আমলাতন্ত্রকে নাড়া দিয়ে মন্ত্রীদের প্রথম একশো দিনের কাজ বেঁধে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
নতুন সরকারের তিন দিনের মাথায় দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আজ মোদী স্পষ্ট করে দেন, ক্ষমতায় এসে দ্রুততার সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করাই তাঁর লক্ষ্য। উন্নয়ন আর সুশাসনের যে মন্ত্র বলে তিনি দিল্লির কুর্সিতে বসেছেন, দ্রুততার সঙ্গে তা সকলের সামনে মেলে ধরতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী। তার জন্য ঘুণ ধরা প্রশাসনেরও বদল প্রয়োজন। নরেন্দ্র মোদীর সরকার কী করতে চাইছে, আগামী সপ্তাহে শুরু হওয়া সংসদের অধিবেশনে তার বিবরণ দেবেন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। মোদী নিজেও টেলিভিশনের মাধ্যমে আমজনতার কাছে তাঁর কাজের রূপরেখা পেশ করতে পারেন। তার আগে আজ মন্ত্রিসভার সদস্যদের মোদী বলে দিলেন, তাঁদের প্রথম একশো দিনের কাজ কী হবে।
লোকসভার প্রচারের সময়ই গুজরাত মডেলের সাফল্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মোদী বলেছিলেন, ইচ্ছাশক্তি ও সঠিক নীতি থাকলে একই আমলা এবং একই ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করে তাকে দিয়েই অন্য ভাবে কাজ করানো যায়। এ বারে ক্ষমতায় এসে নিজের সরকারের গোড়া থেকেই মনমোহন-জমানার পঙ্গুত্ব কাটিয়ে গোটা সরকারিতন্ত্রে একটি খোলা বাতাস আনতে চাইছেন মোদী। যাতে নতুন নতুন ভাবনার সঙ্গে হাত খুলে কাজ করতে পারেন আমলারাও। রাজনৈতিক প্রভুদের ভয়ে সিঁটিয়ে না থাকেন। কোনও সিদ্ধান্ত নিতে পিছ-পা না হন। মোদী মনে করেন, সরকার যদি সব ক্ষেত্রে একটি স্বচ্ছ ও স্থায়ী নীতি রূপায়ণ করতে পারে, তা হলে এমনিতেই দুর্নীতি রোধ হবে। সে কারণে ই-নিলামের মতো বিষয়গুলিকে অনেক বেশি করে উৎসাহ দেওয়া দরকার। যা না থাকায় মনমোহন সিংহের জমানায় একের পর এক দুর্নীতি হয়েছে।
এ দিন মন্ত্রীদের একশো দিনের কাজের রূপরেখা বেঁধে দিতে গিয়ে মোদী একটা ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। অতীতে কংগ্রেস যেমন প্রথম একশো দিনে কাজের কর্মসূচি ঘোষণা করেছিল, এ দিন সে পথে হাঁটেননি তিনি। পাছে একশো দিনের মধ্যে সে কাজ সম্পূর্ণ না হলে বিরোধীরা আক্রমণের সুযোগ পান। কিন্তু একশো দিনের মধ্যে সব মন্ত্রকের অগ্রাধিকার কী হবে, তা নিয়ে আজ থেকেই মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদা করে বৈঠক শুরু করে দিলেন তিনি। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডু বলেন, “প্রধানমন্ত্রী আজ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, প্রথম একশো দিনের টাইম-টেবিল কী হবে। যে সব বিষয় বকেয়া রয়েছে, তার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে বলেছেন। প্রতিমন্ত্রীরা যাতে আগের মতো উপেক্ষিত না থাকেন, তাঁদেরও যেন যথেষ্ট কাজ দেওয়া হয়, তার নির্দেশ দিয়েছেন। সকলকে নিয়েই একটি টিম তৈরি করে দক্ষতা বাড়িয়ে রূপায়ণ করাই লক্ষ্য প্রধানমন্ত্রীর।”
শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পরিকাঠামোয় জোর তো বটেই, প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তাদের বক্তব্য, প্রত্যেকটি মন্ত্রকের কাজ বেঁধে সময়ের মধ্যে তা শেষ করতে চাইছেন মোদী। সব মন্ত্রকের মধ্যে সমন্বয় করে সামগ্রিক উন্নয়ন করা সম্ভব হলেই অর্থনীতির মোড় ঘুরবে। উৎপাদন ও বৃদ্ধি বাড়লে, মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ টানা যাবে। বাড়বে কর্মসংস্থান। কারণ এর উপরেই নির্ভর করছে পরবর্তী লক্ষ্য অর্থাৎ আর্থিক সংস্কারের বিষয়টি। মোদীর সেনাপতি অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি অবশ্য এখন থেকেই তার প্রক্রিয়া শুরু করে দিয়েছেন। পণ্য ও পরিষেবা কর এই বছরেই চালু করতে আজই বৈঠক করেছেন জেটলি। বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে একটি অনুকূল পরিবেশও তৈরি করতে চাইছেন তিনি। নয়া অর্থমন্ত্রীর স্পষ্ট বক্তব্য, প্রশাসনিক ব্যবস্থা যদি স্বচ্ছ থাকে, তা হলে লগ্নিকারীরা যেমন উৎসাহিত হবে, তেমনই লাল ফিতের ফাঁস কাটলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও এগিয়ে আসবেন।
নির্বাচনী ইস্তাহারেই বিজেপি স্পষ্ট করে দিয়েছিল, খুচরো ব্যবসা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রের দরজাই খুলে দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হবে। সেই সূত্র ধরেই কাজ করছেন জেটলি। প্রাথমিক আলোচনা শুরু হয়েছে খুচরো ব্যবসার ভবিষ্যৎ নিয়েও। অর্থ মন্ত্রক সূত্রের মতে, মনমোহন জমানার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি বদলে দেওয়ার থেকে অন্তত বহু-ব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় লগ্নির ঊর্ধ্বসীমা কমানোর ভাবনা রয়েছে। প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকেই মোদী কালো টাকা উদ্ধারের বিষয়ে বিশেষ তদন্তকারী দল বা ‘সিট’ গঠন করেছিলেন। আগামী সপ্তাহ থেকেই সেই দল তদন্তের কাজ শুরু করে দেবে।
শুধু সরকারের দক্ষতা বাড়াতে খোলনলচে বদলই নয়, মন্ত্রীদের কর্মসংস্কৃতি কী হওয়া উচিত, তারও পাঠ আজ পড়িয়েছেন মোদী। বিভিন্ন মন্ত্রক যাতে দুর্নীতির আখড়া না হয়ে ওঠে, সে জন্য আত্মীয়দের ব্যক্তিগত স্টাফ করা যাবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এ বারে বলছেন, মানুষের সঙ্গে নিরন্তর যোগাযোগ রাখতে সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটকে আরও বেশি করে ব্যবহার করতে হবে মন্ত্রীদের। রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি-সহ শীর্ষ মন্ত্রীদের বেশ কয়েক জন টুইটারের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সক্রিয় হলেও অনেকেই আবার নন। এই অবস্থায় সব মন্ত্রীকেই টুইটার এবং ফেসবুক অ্যাকাউন্ট খুলতে নির্দেশ দিয়েছেন মোদী। তাঁর বক্তব্য, সাধারণ মানুষের একটি অংশ, যাঁরা সরাসরি মন্ত্রীদের কাছে পৌঁছতে পারছেন না, তাঁদের কাছে আরও বেশি করে পৌঁছতে এই সব নেটওয়ার্কিং সাইটের প্রয়োজন খুব বেশি। সে কারণে যে সব নীতি নেওয়া হচ্ছে, সরকারি প্রচারের পাশাপাশি এই সব সাইটেও সে সব নিয়ে মন্ত্রীরা যেন নিয়মিত পৌঁছে যান জনতার দরবারে।
নিজের দফতর থেকে বেরিয়ে আসছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। বৃহস্পতিবার নয়াদিল্লিতে। ছবি: এপি।
পাশাপাশি শুনতে হবে রাজ্যগুলির সমস্যাও। ইউপিএ জমানায় বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি যে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে, মোদী চান না, এ বারেও সেই একই অভিযোগ উঠুক। বরং রাজ্যের সাহায্য ছাড়া যে দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়, তা তিনি বিলক্ষণ জানেন। তাই গোড়া থেকেই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ককে অনেক বেশি সহজ এবং সহযোগিতামূলক করার
উপরে জোর দিয়েছেন মোদী। সব মন্ত্রীকেই নির্দেশ দিয়েছেন, রাজ্য থেকে আসা সমস্যাগুলির দ্রুত সমাধান করতে হবে।
একশো দিন দশ দাওয়াই
• বিভিন্ন মন্ত্রকে সমন্বয়
• সময় বেঁধে কাজ
• সংস্কার শিক্ষা-স্বাস্থ্যে
• নয়া ভাবনায় উৎসাহ
• মূল্যবৃদ্ধিতে রাশ
• দুর্নীতি রুখতে ই-নিলাম
• লগ্নির পরিবেশ ফেরানো
• স্থায়ী ও বাস্তব উপযোগী নীতি
• মন্ত্রীরা কথা বলুন ফেসবুক-টুইটারেও
• আমলাদের নির্ভয়ে ও স্বাধীন ভাবে কাজের সুযোগ