কাঁদছে কোয়াসিমোদো। ইনস্টাগ্রাম
৮৫৬ বছরে সে সয়েছে অনেক কিছু। কখনও যুদ্ধ, কখনও প্রতিকূল আবহাওয়া, কখনও দূষণ। কখনও বদলে যাওয়া ‘ফ্যাশনের’ শিকার পর্যন্ত হতে হয়েছে তাকে। ধাতব মিনারের চূড়াটিকেও এর আগে (১৭৮৬ সালে) খুইয়ে সংস্কারের পরে ফিরে পেয়েছে সে। ফরাসি বিপ্লব-নেপোলিয়ন-দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-হিটলার— নানা অভিঘাত পেরিয়েও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিল প্যারিসের নোত্র দাম ক্যাথিড্রাল।
ইতিহাসবিদদের মতে, চতুর্দশ লুইয়ের শাসনের সময়ে (১৬৪৩-১৭১৫) যে সংস্কার সহ্য করতে হয়েছে নোত্র দামকে, তা ছিল কিছুটা দুর্ভাগ্যজনক। নকশা কাটা কাচের জানলা সরে এসেছিল সাফসুতরো সাধারণ জানলা, ঘোড়ায় টানা গাড়ি ঢোকার জন্য বাদ গিয়েছিল আস্ত একটা স্তম্ভ। ফরাসি বিপ্লবের সময়টা ছিল এর চেয়েও খারাপ। বিপ্লবীদের হাতে যাওয়ার পরে নষ্ট হয়েছিল অসংখ্য মূর্তি। বিশপের প্যালেস মিশে গিয়েছিল আগুনে, আর কোনও দিন সেটি তৈরিই হয়নি। ১৮০২ সালে ক্যাথলিক গির্জার হাতে ফিরে গেলেও নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের ক্ষয় চলছিল ভিতরে ভিতরে।
এর পরে ১৮৩১। প্রকাশিত হল ফরাসি কবি ও ঔপন্যাসিক ভিক্তোর উগোর ‘দ্য হাঞ্চব্যাক অব নোত্র দাম’। পৃথিবী চিনল ক্যাথিড্রালের ঘণ্টাবাদক কুঁজো কোয়াসিমোদো আর সুন্দরী এসমেরালদাকে। চেহারার জন্য কোয়াসিমোদোকে ভয় পেত প্যারিসের মানুষ। তাঁদের প্রেমকাহিনি ছাপিয়ে উপন্যাসের ‘নায়ক’ যেন হয়ে উঠেছিল নোত্র দাম-ই। উগো দু’টি অধ্যায় খরচ করেছিলেন শুধু নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে। আর তাঁর উপন্যাসকে এনে ফেলেছিলেন ১৪০০ সালে, যখন নোত্র দাম তার খ্যাতির শীর্ষে।
উগো লিখেছিলেন, ‘‘প্রাচীন এই সৌধের উপরে সময় এবং মানুষ যে অগুনতি অবনমন এবং পরিবর্তন ঘটিয়েছে, তাতে দীর্ঘশ্বাস না-ফেলে থাকা যায় না...।’’
এত দিনের পুরনো এই উপন্যাসের উপরে নির্ভর করে এক ডজনেরও বেশি সিনেমা তৈরি হয়ে গিয়েছে। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিল্পকলার ইতিহাস সংক্রান্ত গবেষক এবং প্রফেসর এমিরেটাস স্টিফেন মারি বলছেন, ‘‘মধ্যযুগ হলে মানুষ বিশ্বাস করে নিত, ঈশ্বরই এই আগুন পাঠিয়েছেন। কারণ ঈশ্বর এই মুহূর্তে আরও ভাল ক্যাথিড্রাল চান! কিন্তু বাস্তব হল, এখন এই সময়ে দাঁড়িয়ে আবার ভাল ক্যাথিড্রাল তৈরির কথা ভাবাও দুরাশা। তার মূলধনই বা কোথায়?’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের ভয়াল অগ্নিকাণ্ড ছাপ ফেলেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। এই ক্যাথিড্রালের ‘বিখ্যাত’ বাসিন্দা কোয়াসিমোদোর আদল যে ভাবে দেখিয়েছিল ডিজনি, সেই ছবি ভাইরাল হয়েছে ইনস্টাগ্রামে। দেখা যাচ্ছে, কোয়াসিমোদো দু’হাতে আগলে ধরেছে লেলিহান শিখার গ্রাসে সাড়ে আটশোরও বেশি পুরনো ক্যাথিড্রালটিকে। তার চোখে জল। ১৯৯৬-এ ছবিটি তৈরি করেছিল ডিজ়নি। ইনস্টাগ্রাম পোস্টে লেখা, ‘‘আজ ও কাঁদছে। বিশ্ব জুড়ে
বহু মানুষের শৈশব-স্মৃতিতে ধরা আছে ওর ছবি।’’
নোত্র দামে আগুন দেখে অনেকের আবার মনে পড়েছে ২০০৪ সালের রিচার্ড লিঙ্কলেটারের ছবি ‘বিফোর সানসেট’-এর কথা। ‘রোমান্টিক-ড্রামা’ ধারার এই ছবিটির একটি দৃশ্যে নোত্র দাম ক্যাথিড্রালের দিকে তাকিয়ে প্রেমিক জেসির চরিত্রটিকে প্রেমিকা সেলিন বলছে, ‘‘আমার মনে হয়, নোত্র দাম এক দিন শেষ হয়ে যাবে।’’ সেই উক্তির উল্লেখ ছড়িয়ে পড়েছে টুইটারে। ১৫ বছর আগেকার ছবির এই উক্তি এ ভাবে ‘আতঙ্ক’ হয়ে ফিরে আসবে, ভাবেননি কেউ। এক জন লিখেছেন, ‘‘এক দিন শেষ হবে নোত্র দাম! সেই দিনটা প্যারিসের কাছে বড় দ্রুত চলে এল যে!’’ আর এক জন লিখেছেন, ‘‘কারও মনে কষ্ট দিতে চাই না... কিন্তু নোত্র দামের নাম শুনলে বিফোর সানসেট-এর ওই দৃশ্যের কথা মনে পড়ে যায়।’’ টুইটে এসেছে এমন বার্তাও, ‘‘বিফোর সানসেট-এর কথা মনে করানোয় টুইটারকে ধন্যবাদ। নোত্র দাম যখন আগুনের গ্রাসে আর তার সৌন্দর্য একটু একটু করে ঝরে পড়ছে— সবাই সে দৃশ্যও মনে রাখবে। কিন্তু এখনও সে তার জায়গায় আছে, সেটা ভেবে খুশি হোন, যে দিন আর থাকবে না, তখন স্মরণ করবেন।’’
‘‘বিরাট পর্বতের মতো মহান প্রাসাদোপম সব কিছুই শতাব্দীর সৃষ্টি...। সময় তার স্থপতি আর জাতি তার স্রষ্টা,’’ লিখেছিলেন ভিক্তোর উগো। নোত্র দাম তাঁর কাছে মানবতার সৃষ্টি, তার একক সৃষ্টিকর্তা হয় না। কিন্তু তিনি যখন উপন্যাস লিখছেন, সেই সময়েই অবহেলায় নোত্র দামের খুব সঙ্গিন দশা। উগো উপন্যাসের ভূমিকার শেষে লিখলেন, ‘‘এই গির্জা, হয়তো বা আপনা হতেই পৃথিবীর বুক থেকে দ্রুত হারিয়ে যাবে।’’ বিশেষজ্ঞরা স্তব্ধ হয়ে মনে করছেন, অন্ধকারের এই ভবিষ্যদ্বাণীকেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy