মলদ্বীপের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি মোকাবিলায় আজ সাউথ ব্লকে বারবার উঠে আসছে ত্রিশ বছর আগের একটি অভিযানের কথা। কিন্তু পরিস্থিতি ও প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন। তাই ইচ্ছে থাকলেও হাত কামড়ানো ছাড়া পথ নেই নয়াদিল্লির। কৌশলগত ভাবে ভারতের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ এই দ্বীপরাষ্ট্রটি ক্রমশ চিনের হাতে চলে যাচ্ছে এবং তাদের অঙ্গুলিহেলনে অস্থিরতা ক্রমশ বাড়বে, সে ব্যাপারে সব তথ্য থাকা সত্ত্বেও।
মলদ্বীপের যে প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মহম্মদ নাশিদকে ছুড়ে ফেলার জন্য এই অশান্তির সূত্রপাত, সেই তিনিই ১৯৮৮ সালে সে দেশের অস্থিরতা দূর করার জন্য তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গাঁধীকে সেনা পাঠাতে অনুরোধ করেছিলেন। তখন মলদ্বীপ সরকারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের চেষ্টা করেছিল শ্রীলঙ্কার তামিল জঙ্গিরা। মদত ছিল স্থানীয় এক ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীর। দু’বার চিন্তা না করে সে দিন সেনা পাঠিয়ে দেন রাজীব, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘অপারেশন ক্যাকটাস’।
আজ বিদেশ মন্ত্রক আক্ষেপের সঙ্গে বলছে, চিনের ‘ক্যাকটাস’ সক্রিয়তায় কাঁটা আজ ছেয়ে গিয়েছে মলদ্বীপে। কিন্তু আন্তর্জাতিক জনমত তৈরি করা ছাড়া সরাসরি কিছু করা সম্ভব নয়। কারণ সে সময় গণতান্ত্রিক ভাবে জিতে আসা সরকারের অনুরোধে সেনা পাঠানো হয়েছিল। এ ক্ষেত্রে পরিস্থিতি অন্য। ঘরোয়াভাবে বলা হচ্ছে, আজ যদি দিল্লি সেনা পাঠায়, তা হলে ভুল বার্তা যাবে এবং দৃষ্টান্ত তৈরি হবে। চিনও ভবিষ্যতে কাশ্মীরের ‘জিহাদে’ সামরিক মদত দিতে এগিয়ে আসার মান্যতা পেয়ে যাবে।
আরও পড়ুন: তাইওয়ানে ভূকম্প, হেলে পড়ল হোটেল, আটকে বহু
বিদেশমন্ত্রকের পক্ষ থেকে আজ একটি বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘‘মলদ্বীপের মানুষের সাংবিধানিক অধিকার খর্ব হওয়ায় এবং সে দেশের সুপ্রিম কোর্টের রায়কে অগ্রাহ্য করে জরুরি অবস্থা জারি করার সিদ্ধান্তে আমরা উদ্বিগ্ন। সরকার সতর্কতার সঙ্গে পরিস্থিতির উপর নজর রাখছে।’’ পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখার পাশাপাশি আমেরিকা এবং জাপানের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ রাখছে নয়াদিল্লি। মূল্যায়ন করা হচ্ছে চৈনিক ভূমিকারও। মাও-এর চিন বিপ্লবকে দীর্ঘজীবী করতে গোটা এশিয়া তছনছকরেছিল। পরে দেন জিয়াও পিং অার্থিক সংস্কার ও উন্নয়নে মন দিয়েছিলেন। কিন্তু শি চিনফিং নিজের সীমান্তের বাইরে গিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্রের উপর বাণিজ্যিক এবং কৌশলগত প্রভাব খাটানো এবং ঘাঁটি গড়ায় সক্রিয়।
যে মলদ্বীপে ২০১১ সাল পর্যন্ত চিনের দূতাবাসও ছিল না, আজ সেখানকার রাজনৈতিক ও বাণিজ্যিক প্রতিটি পদক্ষেপে জড়িত বেজিং। গত ডিসেম্বরে সাউথ ব্লকের রক্তচাপ দ্বিগুণ করে মলদ্বীপের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করে চিন। মলদ্বীপও ভারতের আবেদন কার্যত অগ্রাহ্য করে চিনের ওবর প্রকল্পে সবুজ সংকেত দিয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, সে দেশের বিভিন্ন পরিকাঠামো প্রকল্পে ভারতীয় সংস্থাগুলিকে হঠিয়ে চিনা সংস্থাগুলি
জায়গা করে নিয়েছে গত এক বছরে। একশো পাতার ওই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিটির মাধ্যমে চিন আগামী কয়েক বছরে মেগা-পরিকাঠামো প্রকল্প, বিশাল আবাসন প্রকল্প, হোটেল, যাবতীয় পরিবহন প্রকল্পের একচেটিয়া বিনিয়োগের অধিকার পেয়ে গিয়েছে।
২০১২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের পর মহম্মদ নাশিদকে তখ্তচ্যূত করার সময় থেকেই চিনের বাড়বাড়ন্ত শুরু এই দ্বীপরাষ্ট্রে। প্রেসিডেন্ট আবদুল্লা ইয়ামিন গোড়া থেকেই বেজিং-এর হাতে তামাক খাচ্ছেন। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গড়ার বরাত পায় এক ভারতীয় সংস্থা। নাশিদ যাওয়ার পর সেটি বাতিল করে বরাত দেওয়া হয় চিনা সংস্থাকে। শুধু বাণিজ্যিকক্ষেত্রে প্রভাব বাড়ানোই নয়, চিনের আসল লক্ষ্য ভারতের নামমাত্র দূরত্বে একটি ঘাঁটি তৈরি করে নয়াদিল্লিকে চাপে রাখা। ইতিমধ্যেই মলদ্বীপের একটি বিস্তীর্ণ এলাকা লিজে নিয়ে সেখানে বড় সামরিক ঘাঁটি বানানোর জন্য তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে বেজিং।
বর্তমান মলদ্বীপ সরকারকে নিরঙ্কুশ করাটা তাই চিনের অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy