Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Russian Revolution

রুশ বিপ্লব ও গণতান্ত্রিক বিকল্পের তত্ত্ব

কী ভাবে, কোন পথে এল রুশ বিপ্লব? সবিস্তার বিশ্লেষণে কুণাল চট্টোপাধ্যায়কী ভাবে, কোন পথে এল রুশ বিপ্লব? সবিস্তার বিশ্লেষণে কুণাল চট্টোপাধ্যায়

রুশ বিপ্লব। ছবি: থটকো।

রুশ বিপ্লব। ছবি: থটকো।

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৭ ০১:৪৬
Share: Save:

অক্টোবর বিপ্লবের সমালোচকরা অন্যতম প্রধান যে দাবি করে থাকেন তা হল, বলশেভিকরা অনেক বেশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করে একনায়কতন্ত্র কায়েম করেছিলেন। সুতরাং ১৯১৭ সালে বলশেভিকদের গণতান্ত্রিক বিকল্প কী ছিল সেটা খতিয়ে দেখা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রুশ উদারপন্থীদের প্রগতিশীল অংশ বলে পরিচিত ক্যাডেট দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করে যে এক এবং অবিভাজ্য পিতৃভূমির সমর্থনে এবং বৃহৎ শক্তির মর্যাদা রক্ষার্থে সমস্ত মতভেদ দূরে সরিয়ে রেখে সরকারকে সমর্থন করতে হবে। একটা হিসেব অনুযায়ী, যুদ্ধের প্রথম দশ মাসেই রাশিয়ার প্রতি মাসে গড়ে তিন লাখ সৈনিক নিহত, আহত বা বন্দি হয়। ১৯১৭ পর্যন্ত, রাশিয়ার গড় মাসিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল: মৃত– ৪০,০০০, আহত, ১,২০,০০০ এবং বন্দি বা নিখোঁজ ৬০,০০০। যুদ্ধবন্দি যারা মারা যায়, তাদের বাদ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে রুশ সামাজ্যের মোট সৈনিকের মৃত্যু সম্পর্কে এক জন ইতিহাসবিদের হিসেব হল মোটামুটি ১৮ লাখ। রুশ সেনাবাহিনীর মধ্যে, এবং দেশের ভিতরে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে, তাই যুদ্ধ থামানোর আকাঙ্খা ছিল তীব্র।

আরও পড়ুন: নভেম্বর বিপ্লবের শতবর্ষের বিষাদ

উদারপন্থী রাজনীতিবিদদের অবস্থান ছিল অন্য রকম। যুদ্ধ চালাবার জন্য যে কাঠামো দরকার ছিল রাষ্ট্র তা তৈরি করতে ব্যর্থ হয়। এখানে এগিয়ে আসে উদারপন্থী এবং পুঁজিপতিদের জোট। প্রিন্স ল’ভভের নেতৃত্বে গঠিত হয় ওয়ার ইন্ডাস্ট্রি কমিটি। এতে অংশ নেন পেত্রোগ্রাদের শিল্পপতি এবং রক্ষণশীল উদারপন্থী দল ইউনিয়ন অফ অক্টোবরের নেতা আলেক্সান্দার গুচকভ, মস্কোর শিল্পপতি পাভেল রিয়াবুশিন্সকি এবং কিয়েভের ধনী চিনিকল মালিক মিখাইল তেরেশ্চেঙ্কো। এঁরা অনেকেই ১৯১৭-তে অস্থায়ী সরকারে ঠাঁই পাবেন। ২৫ অগস্ট ১৯১৫, ক্যাডেট এবং ইউনিয়ন অফ অক্টোবরের সঙ্গে বাকি কিছু ছোট দল হাত মিলিয়ে তৈরি করে প্রগতিশীল জোট। এদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করে যুদ্ধ আরও ভাল ভাবে পরিচালনা করা এবং রুশ পুঁজির মুনাফা নিশ্চিত করা। উদারপন্থী দলের আধুনিক ইতিহাসবিদ রোসেনবার্গ দেখিয়েছেন, ১৯১৬-র মার্চে ক্যাডেট দলের সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতা ও ইতিহাসবিদ, পাভেল মিলিউকভ ডুমাতে এক বক্তৃতায় বলেন, “আমি জানি, রাশিয়াতে বিপ্লব হলে আমরা নিশ্চিত ভাবে হেরে যাব। আমাকে যদি বলা হয়, রাশিয়াকে যুদ্ধে জয়ের জন্য সংগঠিত করার অর্থ বিপ্লবের জন্য সংগঠিত করা, তবে আমি বলব, তা হলে যত দিন যুদ্ধ চলছে, তাকে অসংগঠিত রেখে দিন।” মিলিউকভ, গুচকভ বা ডুমার সভাপতি রডঝিয়াঙ্কো, জারের চেয়ে গণরোষকে অনেক বেশি ভয় পেতেন।

রুশ বিপ্লবের সময় কর্মীদের বিক্ষোভ। ছবি এজেন্সি ফ্লান্স প্রেস—গেটি ইমেজেস

ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ও বুর্জোয়া গণতন্ত্র

১৯১৬-র ডিসেম্বর থেকেই রাশিয়াতে নতুন করে ধর্মঘটের জোয়ার দেখা দিয়েছিল। পুরনো ক্যালেন্ডারের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছিল পাশ্চাত্য ক্যালেন্ডারের ৮ মার্চ। পেট্রোগ্রাদের বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের ডাকা ধর্মঘট দ্রুত রূপান্তরিত হয় সাধারণ ধর্মঘটে। ২৭ ফেব্রুয়ারি থেকে সৈনিকদের মধ্যে ধর্মঘটরত শ্রমিকদের পক্ষে চলে যাওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। ১ মার্চের মধ্যে শহরের গোটা ফৌজ বিদ্রোহীদের পক্ষে চলে যায়। জার নিকোলাস ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু কে সরকার গড়বে? তার ভিত্তি এবং দায়বদ্ধতা কী ভাবে স্থির হবে? ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রডঝিয়াঙ্কো ডুমার সদস্যদের আনুষ্ঠানিক সভা করতে দিতে রাজি ছিলেন না, কারণ জারের অনুমতি ছাড়া তা হয় না। একটি বেসরকারি বৈঠকের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। দক্ষিণপন্থীরা সেই বৈঠক বয়কট করে। শ্রমিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা (বলশেভিক এবং মেনশেভিক) বহুকাল কারারুদ্ধ বা সাইবেরিয়াতে নির্বাসিত। ফলে এটা হল কার্যত প্রগতিশীল জোটের সভা। এরা একটা অস্থায়ী কমিটি নির্বাচিত করে। তার আনুষ্ঠানিক নেতা রডঝিয়াঙ্কো হলেও প্রকৃত রাজনৈতিক নেতা ছিলেন মিলিউকভ। এই কমিটির উদ্দেশ্য ছিল শেষ মুহূর্তেও জারের সঙ্গে রফা করে স্থিতি ফিরিয়ে আনা।

অঙ্কন: সুমন চৌধুরী

কিন্তু গোলমাল পাকালেন শ্রমিকরা। একই সময়ে গড়ে ওঠে একটি সোভিয়েত— শ্রমিক এবং সৈনিকদের প্রতিনিধি পরিষদ। সেই সময়ে সোভিয়েতের নেতৃত্বে ছিলেন মেনশেভিক এবং সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি, এই দুই দলের কিছু নেতা। এই নেতারা বিপ্লবকে দেখেছিলেন বুর্জোয়া বিপ্লব হিসেবে। তাঁরা হাতে ক্ষমতা চাননি। কিন্তু তাঁরা রাজতন্ত্রের উচ্ছেদ চেয়েছিলেন। সোভিয়েত যেন ক্ষমতা হাতে না নেয়, তাই উদারপন্থীরা একটি অস্থায়ী সরকার গঠন করলেন এবং সোভিয়েতের নেতারা সেটা মেনে নিলেন। প্রধানমন্ত্রী হলেন প্রিন্স ল’ভভ।

আরও পড়ুন: সামন্ততন্ত্রের মেরুদণ্ডের সঙ্গে ভেঙেছিল ব্যক্তিসত্তাও

শহরের সাধারণ মানুষের চোখে ন্যায্যতা ছিল সোভিয়েতদের, অর্থাৎ সেই মুহূর্তে কার্যত মেনশেভিক দল এবং সোশ্যালিস্ট রেভলুশনারি দলের উপর। অস্থায়ী সরকার যে সোভিয়েতের দাক্ষিণ্যে ক্ষমতায় আছে, তার সেরা প্রমাণ জেনেরালদের কাছে যুদ্ধ দফতরের মন্ত্রী গুচকভের এক স্বীকারোক্তি। সেনাবাহিনীতে তিনি কেন (পুরনো ধরনের) শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনছেন না, জেনেরালদের এই ভর্ৎসনার জবাবে তিনি জানান, সোভিয়েতের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তিনি সে রকম কোনও পদক্ষেপ করতে পারবেন না। ২২ মার্চ, রুশকোয়ে স্লোভো পত্রিকা সখেদে লেখে, ‘বুর্জোয়া’ কথাটা যেন একটা গালি, যা ‘বদমায়েশ’ আর ‘শুয়োরের’ মাঝামাঝি অবস্থিত। অর্থাৎ, অস্থায়ী সরকারের সামনে বিরাট সমস্যা হল, ন্যায্যতা আদায় করা।

২ মার্চ টাউরিডে প্রাসাদের সামনে এক বিরাট মিছিল থেকে কেউ এক জন প্রশ্ন করে, “কে তোমাদের নির্বাচিত করেছে?” বিব্রত মিলিউকভ উত্তর দেন, “আমাদের বেছে নিয়েছে রুশ বিপ্লব।” কিন্তু যদি বিপ্লব স্বয়ং এই সরকারকে বাছাই করে থাকে তবে বিপ্লবের তাকে বরবাদ করতেই বা কত ক্ষণ? পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতের অন্যতম সদস্য স্টেকলভ মন্ত্রীদের সাবধান করে দেন, আপনাদের মনে রাখতে হবে যে আমরা চাইলেই আপনাদের চলে যেতে হবে। কারণ আপনাদের কোনও স্বাধীন গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব নেই।

রুশ বিপ্লব। ছবি: স্পুটনিক কমিউনিকেশন

দ্বিতীয় সম্ভাবনা ছিল দাবি করা যে, অস্থায়ী সরকারের ন্যায্যতা এসেছিল শেষ ডুমার থেকে। কিন্তু এই দাবির সমস্যা ছিল। প্রথমত, ডুমা নির্বাচন হয়েছিল এমন সঙ্কীর্ণ ভিত্তিতে, যে তা কোনও ভাবেই গোটা দেশের প্রকৃত প্রতিনিধি ছিল না। দ্বিতীয়ত, জার ২৭ ফেব্রুয়ারি এই সব গোলযোগের মাঝখানে ডুমার অধিবেশন বন্ধ বলে ঘোষণা করেছিলেন। ডুমার আইনি ভিত্তি যেহেতু ছিল জারের নির্দেশ, তাই ডুমা চালু ছিল না। ফরাসি বিপ্লবে, অনুরূপ পরিস্থিতিতে তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা রাজাদেশ অগ্রাহ্য করে নিজেদের জাতীয় সভা বলে ঘোষণা করেছিলেন। ডুমা প্রতিনিধিরা তা করেননি, বরং জারের নির্দেশ মেনে নিয়েছিলেন।

ক্যাডেট দলের আইনজীবীরা অনেক চেষ্টা করেন, তৃতীয় একটা ভিত্তি তৈরি করতে, যা হল, অস্থায়ী সরকার জারের কাছ থেকেই ন্যায্যতা পেয়েছে। সমস্যা হল, নিকোলাস ইস্তফা দিয়েছিলেন। কিন্তু এই সব সাংবিধানিক নাটক যথেষ্ট ছিল না। দরকার হল অস্থায়ী সরকারের জন্য একটা গণভিত্তি গড়ে তোলার। আর একটা পদক্ষেপ তাই করতেই হল। সেটা হল কিছু কিছু অধিকারের স্বীকৃতি। এগুলো উপর থেকে দান ছিল না। নীচে থেকে তুমুল চাপ ছিল। এর মধ্যে এমন কিছু অধিকার ছিল যে তাঁদের মানতে হয়েছিল দাঁতে দাঁত চেপে, যেমন পেট্রোগ্রাদ সোভিয়েতের এক নম্বর নির্দেশ। এই নির্দেশে বলা হয়, সেনাবাহিনীর সমস্ত ইউনিট নির্বাচিত প্রতিনিধি পাঠাবে এবং ইউনিটভিত্তিক কমিটি নির্বাচন করবে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যরা অফিসারদের নির্দেশ মানবে, কিন্তু তার বাইরে তাঁরা সমস্ত রাজনৈতিক, নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করবে। সেনাবাহিনীর আচরণ থেকে সমস্ত পুরনো সামন্ততান্ত্রিক আদবকায়দা নিষিদ্ধ করা হয়। যখন উচ্চপদস্থ সেনানায়করা প্রতিবাদ জানান, তখন যুদ্ধমন্ত্রী গুচকভ জানান, তাঁর হাত-পা বাঁধা।

কর্মীদের সামনে বক্তব্য রাখছেন লেনিন। ছবি: ওয়ার্কারস ইন্টারন্যাশনাল কমিটি।

সংবিধান সভা

কিন্তু এ সব হল সাময়িক পদক্ষেপ। প্রশ্ন হল, সংবিধান সভা কবে ডাকা হবে এবং কোন ভিত্তিতে? ৩ মার্চ সরকার ঘোষণা করল, প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংবিধান সভার নির্বাচন হবে। পরদিনই মিলিউকভ ফরাসি রাষ্ট্রদূতকে বলেন যে, তিনি নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া এড়াতে চাইছেন। এই পর্বে ক্যাডেটরা বলশেভিকদের ভয়ে ভীত ছিল না। তাদের ভয় ছিল, দ্রুত নির্বাচন হলে সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি দল গ্রামাঞ্চলে বিপুল ভোট পাবে। ক্যাডেটদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মাকলাকভ বলেন, বিপ্লব থেকে রাশিয়া এত বেশি স্বাধীনতা পেয়েছে যা সামলানো যাচ্ছে না। সভোবোদনিই নারোদ নামের একটি ক্যাডেটপন্থী পত্রিকা লেখে যে জনগণের বৃহদাংশ স্বাধীনতার অর্থ সঠিক ভাবে বুঝতে পারছে না। তাই ক্যাডেটদের চোখে, আগে ভোট চাই না আগে শৃঙ্খলা, যা হবে সংবিধান সভার ভিত্তি।

জারের আমলের ডুমাতে যে দলগুলি ছিল উগ্র দক্ষিণপন্থী, তারা প্রকাশ্য রাজনীতি থেকে সরে যায়। বহু ক্ষেত্রে তাদের সদস্যরা মধ্য-দক্ষিণ দলগুলিতে ঢুকে ১৯১৭-র মার্চ থেকে কার্যত ক্যাডেট দলই সামনে এগোতে থাকে। তারা বোঝাতে চায়, যে তারা শ্রেণির ঊর্ধ্বে ওঠা উদারপন্থী দল। প্রিন্স ট্রুবেটস্কয়ের মতো রক্ষণশীলরাও ক্যাডেট দিলে যোগ দেন। দলের নেতারা আলেক্সান্দার কোনোভালভ বা রিয়াবুশিনস্কির মতো নেতৃস্থানীয় শিল্পপতি এবং শিল্প-বাণিজ্যের প্রধান সংগঠনদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করতেন। তবে বামপন্থী ক্যাডেটরা, যথা নেক্রাসভ, কৃষি সংস্কারের সমর্থক ছিলেন এবং অর্থনীতিতে কিছুটা রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের পক্ষপাতী ছিলেন বলে বড় শিল্পপতিদের অনেকে তাঁদের সন্দেহের চোখে দেখতেন। কিন্তু অল্প কয়েক মাসের মধ্যেই বোঝা যায়, সম্পত্তির মালিকদের কাছে ক্যাডেটদের চেয়ে ভাল ঘোড়া আর কেউ নেই। আবার, তার ফলে, পার্টির মধ্যে ভরকেন্দ্র বাম থেকে মধ্য-দক্ষিণের দিকে সরে যায়। কিন্তু ১,০০,০০০ সদস্য, বিপুল অর্থবল, সব সত্ত্বেও যখন বলশেভিকরা সংবিধান সভার নির্বাচন করেন, ক্যাডেটরা পায় মাত্র ৬-৭ % ভোট এবং ৭০০ জন প্রতিনিধির মধ্যে মাত্র ১৭ জন। তাদের এই হাল কেন হল? তার কারণ হল, ১৯১৭-র বিপ্লবী পরিস্থিতিতে ক্যাডেটরা পেটি বুর্জোয়া-কৃষক-ইত্যাদি কারও কাছ থেকে সমর্থন পায়নি।

গণতন্ত্রের নামে এই সরকার যে গণতন্ত্র চায়নি, তার প্রমাণ অজস্র। দেখা গেল, নির্বাচন কমিশনের নাম ঘোষণাতেই চলে গেল তিন সপ্তাহ। ভোটে দাঁড়াবার পন্থা স্থির করতে লাগল দু’মাস। তারপর জটিল তর্ক শুরু হল— ভোটের বয়স কী হবে? ১৮ না ২০ না ২১? যে বিপুল সংখ্যক সৈনিক পালিয়ে গিয়েছিল তাদের ভোট থাকবে কি না, তা ততটাই আলোচিত হল, যতটা আলোচিত হল ক্ষমতাচ্যুত রোমানভ বংশের ভোট থাকবে কি না। অবশেষে জুন মাসে সারা রাশিয়া সোভিয়েত কংগ্রেসের কাছে বলশেভিকরা শ্রমিকদের বিশাল মিছিল নিয়ে দাবি করবে যেন সোভিয়েতরা ক্ষমতা দখল করে, এই হুমকির মুখে অস্থায়ী সরকার ১৪ জুন ঘোষণা করল যে ১৭ সেপ্টেম্বর ভোট হবে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনের ক্যাডেট সভাপতি কোকোশকিন এবং কমিশনের বাইরে ক্যাডেট নেতারা নির্বাচন আরও পিছিয়ে দিতে চেষ্টা করেন। জুলাই মাসে যে সঙ্কট হয় তখন ক্যাডেট মন্ত্রীরা ইস্তফা দেন। বুর্জোয়া দল এবং সমাজতন্ত্রী দলদের নতুন জোটের প্রস্তাবে তাঁরা রাজি হন এই শর্তে যে ভোট পিছোনো হবে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। এই সময়ে চলছিল কর্নিলভের সামরিক অভ্যুত্থানের চক্রান্ত। সেটা সফল হলে ভোট অনির্দিষ্টকালের জন্য পিছিয়ে যেত, এমন অনুমান করা অন্যায় হবে না।

তবু, বলা হয়, বলশেভিকরা তো সংবিধান সভা ভেঙে দিয়েছিলেন। এ নিয়ে যথাযথ আলোচনার জন্য অন্য একটি প্রবন্ধ দরকার। এখানে আমরা কয়েকটি কথা বলতে পারি:

১) উদারনৈতিক পক্ষ সংবিধান সভার বিরোধী ছিল গোড়া থেকেই, তাই তারা সেটা মানত না। এর প্রমাণ, গৃহযুদ্ধের সময়ে তারা নানা সামরিক একনায়কত্বের পক্ষেই ছিল (কলচাক, দেনিকিনের শাসন, পরে র‍্যাঙ্গেলের)- তখন শ্বেতরক্ষী এলাকায় কোনও সংবিধান সভা গড়ে ওঠেনি।

২) নীচে আমরা দেখব, শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকরা কতকগুলি মৌলিক দাবি তুলছিলেন। সেই দাবি সমর্থন করে সোভিয়েতে প্রাধান্য পাচ্ছিলেন বলশেভিক এবং বামপন্থী সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিরা। অর্থাৎ, যেখানে বিচ্ছিন্ন ভোটদাতা হিসেবে না, সক্রিয় ভাবে মানুষ রাজনীতিতে অংশ নিচ্ছিলেন, সেখানে তাঁদের গণতান্ত্রিক মত অন্য ভাবে দেখা যায়।

লেনিন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

গণ দাবি বনাম ‘গণতন্ত্রী’ দলগুলির সরকার

১৯১৭-র যত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ আছে, সেগুলিতে বারে বারে বলা আছে, যুদ্ধ কী ভাবে রুশ সমাজকে ভেঙে ফেলছিল। তা হলে অস্থায়ী সরকার কেন যুদ্ধ থামালো না? কোনও কোনও ইতিহাসবিদ এই ভাবেই দেখতে চেয়েছেন, যেন ব্যাপারটা ছিল একটা হিসেবের ভুল। এই ভাবে দেখলে রুশ শাসক শ্রেণি যুদ্ধের প্রতি কতটা দায়বদ্ধ ছিল তা বোঝা যায় না। একা রাশিয়া জার্মানির এবং অস্ট্রিয়ার সঙ্গে শান্তি আলোচনাতে বসবে, এতে তারা রাজি ছিল না। বলকান অঞ্চলে ও পশ্চিম এশিয়াতে যা যা লাভের কথা হয়েছিল (কনস্ট্যান্টিনোপল (ইস্তানবুল), পক ও দার্দানেলিস প্রণালী, গ্যালিসিয়া, বুকোভিনা, তুর্কি আর্মেনিয়া এবং পারস্যের অংশ), সেটা ছাড়তে নতুন শাসকরাও রাজি ছিল না। ক্যাডেট দলের কংগ্রেসে রডিচেভ বলেন, “ওরা বলে, এ সব হল রুশ সাম্রাজ্যবাদী লালসা। না। এ দখল নয়। এ হল রাশিয়ার স্বাধীনতার ভিত্তি।” মিলিউকভ স্পষ্ট জানান, তিনি দখল ছাড়া শান্তি (peace without annexations) নীতির বিরোধী। আর যুদ্ধ থেকে মালিকদের যে মুনাফা আসছিল, সেটা রক্ষা করতেও তাঁরা ছিলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই আট ঘণ্টা শ্রমদিবস, লিঙ্গ নিরপেক্ষ ভাবে সমান কাজে সমান মজুরি, আধা-সামন্ততান্ত্রিক আইন রেখে ফ্যাক্টরি চালানো বন্ধ করা, এই সব দাবি মানতে মালিকরা রাজি ছিল না। এরই জবাবে তৈরি হয় ফ্যাক্টরি কমিটি আন্দোলন, যাতে জুন মাসের মধ্যে বলশেভিক প্রাধান্য আসে।

রাশিয়াকে বড় এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে বহাল রাখার অর্থ অবশ্যই শাসক শ্রেণির অর্থনৈতিক ক্ষমতা বজায় রাখা। তার মানে জমি আর ফ্যাক্টরি নিয়ন্ত্রণের লড়াই। অস্থায়ী সরকারের প্রথম কৃষিমন্ত্রী শিংগারেভ জানান, তিনি দৈনিক ১০০টি করে টেলিগ্রাম পাচ্ছিলেন, যার বিষয়বস্তু ছিল কৃষক কমিটিদের ‘বে-আইনি’ ব্যবহার। কৃষকরা নিজেদের হাতে জমি চেয়েছিলেন। কৃষক কংগ্রেস, যাতে প্রাধান্য ছিল সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিদের, দাবি করেছিল জমির সামাজিকরণ। আর্থ-ব্যবস্থার সঙ্গে ঋণের জন্য বাঁধা রাখা জমির নিবিড় সম্পর্ক ছিল। তাই সরাসরি জমি বাজেয়াপ্তকরণ গোটা ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে বিপাকে ফেলতে পারত। মুখে সংবিধান সভার জন্য অপেক্ষা করতে বললেও, বাস্তবে তাই উচ্চ শ্রেণিরা জমি বাঁচাবার জন্য মরণপণ লড়াই চালাচ্ছিল। ৫০ দেসিয়াতিনের বেশি জমির মালিকদের এক সমিতি তাই দ্রুত জমি কেনাবেচার মাধ্যমে জমিদারদের সুবিধার জন্য লড়াই করে। মে থেকে অক্টোবরের মধ্যে জমিদারদের চাপে কৃষকদের বিরুদ্ধে সরকারি পদক্ষেপ, বিশেষত ফৌজ পাঠানো বাড়তে থাকে। অক্টোবরে ১০৫টা ক্ষেত্রে ফৌজ পাঠিয়ে ২০০০ জনের বেশি জমি কমিটি সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়। সেপ্টেম্বরে টামবভ প্রদেশে কৃষক প্রতিরোধ গণ বিদ্রোহের আকার ধারণ করে এবং জমিদাররা পিছু হঠতে বাধ্য হয়।

কর্নিলভের অভ্যুত্থান

গণতন্ত্রের প্রতি ক্যাডেটদের তথা বুর্জোয়া শ্রেণির আনুগত্য কতটুকু তার শেষ প্রমাণ এল জেনেরাল কর্নিলভের ষড়যন্ত্রের সময়ে। জুলাই মাসে মেশিনগান রেজিমেন্টের সৈন্যরা সশস্ত্র অভ্যুত্থানের দিকে যাওয়ার কথা ভাবে, কিন্তু বলশেভিক পার্টি নেতৃত্ব বোঝেন, সারা দেশে নতুন অভ্যুত্থানের পক্ষে সমর্থন নেই, তাই তাঁরা সৈন্যদের বলেন কেবল সশস্ত্র মিছিল করতে, অভ্যুত্থানের দিকে না যেতে। তা হলেও, এর ফলে উগ্র বলশেভিক বিরোধিতা বাড়ে। কিন্তু এই অবস্থায় কোনও বুর্জোয়া নেতার সরকারের প্রধান হওয়া সম্ভব ছিল না। তাই প্রধানমন্ত্রী হলেন কেরেনস্কি। আর প্রধান সেনাপতি জেনেরাল ব্রুসিলভকে সরিয়ে নতুন সেনাপ্রধান করা হয় জেনেরাল লাভর কর্নিলভকে। কেরেনস্কির পরিকল্পনা ছিল সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে সোভিয়েতদের ক্ষমতা কমানো, বিশেষ করে বলশেভিকদের দমন করা। কিন্তু ক্যাডেটদের এবং কর্নিলভের পরিকল্পনা ছিল কেরেনস্কির পরিকল্পনার আড়ালে পুরোদমে সামরিক একনায়কতন্ত্র কায়েম করা। স্বাভাবিক ভাবেই এই রকম পরিকল্পনা খোলাখুলি হয়নি। ফলে ষড়যন্ত্র দু’টিরই চরিত্র নিয়ে একটু ধোঁয়াটে ভাব ও ঐতিহাসিক তর্ক রয়েছে। কিন্তু যা তর্কাতীত, তা হল অগাস্টের শেষে কর্নিলভ রাজধানীর দিকে সৈন্য নিয়ে এগোতে শুরু করেন। তাঁর অজুহাত ছিল যে বলশেভিকরা অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করছে। অস্থায়ী সরকারের সদস্য আর এক ল’ভভকে তিনি বলেন, বলশেভিকরা ২৮ অগস্ট থেকে ২ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা করছে। তাদের ঠেকানোর জন্য সরকারের সব ক্ষমতা সেনাপ্রধানের হাতে হস্তান্তর ছাড়া কোনও উপায় নেই। বিপন্ন বোধ করে কেরেনস্কি শেষ সময়ে সোভিয়েতদের সাহায্য চান। বলশেভিকরা ঘোষণা করেন, এই লড়াইয়ে তাঁরাও যোগ দেবেন— কেরেনস্কিকে বাঁচাতে নয়, বিপ্লবকে বাঁচাতে। কর্নিলভ ব্যর্থ হলেন, কারণ সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে সাধারণ সৈনিকদের কোনও মতের মিল ছিল না। সোভিয়েতের বামপন্থী অংশ (সর্বাগ্রে বলশেভিকরা) শ্রমিক ও সৈনিকদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রচার নিয়ে গেলে কর্নিলভের ষড়যন্ত্র মিলিয়ে যায়।

কর্নিলভের অভ্যুত্থান ছিল শাসক শ্রেণির একাংশের পক্ষ থেকে বুর্জোয়া গণতন্ত্র ব্যবহার করে শ্রেণিস্বার্থ রক্ষা করা যাবে না বুঝে বিকল্পের সন্ধান। এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হলে প্রভাব বাড়ল বামপন্থীদের। কিন্তু সমাজে যে দ্বন্দ্বগুলি ছিল তাদের কমার সম্ভাবনা তো ছিলই না, বরং তারা তীব্রতর হচ্ছিল। কর্নিলভের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হওয়ার ফলে ক্যাডেটরা মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেয়। কেরেনস্কি নতুন করে জোট সরকার গড়ার চেষ্টা করে, কিন্তু ক্যাডেটদের ব্যাপারে এত সন্দেহ ছিল যে জোটে তারা থাকবে কি না সেটা বিতর্কিত বিষয় হয়ে পড়ে। আর ক্ষমতার ভরকেন্দ্র বাঁয়ে ঘুরলেও গণতন্ত্র, যুদ্ধ, জমি, খাদ্য, এ সব নিয়ে দ্বন্দ্বের কোনও সমাধান হয়নি। ফলে ১ থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর কেরেনস্কিকে পাঁচ সদস্যের একটি ‘ডিরেক্টরি’ দিতে কাজ চালাতে হয়। ডিরেক্টরির কালপর্ব এবং তৃতীয় জোট মন্ত্রিসভার সময়ে সরকারের কর্তৃত্ব একেবার খতম হয়ে যায়।

সরকারের জন্য নতুন গণভিত্তি তৈরি করার আশায় সোভিয়েতদের কার্যনির্বাহক কমিটি এবং কেরেনস্কি হাত মিলিয়ে গণতান্ত্রিক সম্মেলন বলে একটি সভা ডাকে। এতে মূল বিবাদ হল, বুর্জোয়া দলগুলির সঙ্গে কোনও জোট গড়া হবে কি না তা নিয়ে। বলশেভিকরা সরাসরি এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। ১৫৮২ জন প্রতিনিধির মধ্যে বলশেভিক ছিলেন ১৩৬ জন। কিন্তু জোট সরকারের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠতা (৭৭৬–৬৮৮) থাকলেও, ক্যাডেটদের বাদ দেওয়ার পক্ষেও ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মত। অথচ, ক্যাডেটদের বাদ দিয়ে কোনও প্রকৃত জোট সম্ভব ছিল না। গণতান্ত্রিক সম্মেলন শেষ হওয়ার আগে সাধারণতন্ত্রের অস্থায়ী পরিষদ নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ার কথা বলে। কিন্তু কেরেনস্কি জানান, তিনি সাধারণতন্ত্রের অস্থায়ী পরিষদের নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন না। উপরন্তু এই সাধারণতন্ত্রের অস্থায়ী পরিষদের সদস্য সংখ্যা নির্ধারিত হয় অগণতান্ত্রিক ভাবে। ফলে বলশেভিকরা এতে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। বলশেভিকদের প্রভাবে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েতও অস্থায়ী পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়। বলশেভিকদের চাপে সোভিয়েতদের কার্যনির্বাহক কমিটি গভীর আপত্তি সত্ত্বেও শেষ অবধি সারা রাশিয়া সোভিয়েতদের দ্বিতীয় কংগ্রেস আহ্বান করে যে, কংগ্রেস বসার সময়ে পেত্রোগ্রাদ সোভিয়েত ট্রটস্কির নেতৃত্বে অভ্যুত্থান করে সোভিয়েত ক্ষমতার ভিত্তি গড়বে।

রুশ বিপ্লবের সময় মস্কোয় লেনিন। ছবি: গেটি ইমেজেস।

‘গণতান্ত্রিক’ সমাজতন্ত্রীরা

সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারি দল (এস আর) এবং মেনশেভিকরা বুর্জোয়া বিপ্লবের তত্ত্ব নিয়ে চলছিলেন। এই তত্ত্বের মূল কথা হল, রুশ বিপ্লবের চরিত্র বুর্জোয়া, তাই বুর্জোয়া শ্রেণির থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া চলবে না। এই কারণেই তাঁরা নিজেদের কর্মসূচি ত্যাগ করে, ব্যাপক শ্রমিক, কৃষক এবং সৈনিকের দাবী অগ্রাহ্য করে বুর্জোয়া সরকারের পদক্ষেপগুলি মেনে নেন। এর পর তাঁরা সরকারে প্রবেশ করতে রজি হলেন, সরকারকে বিপ্লবের দিকে নিয়ে যেতে নয়, তাঁদের প্রতি শ্রমিক-কৃষক-সৈনিকের আস্থা আছে, ক্যাডেটদের প্রতি নেই, তাই তাঁদের কর্তৃত্ব ব্যবহার করে অস্থায়ী সরকারকে বাঁচাতে। তাঁরা সেপ্টেম্বরেও বলশেভিকদের সঙ্গে জোট গড়ার বিরোধী ছিলেন, কারণ বলশেভিকদের সঙ্গে জোট বুর্জোয়া শ্রেণিকে দূরে ঠেলে দেবে। অথচ ক্যাডেটরা, রোসেনবার্গের ভাষায়, গৃহযুদ্ধ মানসিকতা গ্রহণ করেছিল। মিলিউকভ স্পষ্ট বলেন, বিপ্লব যদি বুর্জোয়া বিপ্লব হয়, তা হলে বুর্জোয়া শ্রেণিকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সমাজতন্ত্রী জোট গড়ে বুর্জোয়া বিপ্লবের কার্য সম্পাদন করা অসম্ভব। সাধারণতন্ত্রের পরিষদে নাবোকভ ড্যান ও অন্য মেনশেভিকদের উদ্দেশে বলেন যে এখন আশু কাজ হল বলশেভিক দমন। এস আর-দের সবচেয়ে দক্ষিণপন্থী অংশ, অর্থাৎ কেরেনস্কি ও তাঁর সমর্থকরা একই অভিযোগ করেন। তাঁরা বলেন, বলশেভিকরা দেশ রক্ষা করতে চায় না, তারা নৈরাজ্য প্রচার করছে, তাই অস্থায়ী সরকারকে সমর্থন করলে তাদের সঙ্গে রফা করা চলবে না।

১৯১৭-র গোড়াতে এস আর দল ছিল বৃহত্তম বামপন্থী দল। দলের সদস্য সংখ্যা গ্রীষ্মকালে ১০ লাখ পেরিয়ে গিয়েছিল। দলে ক্রমে তিনটি ধারা দেখা দেয় — কেরেনস্কি, ব্রেশকভস্কায়ার নেতৃত্বে দক্ষিণপন্থীরা, চের্নভের নেতৃত্বে মধ্যপন্থীরা এবং নাটানসন, স্পিরিদোনোভা ও ক্যামকভের নেতৃত্বে বামপন্থীরা। সেপ্টেম্বরে বামপন্থীরা পেত্রোগ্রাদ কমিটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংবিধান সভা নির্বাচনের প্রার্থী তালিকা তৈরি হওয়ার সময়ে মধ্য-দক্ষিণ জোট নিজেদের প্রার্থীই বেশি রাখে এবং দলে আনুষ্ঠানিক ভাঙন হয় তার পরে। কিন্ত দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেস, আপতকালীন কৃষক সোভিয়েত কংগ্রেস এবং দ্বিতীয় কৃষক সোভিয়েত কংগ্রেস, সব কটিতেই বামপন্থী এস আর-রা ছিলেন অনেক বেশি।

মেনশেভিকদের মধ্যে কয়েকটি ধারা ছিল। ১৯১৭-র গোড়ার দিকে তাদের সদস্য সংখ্যা বলশেভিকদের চেয়ে দ্রুত বাড়ে। কিন্তু অগাস্টের পর তাদের আর সদস্য সংখ্যা খুব বাড়েনি (মোটামুটি ২,০০,০০০)। উপরন্তু তাদের সদস্য অনেকটাই কিছু পকেটে ছিল, যেমন জর্জিয়াতেই ৫০,০০০। বলশেভিকরা শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে অনেক বেশি ছিলেন। যেমন, বলশেভিক সম্মেলনে ৪০% প্রতিনিধি ছিলেন শ্রমিক আর মেনশেভিকদের সম্মেলনে ২০%।

দক্ষিণপন্থী মেনশেভিকরা দলে ছিলেন ৫%-এর মত, কিন্তু সরকারে তাদের প্রভাব ছিল বেশি। লিবার ও ড্যানের নেতৃত্ব মধ্যপন্থীরা ছিলেন দলের ৫৫ থেকে ৬০%। বাকিরা ছিলেন মেনশেভিক আন্তর্জাতিকতাবাদী এবং সংযুক্ত আন্তর্জাতিকতাবাদী। (শেষ গোষ্ঠীর একাংশ বলশেভিক দলে যোগ দেন, আর একাংশ মেনশেভিক দল থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন থাকেন)।

দ্বিতীয় সোভিয়েত কংগ্রেসের প্রতিনিধিদের মধ্যে মাত্র ৭৯ জন কোনও রকম বুর্জোয়া দলের সঙ্গে জোট গড়ার পক্ষে ছিলেন। তবু, মেনশেভিক এবং এস আর-রা (বাম এস আর-রা না) কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গেলেন। অর্থাৎ, অনুপস্থিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিকল্পের খোঁজ তাঁদের শেষ পর্যন্ত শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে নিয়ে গেল। বলশেভিকরা এর পরও সব সমাজতন্ত্রীদের যৌথ সরকারের কথা ভাবতে রাজি ছিলেন, কিন্তু তাঁদের শর্ত ছিল, সেই সরকারকে সোভিয়েতের অধীন হতে হবে। আর ড্যান প্রমুখ দাবি করলেন, সোভিয়েতের নিয়ন্ত্রণ চলবে না, এবং প্রস্তাবিত সরকার থেকে লেনিন ও ট্রটস্কিকে বাদ দিতে হবে। অর্থাৎ, যে নীতির ভিত্তিতে এবং যাঁদের নেতৃত্বে অক্টোবর অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেই নীতি ও নেতৃত্বকে বাতিল করতে হবে। বলশেভিক একগুঁয়েমি বা ক্ষমতালিপ্সা নয়, মেনশেভিক-এস আর জোটের বাস্তব, অনুপস্থিত বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিকল্পের খোঁজ তাঁদের ঠেলে দিয়েছিল বিপ্লব বিরোধিতার দিকে।

সবচেয়ে বামপন্থী মেনশেভিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন ইউলি মার্তভ। কিন্তু তিনিও সোভিয়েত কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে গেলেন। এবং তাঁরই চিঠি থেকে আমরা জানি, মেনশেভিক শ্রমিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে। এর কারণ, তিনি মনে করেছিলেন, সোভিয়েত ক্ষমতা কখনও বিপ্লবী গণতন্ত্রের ভিত্তি হতে পারে না, কারণ সোভিয়েতে বুর্জোয়াদের স্থান নেই। অক্টোবরের পরেই ক্যাডেটরা সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করলেও, তিনি তাঁদের উপর নিষেধাজ্ঞার বিরোধী ছিলেন। শ্রমিকরা যখন দাবি করেন, ফ্যাক্টরি মালিকরা শ্রমিক বিরোধী কাজ করছে কি না তা নজরে রাখার জন্য নির্বাচিত ফ্যাক্টরি কমিটিদের মাধ্যমে শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে, মার্তভ তারও বিরোধিতা করেন। অর্থাৎ, বুর্জোয়া শ্রেণি এবং উদারপন্থী দলেরা সরাসরি গণতন্ত্রের বিরোধী ছিল। আর মেনশেভিক ও সোশ্যালিস্ট রেভল্যুশনারিরা (বাম এস আর-দের কথা স্বতন্ত্র) বুর্জোয়া শ্রেণি এবং ক্যাডেট দলকে সঙ্গে রাখা শ্রমিক-কৃষককে বা দেশের ব্যাপক মানুষকে সঙ্গে রাখার চেয়ে জরুরি মনে করেছিলেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE