Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪
International News

আমি শুধু মুন্নার মা, মিনার নয়?

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে উখিয়া শরণার্থী শিবির। প্রথম প্রথম দুঃসহ জীবনযাপন। রেশনের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার থেকেও লম্বা লাইন বাথরুমের সামনে। রোজ ভোরে সেই ঘিনঘিনে জায়গায় দাঁড়িয়ে গা গুলিয়ে ওঠে নাসিমার।

দুই সন্তান মুন্না ও মিনার সঙ্গে নাসিমা। —নিজস্ব চিত্র।

দুই সন্তান মুন্না ও মিনার সঙ্গে নাসিমা। —নিজস্ব চিত্র।

সীমন্তিনী গুপ্ত
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৮ ০৩:০৯
Share: Save:

নাফ নদী পেরোনোর জন্য যেই নৌকায় উঠতে যাবেন, মেয়ের কচি হাতটা মুঠো থেকে ছেড়ে গেল। অন্ধকার, ঠেলাঠেলি। এক বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখারও সুযোগ নেই। ‘‘তবে পিছন থেকে কেউ যেন তখন হেঁকে বলেছিল— চিন্তা নেই, আমাদের নৌকায় তুলে নেব।’’

মাসখানেক আগে কথা হচ্ছিল বছর পঁচিশের নাসিমার সঙ্গে, বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তের কাছে উখিয়া ত্রাণ শিবিরে বসে। সত্যি কি শুনেছিলেন এমন কোনও কথা?

আমার প্রশ্নটা শুনে চুপ করে থাকলেন কিছু ক্ষণ। তার পর ফের বলতে শুরু করলেন, ‘‘অগস্টের শেষের দিক। তারিখটা আর মনে পড়ে না। শুধু মনে আছে, এ-দিক ও-দিক থেকে সমানে রোহিঙ্গা বসতি জ্বালানোর খবর আসছে। আমাদের পাড়া ছেড়েও পালাচ্ছে লোকজন। নদী পেরোলেই নাকি অন্য দেশ। সেখানে নিজেদের ঘরবাড়ি না-থাকতে পারে। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে মরার ভয়, ইজ্জত হারানোর ভয় তো নেই।’’

নাসিমার স্বামী ফরিদ ঠিক করেছিলেন, তিনিও বৌ-বাচ্চা নিয়ে পালাবেন। সঙ্গে আরও কয়েক জন। সীমান্ত-সেনার চোখ এড়িয়ে কোথায়, কী ভাবে, কখন নৌকায় চড়তে হবে, সেই ট্রেনিং দেওয়া হয়ে গিয়েছে সবাইকে। শুধু বড় একটা বাক্স মাথায় নিয়েছেন ফরিদ। তাতে রয়েছে জামাকাপড়, শুকনো খাবার। আর একটা ছোট ব্যাগে জমানো টাকা, নাসিমার অল্প কিছু গয়না। আড়াই বছরের মুন্নাকে কোলে তুলে, চার বছরের মিনার হাত ধরে তাঁর সঙ্গে যাত্রা শুরু করলেন নাসিমাও।

স্বগতোক্তির মতো বলছিলেন নাসিমা। ‘‘মা নাকি দুই সন্তানের মধ্যে তফাত করে না। তবু মুন্নার পাতেই কেন যে মাংসের শেষ টুকরোটা তুলে দিতাম, নিজেই বুঝতাম না। ছেলে হওয়ার পরে মেয়ের ওপর টান কি একটু কমে গিয়েছিল? না হলে বুকে আঁকড়ে রাখা ছেলেকে যতটা জোরে চেপে ধরেছিলাম, ঠিক ততটা জোরে কেন চেপে ধরিনি মিনার হাত?’’

সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারের কাছে উখিয়া শরণার্থী শিবির। প্রথম প্রথম দুঃসহ জীবনযাপন। রেশনের লাইনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। তার থেকেও লম্বা লাইন বাথরুমের সামনে। রোজ ভোরে সেই ঘিনঘিনে জায়গায় দাঁড়িয়ে গা গুলিয়ে ওঠে নাসিমার— ‘‘এখানেই আসার এত তাড়া ছিল যে, মেয়েটাকে খুঁজতে নৌকা থেকে এক বার নামলাম না?’’

ছবিটা ক্রমে পাল্টায়। ত্রাণ আসছে। বিদেশি ‘ভলান্টিয়ার’-দের আনাগোনা বেড়েছে। ভলান্টিয়ার শব্দটা এখানেই প্রথম শুনলেন নাসিমা। মানে জানতেন না। এক জন বুঝিয়ে দিল— সাহায্যকারী। কেমন সাহায্যকারী? মেয়েকে খুঁজতে সাহায্য করবে ওরা?

কারা যেন রোহিঙ্গা বাচ্চাদের জন্য স্কুল খুলেছে। সেখানে পড়ানোর কাজ পেলেন নাসিমা। সেই স্কুলেরই দরজায়, ফেব্রুয়ারির এক দুপুরে মিনার হাত ধরে এসে দাঁড়ালেন ফরিদের পিসি। না, ভুল শোনেননি নাসিমা। সেই বৃদ্ধাই পিছন থেকে চিৎকার করেছিলেন, ‘‘চিন্তা নেই, আমাদের নৌকায় তুলে নেব।’’ নিয়েওছিলেন। গত ছ’মাস তিনিই আগলে রেখেছেন নাতনিকে। সে রাতে নৌকা পাননি পিসি। বাংলাদেশে আসার সুযোগ পেতে কেটেছে ছ’মাস। কপাল ভাল। তাই এ পারে ঠাঁই মিলল যে শিবিরে, সেখানেই ডেরা বেঁধেছেন নাসিমা।

সব বিচ্ছেদের গল্পের শেষটা যে এত মধুর হয় না, বিলক্ষণ জানেন নাসিমা! রাতে কোল ঘেঁষে শুয়ে থাকে মেয়ে। ছেলেও। শরণার্থী শিবিরের অনিশ্চিত ছাদের তলায় ঘুমন্ত দুই শিশুর মুখের দিকে চেয়ে গলার কাছটা দলা পাকিয়ে ওঠে নাসিমার। সে দিন মুন্নাকে বেশি জোরে চেপে ধরতে গিয়ে কি আলগা হয়ে গিয়েছিল মিনাকে ধরে রাখা তাঁর অন্য হাত?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rohingya Refugees Myanmar Bangladesh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE