Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
International News

ট্রাম্পের কল্যাণে মার্কিন রাজনীতি এখন সবচেয়ে বড় রিয়্যালিটি শো

অনেকেই বলছেন এই ফুলেফেঁপে ওঠা অর্থনীতিতে ট্রাম্পের কোনও কৃতিত্ব নেই, ওবামার আমলের ‘ফিল গুড’ অর্থনীতি তার নিজের গতিবেগেই এগিয়ে চলেছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি।

ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল ছবি।

রানা আইচ
শেষ আপডেট: ২০ জানুয়ারি ২০১৮ ১৯:৪৬
Share: Save:

২০১৬-র নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং হিলারি ক্লিন্টনের মধ্যে কী রকম হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়েছিল মনে আছে তো? পেন্সিলভানিয়াতে প্রায় ৫৯ লাখ প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৪৪,২৯২টি ভোটের ব্যবধানে ট্রাম্প জেতেন। মিসিগানে বলতে গেলে একচুলের ব্যবধানে ট্রাম্প জয়ী হন, প্রায় ৪৫ লাখের কাছাকাছি প্রদত্ত ভোটের জয়-পরাজয় স্থির হয় মাত্র ১১ হাজার ভোটের ফারাকে। উল্লেখ করা যেতেই পারে যে এই তিনটি রাজ্যই তথাকথিত রাস্ট বেল্টে অবস্থিত এবং এই তিনটি রাজ্যই গত ৬/৭টি প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে একনাগাড়ে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দিয়ে এসেছে। সঙ্গে এ-ও বলা যায়, এই তিনটি রাজ্য হিলারি জিতে নিলেই এই ৪৬টি ইলেক্টোরাল ভোট তাঁর কলামেই যেত এবং আজ তিনিই প্রেসিডেন্টের গদিতে আসীন হতেন। কিন্তু যা হয়নি তা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। শুধু বলা যেতে পারে এই রাস্ট বেল্টের বহু কলকারখানা গত তিন দশক ধরে একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এক বিরাট সংখ্যক লোক রুজিরুটি হারিয়ে একেবারে গাড্ডায় পড়েন, না ওয়াশিংটনের শাসক শ্রেণি, না কথায় কথায় শ্রমিকদের চিন্তায় রাতে ঘুম না হওয়া ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতারা— কেউই প্রায় এদের পাশে এসে দাঁড়াননি।

প্রেসিডেন্ট ওবামা তা-ও এখানকার অটোমোবাইল শিল্পের জন্য ২০০৯ নাগাদ, মন্দার বাজারে বিপুল পরিমাণ সরকারি টাকা ঢালেন। কিন্তু দেখা যাচ্ছে তা দিয়েও লোকের ক্ষোভ মেটানো যায়নি। ট্রাম্প এই অঞ্চলের লোকেদের এই বিপুল ক্ষোভে ঘৃতাহুতি দেন - যখন তিনি এই কলকারখানা বন্ধ হওয়ার জন্য প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের আমলের NAFTA চুক্তিকে সরাসরি দায়ী করেন। বলেন, এই সর্বনাশা চুক্তির জন্য সব কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, সব কাজকর্ম বেশি মুনাফার লোভে পাড়ি দিয়েছে কানাডা আর মেক্সিকোতে। তার এই নির্বাচনী প্রচার এই অঞ্চলের বহু মানুষের মনে যে দাগ কাটতে সক্ষম হয়েছে সে কথা মেনে নেওয়াই ভাল। তাই আগের লেখায় ইয়ার্কির ছলে লেখা ‘স্বাস্থ্য যায় যাক কিন্তু ট্রাম্প আসুক’— ব্যাপারটা অত সহজ সরল মোটেই নয়।

আগের কলামে আমেরিকার বর্তমান অর্থনৈতিক অবস্থা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের স্বাস্থ্য, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও অভিবাসন নীতি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। এ বারের লেখায় আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করা যাক।

পরিবেশ

এই নিয়ে আলোচনা করার আগে আমাদের বোঝা দরকার এই একবিংশ শতাব্দীতে সব দেশেই, কি সরকার বা তার বিরোধী পক্ষ— সবাইকেই পরিবেশ নিয়ে একমত হতে হবে। ভাগ্যক্রমে ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথাই বলা যায় যে, এ ব্যাপারে আমরা-ওরা নেই। মোটামুটি ভাবে সব পক্ষই মেনে নিয়েছে লাগামছাড়া উন্নয়ন পরিবেশের ভয়ানক ক্ষতি করে দিতে পারে। পৃথিবীর উষ্ণায়ন সবার জন্যই একপ্রকার মাথাব্যথা। মুশকিল হচ্ছে, আমেরিকার রিপাবলিকানরা পৃথিবী জুড়ে এই উষ্ণায়নের কথা মেনে নিতে চায় না। এ ব্যাপারে এরা এতই কট্টর যে মাঝে মাঝে মনে হয় তা ধর্মান্ধতাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই নিয়ে কোনও কথা বলতে গেলেই এরা পাড়ার মস্তানের মতো আপনাকে শুনিয়ে দেবে, ‘এ সব কথা আমাদের বলে লাভ নেই দাদা। আপনি বরং চায়না, ইন্ডিয়াকে সামলান। আর বৈজ্ঞানিকগুলো কী আজে বাজে বকছে, ওই সব প্রলাপ শোনার মতো সময় আমাদের নেই।’ তা এহেন প্ল্যাটফর্ম থেকে উঠে এসেছেন ট্রাম্পের মতো লোক, তা তিনি কি আর পার্টির থেকে আলাদা কথা বলতে পারেন? ২০১৬-র নির্বাচনী প্রচারে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, পরিবেশ নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই, এই পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধের জন্য আমেরিকার শিল্পে প্রায় ট্রিলিয়ন ডলারের ওপরে ক্ষতি হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হলে তিনি প্যারিস পরিবেশ চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবেন এবং প্রেসিডেন্ট ওবামার আমলের পরিবেশ সংক্রান্ত যাবতীয় বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করে নেবেন।

প্রেসিডেন্ট হয়েই ট্রাম্প প্রমাণ করে দিলেন তিনি আগমার্কা রাজনীতিক নন মোটেও, যা বলেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। প্রথমেই আমেরিকার ইপিএ (এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি)-র প্রধান করে আনলেন স্কট প্রুইটকে। কে এই প্রুইট? না তিনি ওকলাহামা রাজ্যের প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল যিনি এই ইপিএ-র বিরুদ্ধে প্রচুর মামলা লড়েছেন এর আগে। ওবামা প্রশাসনের ‘ক্লিন পাওয়ার প্ল্যান’-এর বিরুদ্ধে মামলাতে ইনি ২৭টি রাজ্যের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অনেকটা চোরকে নিজের বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য ডেকে আনার মতো। এই প্রুইটবাবু ইপিএ প্রধান হয়ে ওবামার সময়ের পরিবেশ সংক্রান্ত বিধিনিষেধগুলো একে একে ছুড়ে ফেলে দিলেন। প্রেসিডেন্ট পদে শপথ গ্রহণ করার কয়েক দিন পরেই ট্রাম্পের বিদেশ দফতরের বদান্যতায় কিস্টোন ওয়েল পাইপলাইনের অনুমতি দেওয়া হয়। ১২০০ মাইল দীর্ঘ এই পাইপলাইন কানাডার আ্যালবার্টা থেকে টেক্সাসে ওয়েল স্যান্ড বয়ে নিয়ে আসবে। এই ওয়েল স্যান্ড থেকে তেল নিষ্কাষণ পরিবেশের জন্য বেশ হানিকারক হতে পারে এই আশঙ্কায় ওবামা প্রশাসন দীর্ঘ দিন ধরে এই পাইপলাইন তৈরির অনুমতি দেয়নি। প্রুইট আবার সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন, আমেরিকার উপকূল বরাবর বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এ বার থেকে তৈলানুসন্ধানের অনুমতিও দেওয়া হবে।

আরও পড়ুন: ট্রাম্পের প্রথম বছর, কী পেলাম আর কী হারালাম

এর পর এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সির প্রধান প্রুইট যেটা করলেন তা এক কথায় ন্যক্কারজনক। তিনি ইপিএ-র ওয়েবসাইট থেকে ভূমণ্ডলীয় উষ্ণায়নের যে কারণগুলো উল্লেখ করা ছিল, তা একে একে সরিয়ে দিলেন। কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যাতে পরিবেশ দূষণ করতে না পারে তা নিয়ে ওবামা আমলের যে কড়া নিয়মকানুনগুলো ছিল তা প্রত্যাহার করলেন। রকমসকম দেখে মনে হচ্ছে, এ বার কয়লা শক্তির পতাকা উড়িয়ে মার্কিন রকেট বুঝি হয়তো মঙ্গল গ্রহের দিকে শীঘ্রই যাত্রা শুরু করবে! এরপর, পয়লা জুন ২০১৭-তে ট্রাম্প তাঁর বহু প্রতীক্ষিত বোমাটি ফাটালেন— ১৯৪টি দেশের মধ্যে পরিবেশ সংক্রান্ত প্যারিস সমঝোতা থেকে আমেরিকার নাম তুলে নিলেন। সুখের কথা এই যে, অন্যান্য দেশ এতে কিছুমাত্র বিচলিত না হয়ে প্যারিস চুক্তির প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছে।

২০১৬-র নির্বাচনে হিলারি ক্লিন্টনের বিরুদ্ধে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর জিতেছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফাইল চিত্র।

বিদেশনীতি

ট্রাম্পের বিদেশনীতি নিয়ে আলোচনা করতে গেলে প্রথমে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিটা ভাল করে বোঝা দরকার। ২০১৬-র নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প প্রায় প্রত্যেক সভায় কী ভাবে বাকি সব দেশগুলো (এর মধ্যে আমেরিকার বন্ধু দেশও আছে) আমেরিকাকে বোকা বানাচ্ছে এই নিয়ে আভিযোগ করতে শুরু করলেন। কাঠগড়ায় দাঁড় করালেন ন্যাটো-র অন্তর্ভুক্ত ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে, যাদের সঙ্গে অর্ধশতাব্দীর ওপর আমেরিকার প্রতিরক্ষা চুক্তি আছে। এই সব দেশকে ক্রমাগত হুমকি দিলেন যে ন্যাটো-তে থাকতে হলে চাঁদার পরিমাণ বাড়াতে হবে, শুধু আমেরিকার ভরসায় বসে থাকলে চলবে না। ক্ষমতায় এলে ইরানের সঙ্গে ওবামা আমলের পরমাণু চুক্তি, প্রশান্ত মহাসাগরের সন্নিহিত চিন ব্যতীত অন্য দেশগুলোর সঙ্গে ট্রান্স প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি ও বিল ক্লিন্টনের আমলে করা এনএএফটিএচুক্তি বাতিল করবেন বলে ঘোষণা করলেন। মেক্সিকো সীমান্ত বরাবর শুধু উঁচু পাঁচিল তুলে ক্ষান্ত হবেন না, বহিরাগতদের জন্য আভিবাসন নীতি তাঁর আমলে আরও কড়া করবেন বলে কথা দিলেন। আমেরিকার পূর্বতন নেতাদের বিশ্বদরদী দৃষ্টিভঙ্গিই আমেরিকার স্বার্থের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে বলে তিনি সরব হলেন। মোদ্দা কথা হল, এতে করে আমেরিকার লোকেরা তাঁর কথা মেনে নিলেও পৃথিবীর অন্য লোকেরা বুঝে গেলেন এ আসলে ‘আমেরিকা আ্যলোন’ করার স্লোগান। আজকের দিনে এই সর্বগ্রাসী, সর্বক্ষণ কানেক্টিভিটির যুগে এই ঘরের এক কোণে পড়ে থাকা দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কী করে তিনি আমেরিকাকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ আসনে বসাবেন তা অবশ্যই প্রশ্নের দাবি রাখে।

ক্ষমতায় এসে প্রথমেই তিনি টিপিপি চুক্তিটি বাতিল করে দিলেন। চিনকে কোণঠাসা করার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের সন্নিহিত অন্য দেশগুলির সঙ্গে বারাক ওবামা যে ধৈর্য সহকারে এই চুক্তিটির প্রেক্ষাপট তৈরি করেছিলেন, ততোধিক ক্ষিপ্রতায় ট্রাম্প তা ময়লা কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করলেন। এই গত সপ্তাহেই তিনি আবার ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তিটি নিয়ে হুমকি দিয়ে রেখেছেন। দাবি করেছেন, চুক্তির শর্তগুলি আবার নতুন করে লিখতে হবে নয়তো আমেরিকা এই চুক্তিটি থেকে বেরিয়ে যাবে। উল্লেখ করা যেতে পারে, এই পরমাণু চুক্তিটি শুধু আমেরিকা ও ইরানের মধ্যে নয়, আরও পাঁচটি দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। তবুও বলব ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্ত আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের কাছে এক ছোটখাটো জয় বিশেষ। বহু মাসের সাধ্যসাধনার পর তারা প্রেসিডেন্টকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে যে এই ভাবে একতরফা কোনও আন্তর্জাতিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাওয়া বিদেশনীতির পরিপ্রেক্ষিতে একপ্রকার হারাকিরির সামিল হবে।

এর মধ্যেই ট্রাম্প তাঁর স্বকীয়তা বজায় রেখে হোয়াইট হাউসে জমজমাট পরিবারতন্ত্র চালু করে দিয়েছেন। বিদেশনীতিতে সম্পূর্ণ অনভিজ্ঞ, জামাতা জ্যারেড কুশ্নারকে অত্যন্ত সংবেদনশীল ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন শান্তি প্রক্রিয়া দেখভাল করার জন্য নিয়োগ করেছেন। হালে, মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে চমকপ্রদ খবর হচ্ছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইজরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি হয়েছেন এবং অচিরেই তেল আভিভের মার্কিন দূতাবাসকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়ে যাবেন বলে অঙ্গীকার করেছেন। বলাই বাহুল্য, ট্রাম্পের এই চূড়ান্ত হঠকারী সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে পৃথিবীর সবক’টি প্রধান দেশ। রাষ্ট্রপুঞ্জে এক সাম্প্রতিক ভোটে সবাই এই মার্কিন সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে একযোগে রায় দিয়েছে, এমনকী ভারতও বাধ্য হয়েছে এহেন একতরফা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ভোট দিতে।

তবে সব কিছু ছাপিয়ে গেছে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার ডিক্টেটর কিম জং উনের টুইটার ঝগড়া। কোনও দিন ট্রাম্প তাঁর টুইটে কিম জংকে ‘রকেটম্যান’, ‘বেঁটেমোটা’, ‘পাগলা লোক’ বলে সম্বোধন করছেন তো কিম জং পরের দিনই ট্রাম্পকে ‘মানসিক ভারসাম্যহীন বুড়ো’ বলে ডাকছেন। এক দিন কিম জং তাঁর টেবিলে নিউক্লিয়ার বোতাম রাখা আছে বলে ঢাক পেটাচ্ছেন তো পরদিনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট টুইট করছেন, “ওরে ভাই, আমার টেবিলেও ও রকম নিউক্লিয়ার বোতাম আছে। কেউ ওকে বলুক যে আমারটা ওর বোতামের থেকে অনেক বড় আর অনেক বেশি শক্তিশালী।’’ সত্যি কথা বলতে কি, পৃথিবীর লোকজনেরা তো মনেই করতে পারছেন না শেষ কবে তাঁরা দুই রাষ্ট্রপ্রধানকে এমন শিশুসুলভ আচরণ করতে দেখেছেন।

শেষ কবে দুই রাষ্ট্রপ্রধানকে এমন শিশুসুলভ আচরণ করতে দেখেছেন। প্রশ্ন এটাই। ফাইল চিত্র।

এই বছরের প্রথম দিনে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎ পাকিস্তানকে হুমকি দিয়ে টুইট করেছেন যে ইসলামি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যদি কোনও কড়া ব্যবস্থা না নেয়, তবে সবরকম সহায়তা বন্ধ করা হবে। ভারতবাসীর কাছে তা অতি অবশ্যই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনার মতো আনন্দদায়ক। কিন্তু দু’হাত তুলে আনন্দে নাচার আগে ভারতবাসীর একবার ভেবে দেখা দরকার, হঠাৎ কি ভারতের প্রতি ভালবাসা দেখিয়ে পাকিস্তানকে ভয় দেখালেন, না কি আফগানিস্তানে আমেরিকার স্বার্থ টিকিয়ে রাখার জন্য এ রকম কড়া হলেন। ট্রাম্পকে নিয়ে কোনও কিছু সিদ্ধান্তে আসতে হলে সবসময় তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতিটা স্মরণ করবেন, তা হলেই দেখবেন সব কিছু কেমন জলের মতো সহজে বোঝা যাচ্ছে।

এবং আবার অর্থনীতি

২০১৬-র নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম্প যতটা আক্রমণাত্মক ছিলেন, গত বছর ২০ জানুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেওয়ার দিনেও দেখা গেল ট্রাম্প ঠিক ততটাই আক্রমণাত্মক রয়েছেন। শপথ নিয়েই বললেন, ‘দিস আ্যামেরিকান কার্নেজ স্টপস রাইট হেয়ার আ্যন্ড স্টপস রাইট নাও।’ ২০১৬-র নির্বাচনী প্রচারে যেমন প্রতিপক্ষের দিকে ছুড়ে দিয়েছিলেন শ্লেষ, শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরের ভাষণেও পূর্বসূরিকে অর্থনীতি নিয়ে কটাক্ষ করলেন। ভাষণে উল্লেখ করলেন বাণিজ্য ঘাটতির কথা, উৎপাদন শিল্পে পুনরুজ্জীবনের কথা এবং যথারীতি হুমকি দিলেন ওবামাকেয়ার তুলে দেওয়ার। আশাপ্রকাশ করলেন তাঁর আমলে আরও কর্মসংস্থান হবে ও শীঘ্রই তিনি মার্কিন জনগণের জন্য করছাড় দিতে পারবেন। দীর্ঘ দিন ধরে বঞ্চিত লোকেদের আশার বাণী শোনালেন যে বঞ্চনার দিন শেষ।

একটা কথা স্বীকার করে নেওয়া ভাল যে ট্রাম্পের ‘মেড ইন আমেরিকা’ নীতির ফলে এই এক বছরে প্রায় চার লাখ নতুন কর্মসংস্থান হয়েছে বিভিন্ন উৎপাদন ও নির্মাণ শিল্পে। কিন্তু আবার এই ট্রাম্প আসার এক বছরে বাণিজ্য ঘাটতিও প্রায় ১০ শতাংশ বেড়ে গেছে। অনেকেই বলছেন এই ফুলেফেঁপে ওঠা অর্থনীতিতে ট্রাম্পের কোনও কৃতিত্ব নেই, ওবামার আমলের ‘ফিল গুড’ অর্থনীতি তার নিজের গতিবেগেই এগিয়ে চলেছে।

এখনও পর্যন্ত যে জায়গায় ট্রাম্প অবশ্যই তার নিজের ছাপ রাখতে সক্ষম হয়েছেন তা হল করছাড়। এবং এই করছাড় নিয়ে ইতিমধ্যেই উঠে গেছে বহু প্রশ্ন। কর্পোরেট কর প্রায় ১৪% কমে যাওয়ায় অনেক কোম্পানিই আবার আমেরিকাতে নতুন করে উৎপাদন করার কথা ভাবছে। টেকনোলজি কোম্পানি আ্যাপল ইতিমধ্যেই আমেরিকার বাইরে গচ্ছিত বিপুল পরিমাণ ক্যাশ এ দেশে ফেরত নিয়ে আসবে বলে ঘোষণা করে দিয়েছে। সে টাকার পরিমাণ সত্যিই বিশাল! প্রায় ২৪০ বিলিয়ন ডলার। আ্যাপলের দেখাদেখি অন্য কোম্পানিগুলি যদি আমেরিকার বাইরে তাদের গচ্ছিত টাকা ফিরিয়ে আনে তা হলে মার্কিন অর্থনীতি যে আরও শক্তিশালী হবে তাতে কোনও দ্বিমত নেই। কিন্তু এই বিপুল পরিমাণ করছাড়ে আগামী ১০ বছরে বাজেট ঘাটতি বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে, বাজার থেকে নিতে হবে আরও ঋণ এবং এর ফলে আমেরিকান কর্জের পরিমাণ আরও ১.৫ ট্রিলিয়ান ডলার বেড়ে যাবে। এর প্রভাব হতে পারে সুদূরপ্রসারী। আমি অর্থনীতিবিদ নই, কোনও রকম ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারব না। সাধারণ বুদ্ধিতে শুধু একটাই প্রশ্ন করতে পারি, সবাই নিজের ভাগের কড়িটি নিয়ে কেটে পড়লে দেশটা গড়া হবে কী ভাবে?

উপসংহার

সত্যি কথা বলতে কি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো আমেরিকান প্রেসিডেন্ট এর আগে হয়নি। এর আগে যত প্রেসিডেন্টই এসেছেন, সবাই হয় ঝানু রাজনীতিবিদ, প্রেসিডেন্ট হওয়ার আগে মার্কিন কংগ্রেসে নির্বাচিত হয়েছেন, নয় কোনও জবরদস্ত মিলিটারি জেনারেল। আর যা-ই হোক, আধুনিক যুগের কোনও রাষ্ট্রপতি এ রকম চাঁচাছোলা ভাষায় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণ করেননি। আমেরিকার মতো দেশের সর্বাধিনায়কের চেয়ারের সঙ্গে যে শালীনতা জড়িয়ে আছে এ ব্যাপারে মোটামুটি ভাবে সবাই একমত হলেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যে তা নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবিত সে কথা এই এক বছরে কখনও মনেই হয়নি। অবশ্য প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের গোঁড়া সমর্থকেরা এই ব্যাপারে দ্বিমত পোষণ করবেনই। তাঁরা ঠিক এমনটাই চেয়েছিলেন যে! তাঁরা তাঁকে সর্বান্তঃকরণে সমর্থন দিয়েছেন কারণ তিনিই ওয়াশিংটনের রাজনীতিবিদদের ভণ্ড বলেছেন, মনে করিয়ে দিয়েছেন যে সিস্টেমে পুরো পচন ধরেছে, একমাত্র তিনিই পারেন আমেরিকার খেটে খাওয়া লোকেদের ন্যায়বিচার দিতে।

গত এক বছরে তিনি তাঁর নিজের প্রশাসনের কত রথী মহারথীকে যে ‘ফায়ার’ করেছেন বা এঁদের অনেকেই পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তার ইয়ত্তা নেই। অ্যাটর্নি জেনারেল (অস্থায়ী) স্যালি ইয়েট্স, এফবিআই ডিরেক্টর জেমস কোমি, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ফ্লিন, হোয়াইট হাউস কম্যুনিকেশন ডিরেক্টর মাইক ডুবকে ও অ্যান্টনি স্কারামুচি, হোয়াইট হাউস প্রেস সেক্রেটারি শন স্পাইসার, হোয়াইট হাউস চিফ অব স্টাফ রিন্সে প্রেইবাস, চিফ স্ট্র্যাটেজিস্ট স্টিভ ব্যানন, ডেপুটি অ্যাসিস্ট্যান্ট সেবাস্টিয়ান গোরকা, হেলথ সেক্রেটারি টম প্রাইস— প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের দৌলতে এঁরা সবাই এখন ‘প্রাক্তন’। এর মধ্যে প্রথম দু’জন বাদ দিয়ে আর বাকিরা সবাই ট্রাম্পের পছন্দের লোক। প্রশ্ন উঠতেই পারে, তা হলে ঠিক কী দেখে তিনি এই লোকেদের প্রশাসনের উচ্চপদে নিয়োগ করেছিলেন? আর করেছিলেনই যদি তাঁদের এত কম সময়ে কেন সরে যেতে হল? তবে কি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঠিক লোক চেনার ক্ষমতায় ঘাটতি আছে?

ট্রাম্পের এই তুঘলকি চালচলনের কথা সব দেশের কাগজেই ঢালাও করে লেখা হয়েছে। আরও হবে। অনেক দিন পর এটা এমন এক সময় যখন রাজনীতিতে সেই ম্যাড়মেড়ে ভাবটা আর নেই। ট্রাম্পের কল্যাণে সবার অলক্ষ্যে মার্কিন রাজনীতি হয়ে উঠেছে জীবনের সবচেয়ে বড় রিয়েলিটি শো।

(লেখক ক্যালিফোর্নিয়ার বাসিন্দা)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE