Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
মোদী-সঙ্গীর অ্যাডভেঞ্চার-স্কুলের ছাত্র এক বাঙালি চিকিৎসক

ফস্কে গেল দাঁড়, অতিকায় ওয়াশিং মেশিনে আমি

জলের তলায় খাবি খাচ্ছি, ঘুটঘুটে অন্ধকার, নাকে মুখে ঢুকছে জল। তার ওপর কুমিরের ভয়। কোনও মতে ডুব সাঁতার কেটে জলের ওপরে মাথা ভাসাতে পারলাম। দেখলাম, বাকিদেরও একই দশা।

ভয়াল: জাম্বেজি নদীতে উল্টে গেল র‌্যাফ্ট। নিজস্ব চিত্র

ভয়াল: জাম্বেজি নদীতে উল্টে গেল র‌্যাফ্ট। নিজস্ব চিত্র

রাজর্ষি পাল
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৯ ০২:২৬
Share: Save:

জাম্বেজি নদীর দিকে যাব। ল্যান্ডরোভারে প্রথমে জঙ্গল পেরিয়ে উঠলাম লাল মাটির রাস্তায়। এ যেন পুরুলিয়ার ঊষর প্রান্তরের মধ্যে দিয়ে চলেছি। মাঝে মধ্যে জুলু আদিবাসীদের গ্রাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক চলার পরে পাহাড়ের ওপরে এসে থামলাম...। সামনেই গভীর জাম্বেজি উপত্যকা। মাথায় হেলমেট আর গায়ে লাইফ জ্যাকেট। অত্যন্ত খাড়াই বিপজ্জনক ঢাল বেয়ে, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নীচে নামলাম। সামনে প্রবল খরস্রোতা জাম্বেজি। আমাদের প্রশিক্ষক ব্রেন্ট র‌্যাফটিং শুরু করার আগে জানিয়ে দিলেন, কী কী সতর্কতা নিতে হবে, র‌্যাফট উলটে গেলে কী করে বাঁচব।

ভাগাভাগি করে বসলাম দুটো আলাদা র‌্যাফটে। বিশাল বিশাল ঢেউ আর মাঝে মধ্যে ছোট ছোট জলপ্রপাত। ব্রেন্টের নির্দেশ মেনেই দাঁড় বাইছিলাম। কিন্তু বিশাল বিশাল ঢেউ র‌্যাফটকে নিয়ে যেন ছেলেখেলা করতে লাগল। আর তেমনই এক ঢেউয়ে উলটে গেল আমাদের র‌্যাফট। জলের তলায় খাবি খাচ্ছি, ঘুটঘুটে অন্ধকার, নাকে মুখে ঢুকছে জল। তার ওপর কুমিরের ভয়। কোনও মতে ডুব সাঁতার কেটে জলের ওপরে মাথা ভাসাতে পারলাম। দেখলাম, বাকিদেরও একই দশা।

অদ্ভুত এক কায়দায় উলটে পরা র‌্যাফটকে সোজা করল ব্রেন্ট। কোনও মতে উঠলাম র‌্যাফটে। এর পর ‘রক ক্লাইম্বিং’। ওপরে উঠে জলে ঝাঁপিয়ে পড়া। একেই বলে ‘কনফিডেন্স জাম্প’। এর পর আবার পাড়ি। সূর্য তখন পশ্চিমে। র‌্যাফটিং করে চলে গিয়েছি প্রায় ২০ কিলোমিটার। সেই সময়ে বিপদ। জলের তলায় লুকনো ধারাল পাথরে ধাক্কা খেয়ে আমাদের র‌্যাফটে হয়ে গেল বড় ফুটো। হাওয়া বেরিয়ে গিয়ে একটা দিক কাত! দ্রুত প্যাডল করে তীরে। অন্য র‌্যাফটে কিছু মালপত্র সরিয়ে, দুটো র‌্যাফটে বসা হল অনেক হিসেব কষে। ধীরে ধীরে প্রায় পাড় ঘেঁষে দাঁড় বেয়ে এগিয়ে চললাম। প্রায় ঘণ্টা খানেক চলার পর তীরে ভিড়ল র‌্যাফট। পাহাড় বেয়ে উঠতে হল খাড়াই প্রায় এক কিলোমিটার। তারপর সে দিনের মতো ক্যাম্প ফেলা।

পর দিন আবার জঙ্গলের পথে। সামনে ডিন। হাতে রাইফেল। এই এলাকায় প্রচুর বুনো হাতির আবাস। একটা জলাশয়ের পাশে আবার একটা কচ্ছপ দেখলাম, গায়ে চিতার মতো ছোপ ছোপ। নাম— লেপার্ড টরটয়েস। দুপুরের পর শেখানো হল জঙ্গলে আত্মগোপন করে থাকার কৌশল। গায়ে মাথায় কাদা মেখে ভূত হলাম, তার পর শিকারের ছুরি দিয়ে লতাপাতা কেটে এখানে ওখানে গুঁজে নিলাম। কিম্ভূত হয়ে এক-একজন এক-একটা জায়গায় লুকোলাম বটে, কিন্তু সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষণ নেওয়া ডিন, পল বা নাইজেলদের ফাঁকি দেওয়া যে কী কঠিন! ধরা পড়লাম সহজেই।

আসল পরীক্ষা অবশ্য তখনও বাকি। পরের দু’দিন আমাদের ছেড়ে দেওয়া হবে জাম্বেজি পাড়ের গভীর জঙ্গলে, খাবারদাবার থেকে আশ্রয়স্থল— নিজেদেরই জোগাড় করতে হবে দলবদ্ধ ভাবে। শৃঙ্খলা, দলগতভাবে কাজ করা এবং কষ্টসহিষ্ণুতার চরম পরীক্ষা। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ইদানীং ম্যানেজমেন্ট পাঠে এ ধরনের ট্রেনিংয়ে জোর দেওয়া হচ্ছে।

এ বার জাম্বেজির যে পাড়ে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল, সেখানে জল আপাত শান্ত। তবে আশপাশে তাকাতেই বুঝলাম, ব্যাপারটা সুবিধার নয়। দু’একটা কুমিরও চোখে পড়ল। লাইফ জ্যাকেট এবং মাথায় হেলমেট পরে শুরু হল দাঁড় বাওয়া। শান্ত জল পেরিয়ে জাম্বেজির দুরন্ত ‘র‌্যাপিডস’। সকলেই গম্ভীর। ছোট ছোট কয়েকটা ‘র‌্যাপিডস’ পেরিয়েই আকাশপ্রমাণ ঢেউ। প্রচণ্ড স্রোতের তোড়ে র‌্যাফট উথাল-পাথাল। বেশ কয়েক বার র‌্যাফট উল্টোতে উল্টোতে বেঁচে গেলাম।

সে আর কতক্ষণ? ভয়ঙ্কর ‘র‌্যাপিডস’ পেরোতে গিয়ে স্রোতের ধাক্কায় র‌্যাফট থেকে ছিটকে পড়লাম চার জনই। সে এক দূরন্ত ঘূর্ণি। সাঁতারের সমস্ত প্রচেষ্টাই বিফল। ঘূর্ণির টানে এক বার তলিয়ে যাই জলের তলায়, আবার ভেসে উঠি। মনে মনে ভাবছি, এই শেষ। দ্বিতীয় র‌্যাফট এল আমাদের উদ্ধার করতে— বাকি তিন জনকে ওরা উদ্ধার করতে পারল। আমার দিকেও ওরা বাড়িয়ে দিয়েছিল একটা দাঁড়। এক চুলের জন্য সেটা আমার হাত থেকে ফস্কে যায়। আর তখনই ঘূর্ণির স্রোত আমাকে প্রবল বেগে ভাসিয়ে নিয়ে গেল এক দিকে আর র‌্যাফটটাকে ঠেলে দিল অন্য দিকে। আমি তখন এক মহাকায় ওয়াশিং মেশিনের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছি। (চলবে)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Television Wildlife Zambezi River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE