Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সব হিসেবে জল ঢেলে ফিরছেন ক্যামেরনই

সবচেয়ে মধুর জয়! ম্যাথু পার্কার স্ট্রিটে টোরি পার্টির সদর দফতরটা তখন উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের দখলে। সেখানেই দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে ছোট্ট অথচ অর্থবহ বাক্যটা ছুড়ে দিলেন ডেভিড ক্যামেরন। ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদে দ্বিতীয় বারের জন্য বসতে চলেছেন তিনিই। আরও টুকটাক দু’একটা কথা। উল্লাস আর হাততালির শব্দে তার অনেকখানিই চাপা পড়ে গেল! তা যাক! কথাগুলো শেষ করেই ক্যামেরনের কনভয় দৌড় দিল বাকিংহাম প্রাসাদের দিকে। সেখানে রানির সঙ্গে দেখা করে জয়ের খবর জানাবেন ক্যামেরন। কিন্তু ‘মধুর জয়’ কেন?

জয়ের পর ডেভিড ক্যামেরন। লন্ডনে দলের সদর দফতরে। ছবি: এএফপি।

জয়ের পর ডেভিড ক্যামেরন। লন্ডনে দলের সদর দফতরে। ছবি: এএফপি।

শ্রাবণী বসু
লন্ডন শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

সবচেয়ে মধুর জয়!

ম্যাথু পার্কার স্ট্রিটে টোরি পার্টির সদর দফতরটা তখন উচ্ছ্বসিত সমর্থকদের দখলে। সেখানেই দলের কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে ছোট্ট অথচ অর্থবহ বাক্যটা ছুড়ে দিলেন ডেভিড ক্যামেরন। ততক্ষণে নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর পদে দ্বিতীয় বারের জন্য বসতে চলেছেন তিনিই।

আরও টুকটাক দু’একটা কথা। উল্লাস আর হাততালির শব্দে তার অনেকখানিই চাপা পড়ে গেল! তা যাক! কথাগুলো শেষ করেই ক্যামেরনের কনভয় দৌড় দিল বাকিংহাম প্রাসাদের দিকে। সেখানে রানির সঙ্গে দেখা করে জয়ের খবর জানাবেন ক্যামেরন।

কিন্তু ‘মধুর জয়’ কেন?

কারণটা ততক্ষণে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে আম-ব্রিটিশের কাছেই। গত বারের মতো কোনও সহযোগীর হাত ধরে নয়, একক ভাবেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে হাউস অব কমন্সে পা রাখতে চলেছে ক্যামেরনের নেতৃত্বাধীন কনজারভেটিভ টোরি দল। মোট ৬৫০ আসনের নিম্ন কক্ষে তারা একক ভাবে ৩৩১টা আসনে জিতেছে। ‘ম্যাজিক ফিগার’ ৩২৬ ছাড়াতেই ক্যামেরন নিশ্চিত হয়ে যান, ফের ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হতে চলেছেন তিনিই। মার্গারেট থ্যাচারের পরে ক্যামেরনই একমাত্র টোরি নেতা, যিনি হাউস অব কমন্সের নেতা হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হলেন।

দেশের ৫৬তম সাধারণ নির্বাচনে এ রকম একটা জয়ের রাস্তা অবশ্য সহজ ছিল না মোটেই। ব্রিটেনের প্রায় প্রতিটি জনমত সমীক্ষাই একবাক্যে জানিয়েছিল, প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির সঙ্গে লড়াই হবে হাড্ডাহাড্ডি। ক্যামেরনের দলের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করা এক রকম অসম্ভব বলেই জানিয়েছিলেন বেশির ভাগ ভোট-বিশেষজ্ঞ। এমনকী ত্রিশঙ্কু পার্লামেন্টের কথাও বলেছিলেন অনেকে। অনেকেরই বক্তব্য ছিল, লেবার পার্টি এ বার প্রতি পদে থাবা বসাবে কনজারভেটিভদের সাফল্যে।

যদিও কনজারভেটিভদের বক্তব্য ছিল, তাদের জমানায় জি-৭ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে ব্রিটেনের বৃদ্ধির হার ঈর্ষণীয়। মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিলেন ক্যামেরন। খারাপ ছিল না নতুন কর্মসংস্থানের হারও। কিন্তু কাঁটাও ছিল একটা। কমে যাচ্ছিল কর্মীদের গড় বেতন। এ নিয়ে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছিল বড় অংশের মধ্যে। তাই ক্যামেরনের জয় নিয়ে অনেকেই নিশ্চিত হতে পারছিলেন না।

বৃহস্পতিবার ভোটদান পর্ব শে‌ষ হতে হতে বেজে যায় রাত দশটা। তখনও চলছে হিসেব নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ। বিশেষজ্ঞরা তখনও বলে চলেছেন, সম্ভবত সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে থাকতে চলেছে ক্যামেরনের দল। কিন্তু ছবিটা বদলাতে থাকে মধ্যরাতের পর থেকে। একের পর এক আসনের ফল ঘোষণা হচ্ছে আর চড়চড় করে বাড়ছে কনজারভেটিভদের আসন সংখ্যা। বোঝা গেল, ভোটারদের মন বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন বিলেতের বিশেষজ্ঞরা! দিনের শেষে দেখা যায়, লেবার পার্টিকে বহু পিছনে ফেলে দিয়েছে ক্যামেরনের দল। একক ভাবেই ক্ষমতায় ফিরতে চলেছে তারা। বহু আশা জাগিয়েও লেবার পার্টি পেয়েছে ২৩২টি আসন, যা আগের বারের থেকে বেশ কম। আর ক্যামেরনের গত বারের জোট সঙ্গী লিবারাল ডেমোক্র্যাটরা? গত বার তারা ৫৭টি আসন পেলেও এ বারে তাদের ঝুলিতে মাত্র আটটি!

তখনও সম্পূর্ণ ফল প্রকাশিত হয়নি। তার মধ্যেই দুপুরে এক বার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন ক্যামেরন। সদ্য বাকিংহাম থেকে রানির সঙ্গে দেখা করে দশ ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ফেরার পথে চোখ পড়ল অপেক্ষারত এক ঝাঁক সাংবাদিকের দিকে। দাঁড়িয়ে গেলেন। শুরুতেই টেনে আনলেন ব্রিটেনের আর্থিক মন্দার প্রসঙ্গ। তার পর বললেন, ‘‘পাঁচ বছর পেরিয়ে ব্রিটেন এখন অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু আসল সুযোগ তো এ বার আসবে।’’ আগামী পাঁচ বছরের কর্মসূচিও সংবাদমাধ্যমের কাছে বলে রেখেছেন প্রধানমন্ত্রী। ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিয়ে গণভোট। আর অখণ্ড ব্রিটেনের স্বপ্ন। আপাতত এই দু’টোই মূল অস্ত্র ক্যামেরনের। তিনি বলেছেন, ‘‘আমার দল এমন একটা সরকার চালাবে, যা এক রাষ্ট্রে বিশ্বাসী।’’ অর্থাৎ স্কটল্যান্ডের আলাদা হওয়ার দাবিকে আগেও সমর্থন করেননি। এখনও যে করছেন না, তা আরও এক বার স্পষ্ট করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

ক্যামেরন যখন দুপুরে সাংবাদিকদের মুখোমুখি, তত ক্ষণে তিন তিনটে পদত্যাগ দেখে ফেলেছে ব্রিটেন। দলের শোচনীয় হারের দায় স্বীকার করে নেতৃত্ব থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন লেবার পার্টির নেতা এড মিলিব্যান্ড। বলেছেন, ‘‘হারের সব দায় আমার। পরবর্তী কর্মসূচির জন্য একটা বিতর্ক দরকার।’’ একই ভাবে সরে গিয়েছেন প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী তথা লিবারাল ডেমোক্র্যাট নেতা নিক ক্লেগ। বলেছেন, ‘‘কালকের রাতটা আসলে শাস্তির রাত!’’ দলের নেতা হিসেবে সরে দাঁড়িয়েছেন ইউকেআইপি-র নাইজেল ফারাজও। উগ্র জাতীয়তাবাদী হিসেবে পরিচিত এই দল এ বারের ভোটে দারুণ ফল করবে বলে জানিয়েছিল জনমত সমীক্ষাগুলি। সেটা ঘটে ওঠেনি।

ক্যামেরন ফের ক্ষমতায় আসায় আন্তর্জাতিক বাজারে চড়চড়িয়ে বেড়েছে পাউন্ডের দাম। বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে স্রোতের মতো অভিনন্দন বার্তা এসেছে ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। বারাক ওবামা থেকে শুরু করে নরেন্দ্র মোদী— কে নয়! মোদী তো আবার ফেসবুকে তাঁরই নির্বাচনী স্লোগানের প্রসঙ্গও টেনেছেন। লিখেছেন, ‘‘আপনিই ঠিক ছিলেন মিস্টার ক্যামেরন। ফির এক বার, ক্যামেরন সরকার! অনেক শুভেচ্ছা।’’ জয়ের শুভেচ্ছা জানিয়ে ক্যামেরনকে চিঠি পাঠিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

তবে এই বিপুল জয়ের মধ্যেও ক্যামেরনের গলার কাঁটা হয়ে রইল এসএনপি। স্কটল্যান্ডের জাতীয়তাবাদী পার্টি। পৃথক স্কটল্যান্ডের দাবি নিয়ে কয়েক মাস আগের গণভোটে হারে পরে এসএনপি-র দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল নিকোলা স্টুরজিওনকে। স্কটল্যান্ডের ৫৯টির মধ্যে ৫৬টি আসনই পকেটে পোরার পরে নিকোলাকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত স্কটল্যান্ড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তাদের এই বিপুল সাফল্যের সিংহ ভাগটাই এসেছে লেবার পার্টির ভোট কেটে।

ব্রিটেনের ভোটে উল্লেখযোগ্য জয় পেয়েছেন বেশ কয়েক জন এশীয়। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বোনঝি টিউলিপ সিদ্দিক। টিউলিপ অবশ্য লেবার পার্টির প্রার্থী ছিলেন। আর এক বাংলাদেশি, রূপা হকও জিতেছেন লেবারদের হয়ে। দ্বিতীয় বার জয় পেয়েছেন রুশনারা আলি। তিনিও ছিলেন লেবার পার্টির পক্ষেই। রয়েছেন ইনফোসিসের এমিরেটাস চেয়ারম্যান এন নারায়ণমূর্তির জামাই ঋষি সুনাক। কনজারভেটিভ পার্টির এই নেতার জয়ে উচ্ছ্বসিত এখানকার ভারতীয় বংশোদ্ভূতরা।

তবে আজ নায়ক এক জনই। যাবতীয় বুথ ফেরত আর জনমত সমীক্ষা ভুল প্রমাণ করেছেন যিনি। ডেভিড ক্যামেরন। তাঁর দলের হয়ে বাজি লড়ে এখন রীতিমতো কোটিপতি লন্ডনের এক পেনশনার!

এ ভাবেই ফিরে আসতে হয়। ১০ ডাউনিং স্ট্রিটের সিঁড়িতে দাঁড়ানো ডেভিড ক্যামেরনের হাসিটা যেন সে কথাই জানিয়ে দিল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE