সংসদে দাঁড়িয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তারিফ করে তাঁর সামনে খুড়োর কল ঝুলিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।
রাষ্ট্রপতির বক্তৃতা-বিতর্কে অংশ নিয়ে গত কালই মোদী-বিরোধিতায় নেমেছিলেন তৃণমূল সাংসদদের একাংশ। বিশেষ করে লোকসভার সদস্যরা। কিন্তু আজ জবাবি বক্তৃতা দিতে উঠে পাল্টা আক্রমণের পথে না হেঁটে মমতার প্রশংসা করলেন প্রধানমন্ত্রী। বললেন, “৩৫ বছরের বাম অপশাসন থেকে রাজ্যকে বার করে আনতে কী পরিশ্রমই না করেছেন মমতাজি।” বিজেপি নেতাদের অনেকেরই মতে, তৃণমূল নেত্রীর প্রতি মোদী আদতে এই বার্তাই দিলেন যে, ভোট প্রচার চলাকালীন তুঙ্গে ওঠা তিক্ততা পিছনে ফেলে রাজ্য সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলতেই তিনি আগ্রহী। এখন মমতা কী করবেন, সেটা তাঁর ব্যাপার।
তৃণমূলের তরফেও অবশ্য আজ কেন্দ্রের সঙ্গে গঠনমূলক সহযোগিতা এবং বিরোধিতার ক্ষেত্রে পরিশীলিত আচরণ করার ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। দল সূত্রে বলা হচ্ছে, গত কালও এমনই অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। কিন্তু লোকসভার সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অতি সক্রিয় বিরোধিতা এবং ব্যক্তি আক্রমণের জেরে সেই সুর কেটে যায়। এতে ক্ষুব্ধ হন মমতা। আজ ইতিবাচক বার্তা দেওয়ার দায়িত্ব তিনি দেন নবাগত সাংসদ সুগত বসুকে।
অনেকেরই মত, সেই কাজে সুগতবাবু সফল। বিজেপি নেতারা ঘরোয়া ভাবে তাঁর বক্তৃতার প্রশংসা করেছেন। এমনকী সনিয়া গাঁধীও একাধিক বার টেবিল চাপড়েছেন। বক্তৃতা শেষ হলে স্পষ্ট বাংলায় সুগতবাবুকে বলেছেন, “খুব ভাল!” শশী তারুর, অধীর চৌধুরীরা উঠে এসে অভিনন্দনও জানিয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের এই অধ্যাপককে।
বিজেপি এবং তৃণমূল দু’পক্ষই নিজেদের এই অবস্থান বজায় রাখলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সুসম্পর্কের বাতাবরণ তৈরি হতে পারে। যে বাতাবরণ তৈরি করা প্রধানমন্ত্রী মোদীর ঘোষিত লক্ষ্য। লোকসভা ভোটের আগেই মোদী স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে ক্ষমতায় এলে তিনি নিরপেক্ষ ভাবে প্রশাসন চালানোর উপরই গুরুত্ব দেবেন, ভোট চলাকালীন রাজনৈতিক বাগ্যুুদ্ধের উপরে নয়। লোকসভা ভোটের সময়ে মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফর ও অনুপ্রবেশকারী সংক্রান্ত মন্তব্যের জেরে মমতার সঙ্গে তাঁর তীব্র চাপান-উতোরের সাক্ষী থেকেছে দেশ। মমতা যখন তুই-তোকারির স্তরে নেমে মোদীর কোমরে দড়ি পরানোর হুমকি দিয়েছেন, তখন মোদীও রাজ্যে এসে তীব্র শ্লেষে সারদা-কাণ্ড নিয়ে বিঁধেছিলেন ‘দিদি’কে।
কিন্তু তখনই আনন্দবাজারকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে মোদী স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, পশ্চিমবঙ্গের উন্নয়ন নিয়ে তাঁর নিজস্ব কিছু ভাবনা রয়েছে। ক্ষমতায় এলে রাজ্যের সহযোগিতা নিয়ে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে চান তিনি। বিজেপি বা বিরোধী-শাসিত সব রাজ্যের জন্যই যে তাঁর একই রকম পরিকল্পনা, সে কথা আজ বক্তৃতায় স্পষ্ট করে দিয়েছেন মোদী। তিনি বলেন, “যখন ভোট চলছিল, তখন আমরা ছিলাম ভোটপ্রার্থী। এখন ভোট শেষ, আমরা এখন জনগণের প্রত্যাশার রক্ষাকর্তা। সকলকে সঙ্গে নিয়ে আমি সেই কাজ করতে চাই।”
বিজেপির এক শীর্ষ নেতার মতে, মোদীর উন্নয়নের দর্শনই হল, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে চলা। সেই নিরিখে মমতাকেও সাহায্য করতে তিনি প্রস্তুত। নিজের রাজ্যে মমতা যতই বিজেপি-বিরোধিতায় সরব হোন, তিনি যে প্রতিহিংসাপরায়ণ হবেন না, আজ সেই বার্তাই দিয়ে রাখলেন মোদী।
বস্তুত আজ লোকসভা ও রাজ্যসভায় মোদী বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন যে, বিরোধী দলগুলির সাহায্য ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। উন্নয়নকে তিনি গণ-আন্দোলনে পরিণত করতে চান। মোদীর দাবি, মনমোহন জমানায় তিনি বিরোধী দল-শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে শিকার হয়েছেন ‘ষড়যন্ত্রের’। এ বার দিল্লি থেকে দাদাগিরি করতে চান না তিনি। এই প্রসঙ্গেই টেনে আনেন মমতার কথা। মমতার তারিফ ছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গ টেনে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “উন্নয়নের নিরিখে বাংলা যদি গুজরাতের থেকে এগিয়ে যায়, সেই প্রতিযোগিতা তো ভালই। কাল তামিলনাড়ুও যদি বলে, তারা বাংলা ও গুজরাতের থেকে এগিয়ে গিয়েছে, তা হলে রাজ্যগুলির শক্তিই বাড়বে। দেশেরও উন্নয়ন হবে।”
এই পরিস্থিতিতে মমতা কী অবস্থান নেবেন?
লোকসভা ভোটে রাজ্যে বিজেপির উত্থানে তৃণমূল নেত্রী যে উদ্বিগ্ন, তাতে সন্দেহ নেই। উজ্জীবিত বিজেপি রাজ্য নেতৃত্ব এখন আগামী বছরের কলকাতা পুরভোট এবং ২০১৬-র বিধানসভা ভোটের দিকে তাকিয়ে ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছেন। যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন মোদীর সেনাপতি অমিত শাহ। এমতাবস্থায় গত সোমবার বেনজির ভাবে নবান্নে বাম নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে তাঁদের ঘর সামলানোর পরামর্শ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী।
কিন্তু রাজ্য রাজনীতিতে মমতার যেমন বিজেপি-কে ঠেকানোর দায় রয়েছে, তেমনই কেন্দ্র থেকে তাঁর আর্থিক সাহায্যও প্রয়োজন। সেই কারণে গত কালের ভুল শুধরে আজ তাঁর বক্তৃতার গোড়াতেই মোদী সরকারের বিদেশনীতির প্রশংসা করেন সুগতবাবু। বলেন, “শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে সার্ক-ভুক্ত দেশগুলির নেতাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এই দৃঢ় পদক্ষেপের আমরা প্রশংসা করছি। আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের বৃহৎ ভূমিকা নেওয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনও সমস্যা না হয়, সে জন্য প্রতিবেশী দেশগুলির সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রয়োজন।” তবে দেশের পূর্বাঞ্চলকে সামাজিক এবং অন্যান্য পরিকাঠামোগত দিক থেকে পশ্চিমাঞ্চলের সমকক্ষ করে তোলার যে কথা মোদীরা বলছেন, তাতে আপত্তি জানান সুগতবাবু। তাঁর মতে, মানব উন্নয়নের প্রশ্নে, বিশেষত শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যে দেশের উত্তর এবং পশ্চিমের অঞ্চলগুলি দক্ষিণ এবং পূর্বের থেকে অনেকটাই পিছিয়ে। কাজেই এ ক্ষেত্রে পূর্বের থেকেই পশ্চিমের যথেষ্ট শেখার রয়েছে।
সুগতবাবুর বক্তৃতা ছাড়াও টিম তৃণমূলের গঠনমূলক বিরোধিতার একাধিক উদাহরণ আজ দেখা গিয়েছে সংসদে। অধিবেশন শুরুর সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূলের লোকসভার নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় উঠে দাঁড়িয়ে উপস্থিত কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের কাছে রাজ্যের জন্য সহযোগিতা প্রার্থনা করেন। বিষয়টি আগে থেকে নোটিস দেওয়া ছিল না বলে স্পিকার প্রথমে সুদীপবাবুকে নিরস্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু যখন দেখা যায় খোদ রাজনাথই জবাব দিতে উৎসাহী, তখন আলোচনা এগোয়। সুদীপবাবু জানান, জঙ্গলমহল তথা ঝাড়খণ্ড-মেদিনীপুরের সীমানা এবং দার্জিলিং-নেপাল সীমান্ত থেকে ১৩ কোম্পানি আধাসেনা তুলে নেওয়ার কথা ভাবছে কেন্দ্র। এর ফলে অনভিপ্রেত কিছু ঘটলে দায় কার? রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করে কেন্দ্রের এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত বলে জানান সুদীপবাবু। রাজনাথ বলেন, ‘‘আমি একমত। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সরকার কখনই একতরফা সিদ্ধান্ত নেবে না।” দলনেত্রীকে ফোনে বিষয়টি জানিয়ে দেন সুদীপবাবু। তৃণমূল সূত্রের খবর, এই ঘটনায় কেন্দ্রের ভূমিকায় খুশি মমতা। গত কাল আগাগোড়া জঙ্গি মনোভাব দেখানোর পর আজ লোকসভার ভিতরে মুখ প্রায় খোলেনইনি কল্যাণবাবু। তবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলির সঙ্গে দেখা করে রাজ্যের আর্থিক সঙ্কট মেটানোর ব্যাপারে দরবার করেন তিনি। কল্যাণের দাবি, জেটলি তাঁকে বিষয়টি খতিয়ে দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy