জোড়া উৎসবে মশগুল ইয়াজ়িদিরা। একটা উৎসব ধর্মের। আর দ্বিতীয়টা, শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তির।
গত শুক্রবার অসলোতে যখন নোবেল ঘোষণা হচ্ছিল, তখনও ওঁরা পাহাড়ে। উত্তর ইরাকের লালিশ শহরের এক পাহাড়ি মন্দিরে। সন্ধে পার করে খালি পায়েই বাড়ি ফিরলেন সকলে। সঙ্গে বুকভরা সাহস আর ‘জঙ্গিদের হারিয়ে দেওয়া’র উল্লাস।
দু’দিন পরে তাঁদের হয়েই মুখ খুললেন হেড এস শিনগ্যালি। পেশায় অনুবাদক এবং এই ফ্রিল্যান্স সাংবাদিকের কথায়, ‘‘লড়তে শিখিয়েছে মেয়েটা। নোবেল দিয়েছে। আর কী চাই!’’ বছর চব্বিশের তরুণী নাদিয়া মুরাদ এখন পাকাপাকি ভাবে জার্মানিতে। রাষ্ট্রপুঞ্জের শুভেচ্ছাদূত। ‘‘তবু সে তো ঘরেরই মেয়ে,’’ ফেসবুক মেসেঞ্জারে লিখলেন সিঞ্জারের বাসিন্দা শিনগ্যালি।
২০১৪-য় এই সিঞ্জার থেকেই জঙ্গিদের খপ্পরে পড়েন নাদিয়া। রাতারাতি হয়ে যান যৌনদাসী। মাস তিনেক পরে সেখান থেকে পালিয়ে তিনি পৌঁছন দুহোক উদ্বাস্তু শিবিরে।
এখন কী অবস্থা উত্তর ইরাকের সেই শিবিরের? প্রতি শনিবার সেখানে ইয়াজ়িদি বাচ্চাদের ইংরেজি পড়ান জাপানি বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক সিরাজ ডেভিস। নাদিয়ার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বললেন, ‘‘নাদিয়াকে কুর্নিশ। আশা করব, আগামী দিনে আরও অনেককে লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা দেবেন এই ডাকাবুকো তরুণী। আর এক জন আউং সান সু চি নয়, নাদিয়াকে আমরা নাদিয়ার মতো করেই চাই।’’
সালটা ১৯৯১। নাদিয়ার তখনও জন্ম হয়নি। মায়ানমারে মানবাধিকার এবং গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ে একটানা লড়াইয়ের সুবাদে সে বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ‘জননেত্রী’ সু চি। আজ তিনি দেশের মুখ্য রাজনৈতিক পরামর্শদাতা। আজ তাঁরই প্রশাসনের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা জাতিনিধনের অভিযোগ। অথচ সু চি-র মুখে কুলুপ। কেন?
এই প্রশ্ন তুলেই উত্তর ইরাকের মাটি কামড়ে পড়ে থাকা স্বেচ্ছাসেবী শিক্ষক ডেভিস বললেন, ‘‘নোবেল পাওয়ার পরে নাদিয়ার দায়িত্বটা আরও বাড়ল। দুর্নীতির বিরুদ্ধেও এখন সরব হতে হবে নাদিয়াদের। তেল কোম্পানিগুলো এখানে ইয়াজ়িদিদের জমিতে তেল খুঁড়ে চলেছে, কিন্তু ওরা লাভের কানাকড়িও পাচ্ছেন না।’’
ইরাকে এখন কোণঠাসা জঙ্গিরা। এক বছর হল ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন ইয়াজ়িদিরা। তবু স্বস্তি নেই শিংগ্যালির। তাঁর কথায়, ‘‘জঙ্গিরা না থাক, তবু পশ্চিম এশিয়ায় সম্প্রদায় হিসেবে টিকে থাকাটাই এখন প্রশ্নের মুখে। এখানে কেউ চায় না আমাদের।’’ তাই ইরাক থেকে আলাদাও হতে চাইছেন তাঁর মতো অনেকে।
এ সবের মুখোমুখি হওয়াটাও বড় চ্যালেঞ্জ নাদিয়ার। ২০১৬-য় তাঁর সঙ্গেই মানবাধিকার পুরস্কার পেয়েছিলেন লামিয়া আজ়ি বাশার। জঙ্গিদের ল্যান্ডমাইনে এক চোখ-হারানো সেই লামিয়া আজ কোথায়! ডেভিস জানালেন, ইরাকের লোকই লামিয়াকে ততটা চেনেন না।
তবু ফেসবুকে মুখ খোলার সুযোগ পাচ্ছেন কুর্দিস্তানের মেয়ে আশওয়াক। মসুল থেকে পালিয়ে এখন তিনি জার্মানিতে, শরণার্থী। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে লোকটাকে দেখেই চমকে গিয়েছিলেন তরুণী। এ তো সেই জঙ্গি, নিজের শখ মিটিয়ে যে তাঁকে ১০০ ডলারে বেচে দিয়েছিল। জার্মান পুলিশকে গিয়ে সব জানান আশওয়াক। কিন্তু অভিযোগ, তাতে লাভ হয়নি।
নাদিয়াকে এখন এই আশওয়াকদের জন্যও লড়তে হবে বলে দাবি উঠছে সিঞ্জার থেকে। অনেকটা পথ বাকি। ঘরছুট ইয়াজিদি বাচ্চাদের চোখে স্বপ্ন বুনতে থাকা শিক্ষক ডেভিস তবু আশাবাদী। তাঁর কথায়, ‘‘নোবেলের ইতিহাস যা-ই বলুক, আমার বিশ্বাস, আন্দোলনের মুখ থেকে নিছক প্রচারের মুখ হয়ে যাওয়ার মেয়ে নাদিয়া নয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy