Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

এই বুঝি ওরা ফিরে এল, তাড়া করছে ভয়

কে বলবে মাত্র কুড়ি বছর বয়স! এই বয়সেই কেমন যেন বুড়িয়ে গিয়েছে চেহারাটা। গুটিয়ে গিয়েছে মুখের চামড়া। টুকটুকে ফর্সা মুখটা জায়গায় জায়গায় ঝলসে গিয়েছে। ঘন নীল রঙের ওড়নায় মুখ আড়াল করে রেখেছেন আফগান তরুণী। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল দু’টি চোখ।

সংবাদ সংস্থা
কাবুল শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৫ ০২:৩৩
Share: Save:

কে বলবে মাত্র কুড়ি বছর বয়স! এই বয়সেই কেমন যেন বুড়িয়ে গিয়েছে চেহারাটা। গুটিয়ে গিয়েছে মুখের চামড়া। টুকটুকে ফর্সা মুখটা জায়গায় জায়গায় ঝলসে গিয়েছে। ঘন নীল রঙের ওড়নায় মুখ আড়াল করে রেখেছেন আফগান তরুণী। তার ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে উজ্জ্বল দু’টি চোখ।

মুমতাজ। চার বছর আগে তাঁকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল এক জঙ্গি। এক জন সন্ত্রাসবাদীকে বিয়ে করতে রাজি হননি তরুণী। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন যুবকটিকে। মেয়ে হয়ে এত জেদ! রক্ত গরম হয়ে গিয়েছিল ছেলের। ছয় বন্ধুকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকে অ্যাসিড ছুড়ে মেরেছিল তরুণীর মুখে। হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে প্রত্যাখ্যানের জবাবটা, ‘দেখি এ বার কে তোকে বিয়ে করে...!’

আর তার পর থেকেই কঠিন হয়ে উঠেছে জীবন। বহু বার অস্ত্রোপচার হয়েছে। প্লাস্টিক সার্জারির যন্ত্রণা তো রয়েইছে, সেই সঙ্গে তাড়া করে বেরাচ্ছে ভয়। মুমতাজের দেওয়া সাক্ষ্যে অপরাধীদের ১২ বছর কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত। আফগানিস্তানের মতো দেশে যা এক রকম বিরল রায়। এ দেশে স্রেফ হিজাব না পরার জন্যও অ্যাসিড আক্রান্ত হন মেয়েরা। কিন্তু বিচার হয় না। মুমতাজ বিচার পেলেও পুলিশি হেফাজত থেকে পালিয়ে যায় অপরাধীরা। তার পর থেকেই আতঙ্ক— এই বুঝি ওরা ফিরে এল। এ বার খুনের হুমকি দিয়েছে অপরাধীরা। শুধু তরুণী নন, জানিয়ে দিয়েছে, তাঁর গোটা পরিবারকেই নিকেশ করবে জঙ্গিরা।

আর তাই ঘরছাড়া সেই মেয়ে। পরিবারকে নিয়ে আত্মগোপন করে রয়েছেন কুন্দুজ প্রদেশের কোনও এক ঠিকানায়। বন্ধু বলতে পাশে রয়েছে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। চিকিৎসা থেকে মামলা-মোকদ্দমার সব খরচ বহন করেছে তারাই।

কী ঘটেছিল চার বছর আগে?

কিশোরী মুমতাজের প্রতি বরাবরই কুনজর ছিল পড়শি যুবকটির। নাসিরের ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোই বন্ধ করে দেয় গমচাষির মেয়েটি। এ দিকে, যে ছেলের জঙ্গি যোগসাজশ রয়েছে, পাড়ার লোকও তাকে এড়িয়ে যেতেন। মুমতাজদের বাড়ির বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকত সে। তা নিয়ে মুমতাজের বাবার উত্তপ্ত বাক্যবিনিময়ও হয়েছিল এক দিন। কিন্তু সে সব পাত্তা দিত না নাসির।

শেষে মেয়ের বিয়ে ঠিক করলেন গৃহকর্তা। ‘অপমানিত’ নাসির ছয় সঙ্গীকে নিয়ে এক দিন রাতে ঢুকে পড়ল মুমতাজদের বাড়িতে। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন তরুণী, ‘‘আমার চুলের মুঠিটা শক্ত করে ধরে অ্যাসিড ছুড়ে দিল মুখে। আমি তখন প্রাণপণ চিৎকার করছি। আমার ছটফটানিতে অ্যাসিড গিয়ে পড়েছিল মা-বোনের গায়েও।’’

দমে যাননি তরুণী। বিচার চেয়ে আদালতের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁর সাক্ষ্যে সাজাও হয়েছিল অপরাধীদের। আর তার পর থেকেই হুমকি। ‘‘জেল থেকে বেরিয়েই তোর গোটা পরিবারকে মারব। মাথা কেটে খুন করব তোকে।’’ বা, ‘‘তোদের উপর নজর রাখছি।’’ এমন নানা হুমকি আসতে থাকে মুমতাজদের বাড়িতে। এক বার এক দল সশস্ত্র লোক দরজা ভেঙে তাঁদের বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করেছিল। সেই থেকে শুরু হয়েছিল পালা করে রাত জাগা।

কিন্তু এ ভাবেও বেশি দিন কাটেনি। ঘরবাড়ি-চাষবাস ছেড়ে অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন মুমতাজের বাবা সুলতান। সেই থেকে পালিয়ে বেড়ানো...।

এমন বেঁচে মরে থাকা জীবনেও মুমতাজের হাত ছাড়েননি এক জন। চার বছর আগে যে ছেলের সঙ্গে বিয়ে ঠিক করেছিলেন বাবা-মা, এ বছর গোড়ার দিকে সেই ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হয়েছে তরুণীর। বিফলে গিয়েছে নাসিরের ভবিষ্যদ্বাণী। সে কথা জানালেন মুমতাজ নিজেই। তাঁর ভীত-সন্ত্রস্ত, দগ্ধ মুখটাতে খেলে গেল মিঠে লাজুক হাসি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE