেত। তাঁর মতে, “কিছু বিষয়ে মোদীর প্রশংসা করে আমরা মানুষের প্রত্যাশা আরও উঁচু তারে বাঁধতে সাহায্য করতে পারি। পরে তা হলে সেই মাপকাঠি থেকেই মোদীর বিশ্লেষণ হবে।” তাঁর আরও দাবি, কংগ্রেস যদি এখন কিছুটা উদার মনোভাব দেখায়, ভবিষ্যতে তাদের সমালোচনা মানুষের কাছে অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে। শশীর মতে, দলের উচিত সমালোচনার উপযুক্ত মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করা।
শশীর এই অবস্থান সনিয়ার কৌশলের বিরোধী নয় বলেই দলের একাংশের দাবি। কংগ্রেস যখন ক্ষমতায় ছিল, বিজেপি গঠনমূলক বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেনি। সনিয়া গাঁধী সেটা চান না। তিনি এক দিকে দলীয় নেতাদের একাংশকে দিয়ে শশীর বিরোধিতা করাচ্ছেন। তাতে কংগ্রেসের মোদী-বিরোধিতার তাস অটুট থাকছে। আবার শশীর মতো নেতাকে দিয়ে সমান্তরাল রণনীতিও চালাতে চাইছেন।
একেই কি বলে ট্র্যাক টু বা দ্বিস্তরীয় কৌশল?
প্রশ্ন করা হলে, শশী কেবল মুচকি হাসেন। তার পর বলেন, “আমার যা বলার ইতিমধ্যেই বলেছি। নতুন করে আর কী বলব?”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy