চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং।
পুরো চেয়ার জুড়ে বসবে না। পেট ঢুকিয়ে, কাঁধ সোজা করে, পা জোড়া করে বসো।
কোনও সৌন্দর্য প্রতিযোগিতার তালিম নয়। সহবতের এই পাঠ শেখানো হচ্ছে চিনের জেনজিয়াং কলেজে। শুধু ছাত্রীদের জন্যই এই বিশেষ ক্লাসের ব্যবস্থা করেছেন কলেজ কর্তৃপক্ষ।
হ্যাঁ, চিনে। যে চিনকে ‘নতুন ভোরের’ স্বপ্ন দেখাচ্ছেন প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং। আধুনিক চিনের নবীন প্রজন্মের পুরুষদের জন্য ‘নবীনাদের’ এ ভাবেই আদবকায়দা শেখানো শুরু হয়েছে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে। উদ্দেশ্য, ভদ্রসভ্য মেয়েদের ‘তৈরি করা’। হাঁটা-চলা, জামাকাপড় পরা, মেক আপ করা, এমনকি চা ঢালার পাঠও দেওয়া হচ্ছে। শেখানো হচ্ছে, স্বামীর কাছে বকুনি খেয়েও কী ভাবে চুপ করে থাকতে হয়। আর এই সহবত শিক্ষার দায়িত্ব নিয়েছে চিনের প্রধান নারী সংগঠন ‘অল চায়না উইমেনস ফেডারেশন’ বা এসিডব্লিউএফ।
কারা এই এসিডব্লিউএফ? ১৯৪৯ সালের ২৪ মার্চ প্রতিষ্ঠিত হয় সংগঠনটি। নারী অধিকার ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে দেশজুড়ে কাজ করে তারা। ১৯৫৩ সালের মধ্যেই সংগঠনের সদস্যসংখ্যা চল্লিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৯৫৭ সালে সরকারি ভাবে কমিউনিস্ট পার্টি অব চায়না (সিপিসি)-তে অন্তর্ভুক্ত করা হয় এসিডব্লিউএফ-কে। ফলে মেয়েদের এই সহবত শিক্ষার পিছনে দেশের সর্বশক্তিমান কমিউনিস্ট দলেরই হাত রয়েছে বলে মত চিনের মানবাধিকার কর্মীদের।
আরও পড়ুন: ঠকিয়েছে সন্তানেরা, নালিশ চন্দ্রজয়ীর
এমন নয় যে, সিপিসি নারী শিক্ষার বিপক্ষে। কিন্তু দেশের আর্থিক বিকাশের গতি কমে যাওয়ায় চাকরির বাজারে মন্দা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি, সাড়ে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং বেআইনি লিঙ্গভিত্তিক গর্ভপাতের ফলে দেশে মেয়েদের সংখ্যা আনুপাতিক হারে অনেক কমে গিয়েছে। বর্তমানে, প্রতি ১০০ জন মেয়েতে ছেলের সংখ্যা ১১১। একটি চিনা সমীক্ষা বলছে, ২০২০ সালে দেশে বিবাহযোগ্যা মেয়ের তুলনায় দু’কোটি ৪০ লক্ষ বেশি বিবাহযোগ্য পুরুষ থাকবেন।
সমাজতাত্ত্বিকদের মতে, এই ধরনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চাপের ফলেই মেয়েদের ‘নতুন করে’ গড়ে তোলার তাগিদ অনুভব করছে চিন। এই ধরনের সহবত শিক্ষা কি নারী স্বাধীনতার বিপরীতমুখী নয়? জেনজিয়াং কলেজের ‘চা সহবত’ পাঠ্যক্রমের দায়িত্বে থাকা অধ্যাপিকা শেং চিং-কে এই প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমি এক জন শিক্ষিকা মাত্র, নারীবাদী আন্দোলনকারী নই!’’ তাঁর কথায়, ‘‘পরিবারে মেয়েদের গুরুত্ব এখন অনেক বেড়ে গিয়েছে। আর এ তো কোনও নতুন কথা নয়। মেয়েরা পরিবারের দেখাশোনা করবে এবং ছেলেরা রুটি-রুজির জন্য বাইরের জগতে পা দেবে, এই কথা তো সেই কনফুশিয়াসের আমল থেকেই চিনা সংস্কৃতিতেই বলা হয়েছে।’’
‘‘কথাটা হয়তো নতুন নয়। তবে মেয়েদের এ ভাবে ‘ঘরোয়া’ বানানোর প্রবণতাটা শি-জমানাতেই প্রথম’’, বলছেন দেশের অন্যতম বিতর্কিত নারীবাদী লেখিকা লেতা হং ফিঞ্চার। মজার কথা, রাষ্ট্রপুঞ্জের মঞ্চে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্ট চিনফিং-ই বলেছিলেন, ‘‘মেয়েদের সমানাধিকারের থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আর কিছু হতে পারে না।’’ আর এক নারীবাদী লু পিং-এর কথায়, ‘‘মুখে এ কথা বললেও প্রেসিডেন্ট শি এমন এক ‘আদর্শ সংসার’-এর কথা বলেন, যেখানে ছেলেরা রোজগার করতে বেরোবে আর মেয়েরা বাড়িতে বসে বাচ্চা-বুড়োদের সামলাবে। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে মেয়েদের পায়ের বেড়ি খুলেছিল। ঐতিহ্য বজায় রাখার নামে ফাঁকফোঁকর গলে সেই বেড়িটাই আবার মেয়েদের পায়ে ফিরে আসছে।’’ লু পিং আরও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, দেশের বিভিন্ন বড় মাপের সংস্থায় মাইনের ক্ষেত্রে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য দূর করতেও সরকারি ভাবে কোনও পদক্ষেপ করা হয় না। আর সরকার বা কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষ স্তরেও মেয়েদের উপস্থিতি টের পাওয়া যায় না বললেই চলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy