মিনা (ডানদিকে) ও রুথ।
‘তোমার হাতের লেখা বেশ খারাপ। আশ্চর্য লাগে, কারণ সেলাই বা আঁকা, সব ধরনের হাতের কাজই তো তোমার খুব সুন্দর। যাই হোক, তুমি বরং মোটা পেন ব্যবহার করা শুরু করো। তাতে হাতের লেখা ভাল হতে পারে।’
একটি বাচ্চা মেয়েকে তার মায়ের লেখা চিঠি। প্রথম বার পড়ে মনে হবে, নেহাতই মামুলি। ভুল ভাঙবে, যখন শুনবেন কী পরিস্থিতিতে লেখা হয়েছিল চিঠিটি।
কেমন সেই পরিস্থিতি, তা বুঝতে যেতে হবে সেই ১৯৪০-এ। জার্মানির প্রত্যন্ত প্রান্তে। ফ্রাঙ্কফুর্টের দক্ষিণে ছোট্ট গ্রাম ফ্রাঙ্কিশ-ক্রুমবাখ। মূলত ইহুদিদের বাস সেই গ্রামে। গ্রামের সব থেকে বর্ধিষ্ণু পরিবারটি ওপেনহাইমারদের। সে বাড়িরই মেয়ে রুথ। বয়স মাত্র নয়। তার পরেও তিন ভাইবোন রয়েছে। তাদের নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকেন মা। রুথের দিন কাটে পরিচারিকা মিনার সঙ্গে গল্পগুজব আর খেলাধুলো করে। সে জানে, তার থেকে বছর দশেক বড় মিনা ইহুদি নয়, ক্যাথলিক খ্রিস্টান। কিন্তু ধর্ম নিয়ে এই গ্রামে কেউই বিশেষ মাথা ঘামায় না। ছোট্ট রুথ-ও নয়।
লক্ষ লক্ষ ইহুদির মতো রুথেরও নিস্তরঙ্গ জীবন ওলোটপালট করে দিয়েছিল নাৎসি বাহিনী। ১৯৩৯ সালের নভেম্বর মাসে তাদের গ্রামে হানা দেয় হিটলারের সেনারা। নির্বিচারে ইহুদি-হত্যা করে অসংখ্য গ্রামবাসীকে বন্দি করে নিয়ে যায় তারা। তাঁদের মধ্যে ছিলেন রুথের বাবা-মা-ও। তার কিছু দিন আগেই অবশ্য অশনি-সঙ্কেত পেয়ে রুথ ও তার ভাইবোনদের বিদেশে বিভিন্ন আত্মীয়দের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন ওপেনহাইমার দম্পতি। নাৎসি বাহিনীর কবলে তাই পড়েনি বাচ্চারা। ওপেনহাইমারদের ঠাঁই হয় প্রথমে ফ্রান্সের এক কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, তারপর পোলান্ডের কুখ্যাত আউশভিৎস কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে।
সেই কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প থেকেই ছেলেমেয়েদের নিয়মিত চিঠি লিখতেন ওপেনহাইমাররা। কিন্তু জানাতেন না, কী ভয়াবহ পরিস্থিতিতে রয়েছেন তাঁরা। চিঠিতে থাকত নানা দৈনন্দিন বিষয়। চিঠি পাঠাতেন মিনার ঠিকানায়। এই আশায়, কোনও না কোনও দিন সেই সব চিঠি সন্তানদের হাতে পৌঁছবে। মিনা-ও যত্ন করে রেখে দিয়েছিলেন চিঠিগুলো। যুদ্ধ থামলে ওপেনহাইমাররা যদি ফেরেন, সেই আশায়।
মিনার সেই আশা অবশ্য পূর্ণ হয়নি। ১৯৪২ সালে আউশভিৎস কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মেরে ফেলা হয় ওপেনহাইমার দম্পতিকে। তার বহু বছর পরে দেশে ফেরেন রুথ। তাঁর হাতে চিঠিগুলো তুলে দিয়ে মিনা বলেন, ‘‘তোমার অতীত আমার কাছে গচ্ছিত ছিল।’’ ক্যাথলিক খ্রিস্টান, জার্মান এক মেয়ের চেষ্টায় সম্পূর্ণ হয় ইহুদি পরিবারের স্মৃতিরেখা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy